প্রণবকান্তি দেব | ১৮ আগস্ট, ২০২০
তিনি একজন, ছিলেন সকলের, হয়ে উঠেছিলেন সবার। মনু পাড় থেকে জয় করেছিলেন মুজিব হৃদয়, মানুষের হৃদয়। মানুষের ভালোবাসা আর শোকাশ্রু তাই সঙ্গী হয়েছে শেষ যাত্রায়ও। গণমুখী রাজনীতি, সমাজ, রাস্ট্র আর মানুষের প্রতি দায়বোধ, লোভ-লালসার মোহমুক্ত জীবনযাপনই তাকে দিয়েছে অনন্য উচ্চতা। শুধু হাত বাড়িয়ে নয় বুকের পাঁজর খুলে দিয়ে আলিঙ্গন করেছেন যে-ই গেছে কাছে তাকে। জীবনভর কাউকে দিয়েছেন প্রীতি, কাউকে সাহস আবার কাউকে দিয়েছেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র। দিনে দিনে এইভাবে কাছের দূরের সবাইকে বেধেঁছিলেন ভালোবাসার বাহুডোরে। তাঁর মৃত্যু তাই অপার শূন্যতা তৈরি করে গেল শুধু মনুর মোহনায় নয়, গোটা বাংলাদেশজুড়ে। রাজনীতি-শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনসহ প্রতিটি শুভবুদ্ধির মানুষের বুকে বেদনার ঝড় তুলে তিনি বিদায় নিলেন। বিদায় হে যোদ্ধা! বিদায় কালের কিংবদন্তি! বিদায় মনুপাড়ের মহান হৃদয়!
যাবার বেলায় আজিজুর রহমান ছিলেন মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তার চেয়ে বড়ো কথা তিনি ছিলেন এতদঞ্চলের মানুষের অভিভাবক। সত্তরের এম এল এ আর ক'জন বেঁচে আছেন, কে জানে! কে জানে মুজিব হৃদয়ের উষ্ণতা অনুভব করা আর ক'জন কোথায় কিভাবে আছেন! আমরা জানি না, স্বার্থপর প্রজন্ম খুব কমই খবর রাখে এসবের। বিদায় বেলায় আজিজুর রহমান যে গৌরব, যে অহংকার সাথে নিয়ে গেলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল 'মুক্তিযোদ্ধা'র গৌরব। কিন্তু হায়! এ দেশটিকে হানাদার মুক্ত করতে তার অসীম সাহসিকতা, বীরত্ব, ত্যাগের কথা আমরা ক'জন জেনেছি অথবা জেনে হৃদয়ে ধারণ করেছি! এদেশে কী আর কেউ কখনো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবেন?
দেশকে হৃদয়ে বহন করে আজিজুর রহমান তিলে তিলে হয়ে উঠেছিলেন এক মহীরুহ। তার মৃত্যু তাই এক নক্ষত্রেরই পতন। ক্ষমতার উন্মাদনা, ভোগবাদসহ যে অবক্ষয় চলছে আমাদের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে, আজিজুর রহমান ছিলেন তার বিপরীত স্রোতের। মানুষের মঙ্গলকামনা ছাড়া তার আর কোনো উপাসনা ছিল না। মহান জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন, আওয়ামী রাজনীতির কেন্দ্রে ছিলেন তবুও ক্ষমতার দম্ভ প্রত্যক্ষ করেনি কেউ তার কখনো। বিভেদের রাজনীতি করেননি। সকল মতের মানুষের জন্য তার দুয়ার খোলা ছিল সর্বক্ষণ।
বিজ্ঞাপন
আজিজুর রহমান এর মৃত্যু তাই নানাভাবে আমাদের ভেতর শূন্যতার জন্ম দিয়ে যায়। আর্দশিক রাজনীতির এ প্রবাদ পুরুষের স্থান কখনো পূরণ হবার নয়। মনু জলের কল্লোলে বেড়ে উঠা যে জীবন কেটেছে গণমানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সংগ্রামে সে জীবনকে পরবর্তী প্রজন্মের ধারণ করা অতো সহজ নয়। যে মূল্যবোধ নিয়ে আজিজুর রহমান আমৃত্যু অটল ছিলেন সে বিশ্বাস আর বোধের গভীরে পৌছাতে না পারলে দূর্ভাগা হয়ে থাকব আমরা। মানুষকে আপন করে নেয়ার যে ক্ষমতা তার ছিল, বুকের গভীরে সদা প্রজ্জ্বল ছিল যে অসাম্প্রদায়িকতা আর শোষণ মুক্তির প্রদীপ, সে দীপের পাদপদ্মে নিজেদের সমর্পিত করতে না পারলে বৃথাই যাবে সমস্থ ফেসবুকীয় উহআহ।
সবার যাওয়া এক রকম হয় না। জীবন সবাইকে সবকিছু দেয়ও না। এক জীবনে আজিজুর রহমান সমাজকে যা দিয়েছেন তার সবকিছু সাদা চোখে দেখা যাবে না। সব ছবি উঠে আসবে না ডিজিটাল পর্দায়। সব কথা বলাও হবে না কখনো। তাদের মতো যারা চলে যান, তাদের কোনো প্রত্যাশা থাকে না কারো কাছে; বরং যারা টিকে থাকতে চায় আজিজুর রহমানদের পদাংক অনুসরণ করে তাদেরকে পথ চলতে হয় নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে। তবেই জীবন পূর্ণতা পায়।
আমি এই বিশ্বাস করি যে, তিনি বেঁচে থাকবেন তার কর্মে। তার রেখে যাওয়া আর্দশের পথে হাটবেই মানুষ। এমন সোনার মানুষ যারা, তারা হারিয়ে যান না কখনো, আমাদের সংকটে-সংগ্রামে তারা পথ দেখিয়ে যান। আমরা যতোদিন বাঁঁচব, তাদের কাছে ঋণী হয়েই বাঁঁচবো।
প্রণবকান্তি দেব: কবি, শিক্ষক, সংগঠক।