Sylhet Today 24 PRINT

ডেভিড ম্যাককাচন- বাংলার এক বিস্মৃতপ্রায় মন্দির গবেষক

সোমাভা বিশ্বাস  |  ১২ আগস্ট, ২০২০

প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির সঙ্গে পরিচয় রয়েছে বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী সকল পাঠকের। সত্যজিৎ রায়ের লেখা শেষ ফেলুদা কাহিনী 'রবার্টসনের রুবি'। সেই গল্পে, পিটার রবার্টসন নামের এক সাহেবের ঠাকুরদা একটি দুষ্প্রাপ্য রুবি ভারতবর্ষ থেকে তার সঙ্গে বিলেতে নিয়ে যান বহুকাল আগে। স্বাধীন ভারতের কোনো মিউজিয়ামে সেই রুবি ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে পিটার আসে কলকাতায়, সঙ্গে তার ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বিদ্বেষভাবাপন্ন বন্ধু টম ম্যাক্সওয়েল।

গল্পের শুরুতেই রয়েছে ডেভিড ম্যাককাচনের কথা, বাংলার টেরাকোটা মন্দিরশিল্পের গবেষক, যাঁর লেখা পড়ে পিটার বীরভূমের মন্দির দেখতে চায়, টেগোরের শান্তিনিকেতন দেখতে চায়। তারপর বীরভুমের পটভূমিতে সেই বহুমূল্য রুবি উধাও হওয়ার রহস্যের সমাধানের সঙ্গে সঙ্গেই আরও একবার প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সত্য। সব জাতির মধ্যেই যেমন, তেমনি ইংরেজদের মধ্যেও রয়েছে ভালো মন্দের মিশেল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে, ‘বড় ইংরেজ, ছোট ইংরেজ’।

ইংরেজদের যে বণিকের, শোষকের, অত্যাচারীর, নিষ্ঠুর শাসকের রূপটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ভারতবাসীর, সেটাই সমগ্র ইংরেজ জাতের স্বভাব নয়। ভারতের আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলা চর্চার মাধ্যমে মানব সভ্যতায় অবদান রাখা ইংরেজদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। স্বাধীনতার আগে ছিলেন উইলিয়াম জোন্স, চার্লস উইল্কিন্স, উইলিয়াম কেরি, জেমস প্রিন্সেপের মতো ভারত প্রেমিকরা আর স্বাধীনতার পর ভারত পেয়েছে জেবিএস হ্যালডেনের মতো বহুবিদ্যাজ্ঞ, আর্থার বাশামের মতো ভারততত্ত্ববিদকে। এঁদের সঙ্গে এক আসনে বসানো যায় ডেভিড ম্যাককাচনকেও।       

রবার্টসনের রুবি পড়েছি যখন, তখন পিটার রবার্টসন, টম ম্যাক্সওয়েলদের মতোই ডেভিড ম্যাককাচনকেও কাল্পনিক চরিত্র হিসেবেই ধরে নিয়েছিলাম। ভাবতেই পারিনি তিনি একজন রক্তমাংসের ইংরেজ, আর তিনি যুক্তরাজ্যের কভেন্ট্রির লোক। ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের এই শহরটিতে বাস করতে এসে যখন জানলাম যে এটি ডেভিড ম্যাককাচনের জন্মস্থান, তখন ডেভিড ম্যাককাচন সম্বন্ধে বিভিন্ন সূত্র থেকে খোঁজ নিতে আরম্ভ করলাম। যা জানতে পারলাম তাতে চমৎকৃত হলাম।

পাল ও সেন আমলের পরবর্তীকালে অর্থাৎ পঞ্চদশ শতক থেকে বিংশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত সারা বঙ্গদেশ জুড়ে যে বিপুল সংখ্যক মন্দির নির্মিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে প্রায় কোনো গবেষণাই হয়নি। বাংলার মাটিতে অবহেলায় পড়ে থাকা মন্দির ও মন্দিরাশ্রিত পোড়ামাটির শিল্প সম্বন্ধে ১৯৬২ নাগাদ নেহাত শখ হিসেবে যে খোঁজ আরম্ভ করেন ডেভিড, জ্ঞানপিপাসা, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রম, অসীম ধৈর্য ও মনোবলের জোরে একটি দশকের মধ্যেই পোড়ামাটির অলঙ্করণযুক্ত স্থাপত্যগুলি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার পথে এগিয়ে যান তিনি। ফটোগ্রাফিক ডকুমেনটেশনের কাজে হাত দেন প্রথমে। ক্রমে তথ্য সংগ্রহ একাগ্র গবেষণায় পরিণত হয়। সেই গবেষণা যা সম্পূর্ণ করার লক্ষে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানেই কোনো দেব-দেউল, মসজিদ বা দর্গা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেই তিনি পৌঁছে গেছেন তথ্য সংগ্রহ করতে। বাংলার পুরাকীর্তির সংরক্ষণের জন্য আক্ষরিক অর্থেই প্রাণপাত পরিশ্রম করেছিলেন শেক্সপিয়ারের আপন দেশের এই সাহেব!

যুক্তরাজ্যের কভেন্ট্রি শহরের ব্যবসায়ী অ্যালেন ম্যাককাচন ও লুসি ম্যাককাচনের একমাত্র পুত্র ডেভিড ম্যাককাচন। ম্যাককাচন পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যা তাঁর বোন জ্যানেট। ছোট থেকেই দারুণ মেধাবী ডেভিড। স্কুল শিক্ষা লাভ করেন কভেন্ট্রির  কিং হেনরি দ্য এইট গ্রামার স্কুলে। কেম্ব্রিজের জেসাস কলেজের ছাত্র ডেভিড। ১৯৫৩ তে ইংরেজি, ফরাসী ও জার্মান ভাষা সাহিত্যে ‘ট্রাইপস’ পেয়ে স্নাতক হন। ৫৭ তে সেখান থেকেই স্নাতকোত্তর হন। কেমব্রিজেই ‘টেগোর সোসাইটির’ একজন সদস্য ছিলেন ডেভিড। ভারতবর্ষ ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর কৌতূহলের উদ্রেক হয় সেখান থেকেই। সেখানে প্রাচ্য সম্বন্ধীয় নানা বক্তৃতা সাগ্রহে শুনতেন তিনি। উচ্চশিক্ষা লাভের পর ডেভিড ফ্রান্সের দুটি বিদ্যালয়ে কিছুসময়ের জন্য শিক্ষকতা করেন। তারপরই তিনি ঠিক করেন ভারতবর্ষে যাবেন, পড়ানোর কাজটা তিনি শান্তির আলয়ে করতে চান। সুযোগও মিলে গেল, যখন বিশ্বভারতী থেকে তাঁর আবেদন গৃহীত হল। ১৯৫৭ এর সেপ্টেম্বর মাসে ডেভিড পৌঁছলেন শান্তিনিকেতনে। ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন বিশ্বভারতীতে। কিন্তু সেই সময়ে সেখানকার উত্তপ্ত পরিবেশ এবং নিজের স্বাস্থ্যের অবনতি তাঁকে সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলুনামুলক সাহিত্য বিভাগে ডেভিড অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৬০এ। ‘ইন্ডিয়ান রাইটিং ইন ইংলিশ’ বিষয়টির সূচনালগ্ন থেকেই তিনি এতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন ডেভিড। ছাত্ররা তাঁর পাণ্ডিত্য, ক্লাসে পড়ানোর  ধরণ, ছাত্রদের প্রতি তাঁর সহজ, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ-সব কিছু গ্রহণ করেছিল সাদরে। কলকাতায় বিভিন্ন মহলে পরিচিতি লাভ করছিলেন ডেভিড। তাঁর নিরহঙ্কার, সহজ প্রকৃতি, সাদামাটা বেশভূষা, অনাড়ম্বর জীবনযাপন, কৌতুকপ্রিয় স্বভাব, নানা বিষয়ে জ্ঞান ও জানার আগ্রহ থাকায় অনেকেই খুব সহজে তাঁর বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এ দেশে। চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, অধ্যাপক পুরুষোত্তম লাল, দার্শনিক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আবু সয়ীদ আইয়ুব, অধ্যাপিকা গৌরী আয়ুব দত্ত, অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু, লেখিকা প্রতিভা বসু, কবি নরেশ গুহ, ইতিহাসবিদ অশীন ও উমা দাশগুপ্ত, এমনি আরও অনেকে ছিলেন ডেভিডের বন্ধু।
 
পাশ্চাত্য সঙ্গীতে আগ্রহ থেকেই হয়তো সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। সত্যজিতের প্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠেন ডেভিড। তাঁদের একে অপরকে লেখা চিঠি, ডেভিডের মৃত্যুর পর সত্যজিতের লেখা নিবন্ধ এ কথার সাক্ষ্য বহন করে। সত্যজিতের প্রস্তাবে তাঁর ছবির সাবটাইটেল ইংরেজিতে রচনা করার দায়িত্ব নেন ডেভিড। ‘তিন কন্যা’ থেকে শুরু করে ‘সীমাবদ্ধ’ পর্যন্ত সত্যজিতের সব ছবির ইংরেজি সাবটাইটেল রচনা করেছিলেন ডেভিড। সত্যজিৎই হয়তো টেরাকোটা শিল্পের প্রতি ডেভিডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর ‘অভিযান’ সিনেমার শ্যুটিং চলাকালীন বীরভূমের টেরাকোটার মন্দির দেখে ডেভিডের আগ্রহ জন্মায় এই বিষয়ে। সেই আগ্রহ মাস কয়েকের মধ্যেই পরিণত হয় নেশায়। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন অঞ্চল যেমন, হাওড়া, বীরভূম, হুগলী, বর্ধমান, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুরের সবচেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও ডেভিড পৌঁছে গেছেন কখনো সাইকেলে কখনো বা দিনে পনেরো-কুড়ি মাইল পথ হেঁটে। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্র, ঘন জঙ্গলে সাপ-খোপের ভয়, সে সব অঞ্চলে  থাকা-খাওয়ার চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা- কিছুই তাঁকে নিরস্ত করতে পারেনি। যখন যেখানেই তাঁর আগ্রহের পুরাকীর্তির খোঁজ পেয়েছেন, সেখানেই ছুটে গিয়েছেন ডেভিড। ১৯৬৪ এর শরত কালে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছেন টেরাকোটার টানে। সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখেছিলেন ‘Impressions of East Pakistan’ প্রবন্ধে। পূর্ববঙ্গের শ্যামল স্নিগ্ধ প্রকৃতি, সেখানকার মানুষের সহজ সরল ব্যবহার, অতিথিপরায়ণতা, আন্তরিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া তাঁর মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। সেখানে হিন্দু, মুসলমান মানুষদের মিলিত প্রয়াসে,  চিরাচরিত প্রথায় অনুষ্ঠিত দুর্গোৎসব তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। বেশীরভাগ সময় ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও গুজব রটনার ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গের বুকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হওয়া, পূর্ব পাকিস্তানের মধ্য থেকে এক নতুন দেশের জেগে উঠতে পারার প্রবল সম্ভাবনার কথা ডেভিড তাঁর প্রবন্ধে লিখেছিলেন নির্দ্বিধায়। মন্দিরশিল্প সম্বন্ধে তুলনামূলক গবেষণার জন্যে ডেভিড ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মন্দিরগুলি সম্পর্কেও আগ্রহী হন। হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে- যেমন বিহার, ওড়িশা, মধ্যপদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটকে। এ সব জায়গা থেকে প্রায় কুড়ি হাজারেরও বেশি মন্দির সম্পর্কে সুবিপুল তথ্য জোগাড় করেছেন। মন্দিরের স্থাপত্য বিবর্তন, মন্দির সজ্জা ও অলঙ্করণ বিন্যাস, মন্দিরের স্থপতি, আরাধ্য দেবতা বা প্রাচীন ভাস্কর্য ও মূর্তির বিষয়ে তথ্য আহরণ করে তা যত্নের সঙ্গে রেকর্ড করেছেন। আর এই কর্মযজ্ঞ তিনি চালিয়ে গেছেন কোনো ধরণের ট্রাষ্ট/ফান্ড বা সরকারী অর্থ সাহায্য কিম্বা অনুদান ছাড়াই। সমস্ত ব্যয় ভার বহন করেছেন স্বোপার্জিত অর্থ থেকে। অর্থ সাহায্য না পেলেও, মন্দিরেরশিল্পের গবেষণার কাজে ডেভিড সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন এ কাজে উৎসাহী কিছু মানুষের সাহায্য- প্রিয় ছাত্র সুহৃদকুমার ভৌমিক, মিউজিয়াম কিউরেটর তারাপদ সাঁতরা, মন্দির গবেষক অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, হিতেশরঞ্জন সান্যাল প্রমুখ। ডেভিডের প্রয়াণের পরও এঁরা তাঁর অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে, মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।

তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপনা এবং বাংলার পুরাকীর্তি সম্বন্ধে গবেষণা- দুটি কাজের মধ্যে আশ্চর্য দক্ষতায় ভারসাম্য রেখে চলতেন ডেভিড। ক্লাসে যিনি নিষ্ঠার সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের ইউরোপীয় আঠারো শতক, রোমান্টিক ড্রামা পড়াতেন, গ্যেটের ফাউস্ট, স্যাটানিক স্পিরিট কিম্বা গালিভারের ব্যাখ্যা করতেন, কর্মক্ষেত্রে ছুটির দিনে শীর্ণ, রোদে পোড়া তামাটে চেহারার সেই ডেভিডই ক্যামেরা, মাপজোকের ফিতে, মন্দির গাত্রে আগাছা সাফ করবার কাটারি হাতে চষে বেড়াতেন গ্রাম বাংলা। কখনো একা, কখনো বা সঙ্গে প্রিয় ছাত্র সুহৃদ কিম্বা অন্য কেউ। খুঁজে বার করতেন কোনও বিরল দোচালা, চৌচালা, নবরত্ন কিম্বা পঞ্চরত্ন মন্দির বা টেরাকোটার কোনও হারানো সম্পদ।

দীর্ঘ সময় বাংলায় বাস করতে গিয়ে সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছিলেন ডেভিড। কোট-প্যান্ট নয়, পছন্দ করতেন  পাঞ্জাবি-পায়জামা পরতে, বেলের পানা, অল্প মিষ্টি দেওয়া পায়েস, গরম গরম তালের বড়া খেতেন তৃপ্তি করে। কলকাতায় ডেভিডের জীবনযাপন কেমন ছিল তা চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে ডেভিডের সহকর্মী অধ্যাপক অমিয় দেবের লেখাতে:
“কাজে বুঁদ হয়ে থাকতেন- যখন ৪ নম্বর নন্দী স্ট্রীটে এক পুরনো বসুপরিবারে পেয়িং গেস্ট হয়ে এলেন তখন তাঁর একটু প্রশস্ত ও কিঞ্চিৎ ছায়াছন্ন ঘরে গিয়ে দেখেছি, তিনি, গরমকাল হলে গেঞ্জি গায়ে, কর্মরত, লিখছেন বা পড়ছেন বা তাঁর তোলা ছবির ক্যাটালগ করছেন। বস্তুত, শয়ে শয়ে যে-সব ছবি তিনি তুলেছিলেন তার পেছনে প্রচুর খরচ করতে হত তাঁকে যার দরুন, রুচি থাক বা না থাক, পোশাকেআশাকে বা অন্য কোনো বিলাসিতার তাঁর উপায়ও ছিল না…কৃচ্ছ্রসাধন যাকে বলে তাই-ই তিনি করছিলেন। অথচ তিনি যে শুধু কাজই করতেন তা নয়, মাঝে-মাঝে আড্ডাও দিতেন; তবে কাজে আড্ডায় মেশাতেন না। পা ছড়িয়ে বসে ডেভিড গল্প করছেন, এমন দৃশ্য একেবারে বিরল ছিল না।” (‘টেরাকোটা-মোড়া সমাধি’, আরেক রকম পত্রিকা)    

কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদ ও ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং লেকচারারের দায়িত্ব সামলে ডেভিড মন্দিরশিল্পের গবেষণার কাজ করেছেন। বিভিন্ন মন্দিরের ছবি তোলা, তথ্য সংগ্রহের জন্য একনিষ্ঠভাবে পরিশ্রম করার পাশাপাশি লিখেছেন বাঁকুড়া, বীরভূমের মন্দির নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ, বিভিন্ন জার্নালে লিখেছেন প্রবন্ধ, তুলনামুলক সাহিত্য, মন্দির সংরক্ষণের কাজে সচেতনতা তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন, ধর্ম থেকে শুরু করে মন্দির বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন, বাংলার পটচিত্রের ওপর কাজ করতে আরম্ভ করেছেন, দরিদ্র পটশিল্পীদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধনে তাঁদের কাজ বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনাকেও বাস্তব রূপ দিতে চলেছিলেন। কিন্তু মূল্যবান কাজগুলি অসমাপ্ত রেখে অকালে হারিয়ে গেলেন পৃথিবীর বুক থেকে।              

ডেভিডের কলকাতার বন্ধুরা প্রায়ই ডেভিডকে বলতে শুনেছেন, “সময় নোষ্ট চোলবে না, কাজ কোত্তে হোবে।” মন্দির নিয়ে গবেষণার কাজে একটুও সময় নষ্ট করেননি ডেভিড, কিন্তু পৃথিবীতে তাঁর সময় শেষ হয়ে এসেছিল। পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎই ডেভিডের মৃত্যু হয় ১৯৭২'র ১২ জানুয়ারি। বাংলার বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত হন কভেন্ট্রির ডেভিড। কলকাতার ভবানিপুর সমাধিক্ষেত্রে ডেভিড ম্যাককাচনের সমাধিটি তাঁর বন্ধুরা এক সময় মুড়ে দেন টেরাকোটায়। অকালপ্রয়াত এই মন্দির গবেষকের অসামান্য অবদানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যুর শোক পরিচিত সবাইকে স্থবির করে দিয়েছিল। পরে তাঁর বন্ধু, রাইটার্স ওয়ার্কশপের পুরুষোত্তম লালের প্রচেষ্টায় ডেভিডকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখতে কলম ধরেন তাঁর আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিতেরা। সেই স্মৃতিকথার সংকলন ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। ডেভিডের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে তাঁর সংগৃহীত তথ্যের ওপর নির্ভর করে বন্ধু, ছাত্র, গবেষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একে একে প্রকাশিত হয় Late Medieval Temples Of Bengal, Brick Temples Of Bengal, Patuas And Patua Songs Of Bengal। ডেভিডের তোলা উভয় বাংলার মন্দিরের প্রায় কুড়ি হাজার ছবি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজ়িয়ামে সংরক্ষিত। আর তাঁর সংগ্রহের সব পটচিত্র রয়েছে কভেন্ট্রির হারবার্ট আর্ট গ্যালারিতে। কালিদাস নাগের স্মৃতিতে প্রদত্ত স্বর্ণ পুরষ্কার দিয়ে ডেভিডকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়।

১২ আগস্ট ডেভিড ম্যাককাচনের ৯০ তম জন্মদিন। জন্মদিনে বাংলার এই বিস্মৃতপ্রায় মন্দির গবেষকের জীবন ও কর্মকে ফিরে দেখার প্রয়াসটুকুর মধ্যে দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম।   
 
(রচনাটি তৈরি করতে গিয়ে সহযোগিতা লাভ করেছি পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অমিয় দেবের। তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ)

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.