Sylhet Today 24 PRINT

রাজনীতির শুদ্ধপুরুষ আজিজুর রহমান

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা  |  ১৯ আগস্ট, ২০২০

"যে আছে মাটির কাছাকাছি, সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি"। তিনি ছিলেন একজন মাটির কাছে থাকা রাজনীতিবিদ। মৃত্তিকাশ্রয়ী জননেতা। রাজনীতির ভূমিপুত্র আজিজুর রহমান চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন নিজ গ্রামে। মৌলভীবাজারের চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের গুজারাই গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে। চিরসখা মনু নদীর উপর দিয়ে তাঁর মরদেহ যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শেষ গন্তব্যে। তা অবলোকন করছিলাম। শেষ শ্রদ্ধায় অংশ নিলাম নিজের মতো করে। জননেতা আজিজুর রহমান মনুপাড়ের এক সংবেদনশীল মানুষ। মাটির মমতা আর নদীর সরলতা তাঁর চরিত্রকে করেছে পরিশুদ্ধ।

তিনি প্রকৃতার্থে ছিলেন রাজনীতির এক শুদ্ধ পুরুষ। ছাত্র জীবনেই প্রগতিশীল রাজনীতির পাঠ নেন, যৌবনে লড়াই আর সংগ্রামের পথ বেছে নেন , পরিণত বয়সে ছিলেন জনহিতে নিবেদিত। আজীবন সংগ্রামী, আপাদমস্তক জননেতা আজিজুর রহমান রেখে গেছেন এক অমলিন আদর্শ। রাজনীতিকে ব্রত হিসেবে ধ্যান জ্ঞান করে তাঁর চারপাশকে করেছেন আলোকিত। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন মানবতার কল্যাণে। বড় অসময়ে চলে গেলেন পরিচ্ছন্ন এই সজ্জন রাজনীতিবিদ ও জননায়ক। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস কেড়ে নিল এই কীর্তিমান রাজনীতিককে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের ভালোবাসা আর আকুতির কাছে তুচ্ছ হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি।

মৌলভীবাজারবাসী যথাযথ সম্মান আর আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বিদায় দিয়েছে তাদের প্রিয় নেতাকে। স্থানীয় রাজনীতির বরপুত্র আজিজুর রহমানের রাজসিক প্রস্থানে ফুটে উঠেছে অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাঁর মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে যায় মৌলভীবাজার শহরের দোকানপাট। শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন দলমত নির্বিশেষে হাজারো জনতা। জনতার নেতা আজিজুর রহমান বিদায় নিলেন জনতাকে কাঁদিয়ে। জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা।

আজিজুর রহমান ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩ সালে বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার গুজারাই গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল সত্তার এবং মাতা কাঞ্চন বিবি। শ্রীনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক, মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে মাধ্যমিক ও মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে বি.কম. ডিগ্রী অর্জন করেন।

মনু নদী প্রতিদিন পাড়ি দিয়ে লুঙ্গি,পাঞ্জাবি পরিহিত এই গ্রামীণ মানুষটি শহরে যেতেন। শহরের অলি,গলি কে কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ করে হয়ে উঠেছিলেন সর্বজনীন জননেতায়। মুক্তিসংগ্রামে যেমন নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তেমনি এলাকার উন্নয়ন, অগ্রগতিতে রেখেছেন অসামান্য ভূমিকা। দলঅন্তপ্রাণ এই মানুষটি ছিলেন দুর্দিনের প্রতিনিধি, সুদিনের পরামর্শক। কর্মী গড়ার কারিগর এই মহৎ মানুষটির কাছে রাজনীতি ছিল আরাধনা, দল ছিল পরিবার,রাজপথ ছিল সংসার। বিশাল হৃদয়ের এই ক্ষণজন্মা পুরুষ, কর্মীকে নেতায় রূপান্তরিত করেছেন। নিজের আসনে নিবিড় পরিচর্যায় বসিয়েছেন কর্মীদের। উপযুক্ত কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে এগিয়ে দিয়েছেন জনসেবায়। এমন আদর্শিক অভিভাবক সত্যিই বিরল।

সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা আর দায়বদ্ধতার অভিনব মিশেল রাজনীতিতে এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। আদর্শিক রাজনীতির বাতিঘর, আজিজুর রহমান ছিলেন একজন কর্মীবান্ধব নেতা, জনবান্ধব অভিভাবক ও পরিশীলিত জনসেবক।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীনতার পর থেকেই একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। কিন্তু কখনো প্রভাব প্রতিপত্তি আর অনৈতিক সুবিধার জন্য রাজনীতিকে ব্যবহার করেননি। দলকে কলুষিত করেননি। কলুষতামুক্ত একজন নির্ভেজাল আওয়ামী লীগার ছিলেন তিনি। তাঁর যোগ্যতা, দক্ষতা, জনপ্রিয়তা আর দূরদর্শিতায় তিনি পেয়েছিলেন বিভিন্ন স্বীকৃতি। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তিনি গ্রেপ্তার হন। তালা ভেঙ্গে সিলেট কারাগার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে মুক্ত করেন। পাকবাহিনীর মৌলভীবাজার আক্রমণের পর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির আহ্বানে পশ্চিমবঙ্গের বাগডুগায় (দার্জিলিং) পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগদান করেন। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ৪ নম্বর সেক্টরের রাজনৈতিক কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মৌলভীবাজার মহকুমা কে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের কঠিন দুঃসময়ে তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপির প্রভাবশালী নেতা, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে পরাজিত করে সারাদেশে আলোচনায় আসেন। ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত চীফ হুইপের দায়িত্বও পালন করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মৌলভীবাজার জেলা শাখায় একাধিকবার সাধারণ সম্পাদক ও একাধিকবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পরবর্তীতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে নিজ নির্বাচনী এলাকায় তিন সহকর্মীকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা সর্বত্র ত্যাগী কর্মীদের নির্বাচিত করতে পালন করতেন কাণ্ডারির ভূমিকা। বিশেষণে নয় কর্মক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সত্যিকারের অভিভাবক।

২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে মনোনীত হন। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সরকারি গাড়ি তিনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন না। রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন গোটা শহর। দলমত নির্বিশেষে যে কেউ এই নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদের কাছে গিয়ে আত্মতৃপ্তি পেতেন।

বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাক্ষর দানকারী প্রবীণ এই আদর্শবান মানুষটির সারাটি জীবন জনকল্যাণে নিবেদিত। সম্প্রতি নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকাল ভোররাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর চিরপ্রস্থানে বৃহত্তর সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে গভীর শূন্যতা।তিনি সংসার করেননি। রেখে যাননি কোনো রক্তের উত্তরাধিকার। কিন্তু তাঁর আদর্শিক উত্তরাধিকারীরা, আদর্শিক সন্তানেরা আজ চোখের জলে ভাসছে নীরবে, নিবৃতে। রাজনীতিতে এমন বিশুদ্ধ মানুষের বড় অভাব।কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা যেন এই জনদরদী রাজনীতিবিদকে শান্তিতে রাখেন। বিনম্র শ্রদ্ধা।

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা : সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.