Sylhet Today 24 PRINT

পাথরে হূল নয়, ফুল ফুটুক: অভিনন্দন জেলা প্রশাসন

আব্দুল করিম কিম |  ২২ জুলাই, ২০২০

সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম ও তার দল এক অসাধ্য সাধন করছেন। করোনায় নাকাল হওয়ার এই দুঃসময়ে তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা জমা দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছেন। প্রতিনিয়ত যেখানে জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও বিনষ্ট হচ্ছে, সেখানে একজন জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে এমন উদ্যোগ কেবল প্রশংসাযোগ্য নয়, অভিবাদনযোগ্য। পরবর্তীতে প্রশাসনযন্ত্র চালকদের জন্য অনুকরণীয়।

আমাদের পাথর সম্পদ উত্তোলনে চরম এক অরাজকতা বিদ্যমান। পরিবেশ, প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত হূল ফুটছে। সদিচ্ছা থাকলে হূল ফুল হয়ে ফুটে, তার এক দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল। নাগরিক আন্দোলনের একজন সংগঠক হিসাবে প্রশাসনের বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রকৃতি বা পরিবেশ তিরোহিত হলে আমরা নির্দয় সমালোচনা করি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আমরা প্রশংসা করতে জানি না। প্রশংসাযোগ্য কাজের অবশ্যই প্রশংসা করতে হয়। যেমনটা এই সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে দেখা গেল।

সিলেটের জেলা প্রশাসন কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধভাবে উত্তোলন করা প্রায় এক কোটি ঘনফুট পাথর সম্প্রতি জব্দ করেছে। জব্দকৃত পাথর মঙ্গলবার (২১ জুলাই) যথারীতি নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই নিলামে জব্দকৃত পাথরের জন্য সর্বোচ্চ দর হাঁকা হয় ৩০ কোটি টাকা। কিন্তু এই দর প্রত্যাশিত নয়, বিক্রি হয়নি। আরও বেশি দর পেতে পুনরায় নিলাম ডাক দেয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর মনে করছে, এক কোটি ঘনফুট পাথরের মূল্য অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা হওয়া উচিত। অসাধু পাথর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে নিলাম মূল্য বাড়াতে চাইছে না। নাছোড়বান্দা প্রশাসনও। তারা চাইছেন অন্তত বাজার দর অনুযায়ী পাথরগুলো বিক্রি করতে। আসলে জব্দকৃত পাথর পঞ্চাশ কোটিতে হোক বা ত্রিশ কোটিতেই হোক নিলামে বিক্রি হওয়া মানে রাষ্ট্রের কোষাগারে টাকাটা জমা হওয়া। প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনষ্ট করে উত্তোলন করা কোটি কোটি ঘনফুট পাথর থেকে সরকারের রাজস্ব আয় খুব সামান্য। তবে মূল্য দিতে হচ্ছে অসামান্য।

সীমান্ত উপজেলা কানাইঘাটের লোভা নদী সিলেট অঞ্চলের প্রমত্ত সুরমার প্রাণভ্রমরা। লোভাছড়ার লোভা নদীর তীরে বছর কয়েক ধরে লোভাতুর দৃষ্টি হুল ফুটাচ্ছিল প্রকৃতির। লোভাছড়া পাথর কোয়ারির অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী লোভা নদীর অববাহিকা এলাকায়। লোভাছড়ার এই কোয়ারি মাত্র ৪ কোটি ৩২ লক্ষ টাকায় দুই বছরের জন্য লীজ দেয়া হয়। ৪০২ দশমিক ৮৯ একর আয়তনের এই পাথর কোয়ারির ইজারার মেয়াদ শেষ হয় গত ১৩ এপ্রিল। পাথর কোয়ারির ইজারাদার ছিলেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপপ্রচার সম্পাদক মস্তাক আহমদ পলাশ।

ইজারাদারের ইজারাদারির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও পাথর উত্তোলন চলতে থাকে। পাশাপাশি কোয়ারি এলাকায় লিজকালে উত্তোলন করা কয়েকশ কোটি ঘনফুট পাথরের মজুত থেকে দেশের বিভিন্নপ্রান্তে বিপণন চলতে থাকে। লিজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পাথর বিপণনের দোহাই দিয়ে মেয়াদ পূর্ণ করা লিজ গ্রহীতা মহামান্য হাই কোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। মহামান্য হাই কোর্টের বিচারক রিট পিটিশন শুনানি শেষে রিটগ্রহীতাগণকে ১৫ দিনের সময় প্রদান করেন বিপণন শেষ করার জন্য। এদিকে ১৫ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও লিজগ্রহীতারা ফের মহামান্য হাই কোর্টে রিট পিটিশন জমা দেন আরও ১৫ দিন সময় চেয়ে। কিন্তু মহামান্য হাই কোর্ট রিট পিটিশন স্থগিত করে দেন।

স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, বিপণনের দোহাই দিয়ে মাত্র ১৫ দিন সময় বৃদ্ধি করা হলেও পাথরখেকো চক্র মে-জুন ও জুলাই মাসের অর্ধেক সময়জুড়ে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও বিপণন চালিয়ে যায়। এ অবস্থায় সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলামের নির্দেশে প্রশাসনিক দল সক্রিয় হয়। এই কর্মযজ্ঞে যুক্ত হয় পরিবেশ অধিদপ্তরও।

গত শনিবার (১৮ জুলাই) জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও কানাইঘাট উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দিনব্যাপী টাস্কফোর্সের অভিযানে নামেন। এ সময় লোভাছড়া পাথর কোয়ারিসহ লোভা নদীর তীরে অবৈধভাবে মজুত করা সব পাথর জব্দ করা হয়। অভিযানে অবৈধ পাথর উত্তোলনে ব্যবহার করা প্রায় আড়াই কোটি টাকার অবৈধ যন্ত্রাংশও ধ্বংস করা হয়।

এক লোভাছড়া পাথর কোয়ারির মেয়াদ শেষ হলেও প্রায় আড়াই মাসের অবিরাম সরবরাহ শেষে প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকা মূল্যের পাথর জব্দ হয়েছে। মাত্র সাড়ে চার কোটি টাকার রয়্যালটির বিনিময়ে লিজ নিয়ে লোভাছড়া থেকে দুই বছরে সংশ্লিষ্ট পাথর কারবারি কত আয় করেছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিন মাসে ৫০ কোটি টাকার মজুত হলে অন্তত হাজার কোটি টাকা তো হবেই। লোভাছড়ার এই পাথর জব্দের ঘটনায় আমাদের কাছে স্পষ্ট হলো সিলেটের পাথরসম্পদকে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রেখে লুটেপুটে খাওয়ার আরেক বাণিজ্যের আসল চিত্র। মাত্র কয়েক কোটি টাকা দিয়ে একেকটি কোয়ারি লিজ নিয়ে পাথরখেকো চক্র দীর্ঘদিন থেকে বৈধ ও অবৈধ এ দুই পন্থায় হাজার কোটি টাকা লোপাট করে। যা প্রতিরোধ করতে নেমে স্থানীয় প্রশাসন বরাবর ব্যর্থ হয়। আর এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ প্রকৃতি ধ্বংস করা দুর্নীতি।

বৈধতার ঘোরটোপে অবৈধভাবে উত্তোলন করা এই পাথরের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত হয়। ভাগ-বণ্টনের টপ টু বটম তালিকা হলে কিছু আইনি ফাঁকফোকর বের করতে নিয়োজিত থাকে বর্ণচোরা আরেকটি শ্রেণি। এরা পরিবেশ সুরক্ষার টি-শার্ট পরে পরিবেশ ধ্বংসের কূটকৌশলে লিপ্ত থাকে। তিল থেকে তাল খসলেই এক লাফে উচ্চ আদালত পর্যন্ত দৌড় তাদের। মাটির গহিনে পাথর চিনে আর চিনে হাই কোর্ট।

প্রভাব বিস্তারযজ্ঞের সুবাদে ভাগের মায়ের মতো ভাগের টাকার বেশি জমা পড়ে রাজনৈতিক কিছু নেতার বুক পকেটে। তাই তো তাদের হৃদয়ের অসুখে খরচ করতে হয় কাড়ি কাড়ি টাকা। পাথরখেকো চক্র এই অপকর্মে সিলেটের কিছু সংবাদকর্মীকেও শরিক রাখে। এই সংবাদজীবীরা কোনো রিপোর্ট করেন না। কিন্তু তদবির করেন ঠিকই। এ অবস্থায় জগতবিনাশী এই দুর্বৃত্তপনা প্রতিরোধ করা দুঃসাহসিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়। পরম আরাধ্যের দুঃসাহস সাম্প্রতিক সময়ে শুভ সূচনা হয়েছে বলে মনে করছি। এই সূচনা থেকে সূচিত হোক আরেকটি ধারার। এটি হতে পারে লুটেরাদের লুটতরাজে হানা দিয়ে অন্তত রাষ্ট্রের হিস্যাটা আদায়।

কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন পাথর কোয়ারিতে নিয়মিত অভিযান চলছে। অবৈধভাবে স্থাপন করা স্টোন ক্রাশার মেশিন ও বোমা মেশিনসহ যাবতীয় যন্ত্র বিধ্বংস করার চেষ্টায় টাস্কফোর্সের অভিযান হচ্ছে। যেন পাথরে ফুল ফোটানোর আয়োজন। এর সাথে এবার যুক্ত হলো অবৈধভাবে উত্তোলন করা পাথর জব্দ করে নিলামে বিক্রি করে টাকা জমা পড়ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।

জেলা প্রশাসনের সৎসাহসের সাথে নতুন এই কর্মযজ্ঞের একটাই ফল, রাষ্ট্রের মঙ্গল। তাই আবারও বলি পাথরে হূল নয়, ফুল ফুটুক। পাথররাজ্যে শৃঙ্খলা ফেরানো হোক, পরিবেশ ও প্রকৃতি সুরক্ষিত থাকুক।

লেখক : পরিবেশকর্মী

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.