Sylhet Today 24 PRINT

গ্রাফিতি নিষিদ্ধের দাবি : ভাবনার প্রকাশ কোন সমাজ বন্ধ করতে চায়?

আব্দুল করিম কিম |  ০২ অক্টোবর, ২০২০

গ্রাফিতি আঁকা বন্ধে আইন পাশের আহবান জানিয়েছেন প্রবাসী একজন কবি।
তিনি মনে করেন, অন্যের বাড়ি কিংবা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে সৌন্দর্য নষ্টের অধিকার কারো নেই।
খুব ভালো কথা। অন্যের বাড়ি বা দেয়ালে বিনা অনুমতিতে গ্রাফিতি এঁকে সৌন্দর্য্য নষ্ট করার কারনে যদি গ্রাফিতি নিষিদ্ধ হয়, তবে একই কারনে কারো বাড়ি কিংবা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে চিকা মারা, পোষ্টার লাগানো ও হাল-জামানার নেতা বন্দনার প্যানোফ্ল্যাক্স ফেস্টুন বসানো বন্ধের দাবিও তুলতে হবে। প্রবাসী কবি সেই দাবি না তুলেই সরাসরি গ্রাফিতি নিষিদ্ধে চলে গেছেন! বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তার এমন চাওয়া দেখে তাকে কেউ রাজকবির তকমা দিলেও দিতে পারেন। কারণ রাজার চাওয়ার সাথে ছন্দ মিলিয়ে কাব্য লেখাইতো রাজকবির কাজ। তার এমন চাওয়াটা তিনি প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে তৎক্ষণাৎ অনেকেই প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন তীর্যক ভাষায়।

প্রবাসী কবি যদি গ্রাফিতির সাথে, চিকা মারা, পোষ্টার সাঁটানো, ফেস্টুন ঝুলানো নিষিদ্ধ করার দাবি তুলতেন, তবে তার দাবিকে জনস্বার্থে একজন কবির নিঃস্বার্থ দাবি ভাবতাম। কিন্তু তিনি সেই দাবি তুলেননি। সরাসরি গ্রাফিতি আঁকা বন্ধে আইন পাশের আহবান জানিয়েছেন। গ্রাফিতিকে তার এতো ভয় কেন? গ্রাফিতি কি মানুষকে আন্দোলিত করে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পূর্বে গ্রাফিতি সম্পর্কে কিছু কথা সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরছি-

গ্রাফিতি কি?

গ্রাফিতি হল জনসাধারণের অভিমতকে শৈল্পিক উপায়ে দেয়ালের উপরে লেখা বা আঁকা। স্প্রে পেইন্ট বা মার্কার পেন বা কয়লা দিয়েও গ্রাফিতি তৈরি হতে পারে। গ্রাফিতি একটি বিতর্কিত বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রাফিতি বিনা অনুমতিতে আঁকা হয়। তাই অনেক দেশে গ্রাফিতিকে বিকৃত ও ধ্বংসাত্মক শিল্প হিসেবে গণ্য করা হয় কারণ অনেক সময় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের সক্রিয়তা গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রচার করে।

কলকাতার ব্যতিক্রমধর্মী প্রকাশনা সংস্থা- মনফকিরা থেকে প্রকাশিত বীরেন দাশ শর্মার 'গ্রাফিতি এক অবৈধ শিল্প' গ্রন্থে লেখক গ্রাফিতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন "এক অর্থে গ্রাফিতি সাহিত্য না হয়েও লেখার শিল্প, চিত্রকলা না হয়েও অঙ্কনশিল্প।"

ইটালিয়ান শব্দ 'Grafitiato' থেকে এসেছে 'গ্রাফিতি' যার অর্থ 'খচিত'। গ্রাফিতিকে বলা হয় কাউন্টার কালচার, অর্থাৎ যা গতানুগতিক সংস্কৃতির বিপরীত। যে শিল্পকর্মটি প্রচলিত রীতি-নীতি-সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে একধরনের শিল্প বিপ্লব গড়ে তোলে, তাকে গ্রাফিতি বলে। এর উপাদান মূলত সমাজের অবক্ষয়, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, রাজনৈতিক অরাজকতা বা স্বেচ্ছাচারতন্ত্র ইত্যাদি। গ্রাফিতিতে উঠে আসে সমাজের সমসাময়িক বিশৃঙ্খলার এক ব্যাঙ্গাত্মক রূপ, যা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কোন অব্যবস্থায় বাস করছো তুমি, কী তোমার পরিণতি, কীসে তোমার পরিত্রাণ। স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাভাবনা প্রকাশের মাধ্যম গ্রাফিতি। তাই এই স্বতোজাত ভাবনা প্রকাশের স্থান দেয়াল। বিশ্বের সকল দেয়াল একজন গ্রাফিতি শিল্পীর জন্য উন্মুক্ত ক্যানভাস। তাই বিভিন্ন দেশের দেয়ালে আমরা দেখতে পাই প্রতিবাদ, মুক্তচিন্তা, দেখতে পাই সেই দেশের প্রকৃত দৃশ্য একজন গ্রাফিতি শিল্পী বা গেরিলা শিল্পীদের চিত্রকল্পের মাধ্যমে। ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল ফ্রান্সে, আটষট্টির ছাত্র বিপ্লবে।

১৯৬৮ সালের মে মাসে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে, তাদের সঙ্গে ফরাসি শ্রমিকরাও যোগ দিয়ে নতুন মাত্রা দেয় বিপ্লবের। পুঁজিবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তরুণরা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে উঠেপড়ে লাগে। তারা স্বপ্ন দেখতো রক্ষণশীল ভাবধারা ও কড়া নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার, স্বপ্ন  দেখতো বৈষম্যহীন সমাজের, স্বপ্ন দেখতো সাম্যাবস্থা ফিরে পাওয়ার। অসংখ্য প্রাণ যায়, অসামান্য ক্ষতিগ্রস্ততা, গ্রেপ্তারকৃত ছাত্র-শ্রমিক রাত-দিন এক করে আন্দোলন করে যায়। শুধু মুখের ভাষাকে পুঁজি করে নয়, তারা হাতিয়ার করে দেয়ালচিত্র এবং দেয়াললিপিকে। লেখনী ও আঁকিয়েদের ধার মনে দাগ কাটে গোটা বিশ্ববাসীর। সর্বস্তরের মানুষের একতা পরিবর্তন আনে। ছোট ছোট বিষয়ে জয়ী হতে শুরু করে তারা। এরপর একসময় সরকারের পতন হয়। সেদিনের ছাত্র আন্দোলনের সফলতার ছায়া পড়েছিল দুনিয়া জুড়েই।

প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গ্রাফিতি বিপ্লবে দ্বিগুণ মাত্রা যোগ করে। এরকম দৃষ্টান্ত দেখা গেছে বহু সময়ে বহু দেশে। ভারতে দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের 'হোক কলরব’ আন্দোলন, ব্রাজিলের ক্ষুধার্ত শিশুর দেয়ালচিত্র, অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন, ইসরায়েল-সিরিয়ার যুদ্ধসহ আরও অনেক অস্থিরতার সময়গুলোতে ছিল গ্রাফিতির জয়জয়কার। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বিরোধী লড়াইয়ে "Black Lives Matter" ও "I can't breathe" শীর্ষক অসংখ্য গ্রাফিতি আমেরিকার দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হয় প্রতিবাদের অংশ হিসাবে।

প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সারা পৃথিবীতেই গ্রাফিতি নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের কাছে সমাদৃত হচ্ছে। তাই দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকা বড় থেকে ছোট বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদে সুস্থধারার আন্দোলনের একটি স্বীকৃত পদ্ধতি হিসাবেই মনে করেন প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার মানুষেরা। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলেরা গ্রাফিতিকে ভয় পায়। গ্রাফিতিতে শিল্পবোধ থাকে। চিন্তার খোঁড়াক থাকে।

গ্রাফিতির ইতিহাস :
রোম ও পম্পেই নগরীর সমাধিস্থলের দেয়াল ও ধ্বংসাবশেষে গ্রাফিতির অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। দক্ষিণ সিরিয়া, পূর্ব জর্ডান এবং উত্তর সৌদি আরবে শিলা ও পাথরের উপরে কিছু লেখা পাওয়া গিয়েছে স্যাফাইটিক ভাষায় এবং ধারণা করা হয় এই স্যাফাইটিক ভাষার উৎপত্তি গ্রাফিতি থেকে।

প্রাচীন গ্রীক নগরী এফেসাসেই আধুনিক গ্রাফিতির উদ্ভব এবং সেখানে গ্রাফিতি পতিতাবৃত্তির বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হত। বর্তমান সমাজের চেয়ে প্রাচীন সমাজের গ্রাফিতিগুলো আরো বেশি অর্থপূর্ণ এবং ভিন্ন ভিন্ন ধারায় বহমান ছিল। প্রাচীন গ্রাফিতিগুলো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটাতো। ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুত্পাতের সময়কার গ্রাফিতিগুলো পম্পেই নগরীতে সংরক্ষিত ছিল। নভেলিয়া প্রিমিগেনিয়া নামের এক পরমা সুন্দরী পতিতার ব্যাপারে জানা যায় গ্রাফিতি থেকে।

সমসাময়িক গ্রাফিতি :
সমসাময়িক গ্রাফিতি মূলত হিপহপ দ্বারা প্রভাবিত এবং অসংখ্য গ্রাফিতির উদ্ভব ফিলাডেলফিয়া এবং নিউ ইয়র্ক শহরের সুড়ংগের গ্রাফিতি থেকে। এছাড়াও এখন শৌচাগার, সেতুতেও গ্রাফিতির কাজ পরিলক্ষিত হয়। সবচেয়ে পুরাতন আধুনিক গ্রাফিতি হল "মনিকাস" যা ভবঘুরে এবং রেলশ্রমিকদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল। মনিকারসের উপর চলচ্চিত্র নির্মাতা বিল ড্যানিয়েল ২০০৫ সালে "হু ইজ বোজো টেক্সিনো" নামের একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলেন।

এরোসল পেইন্টের আবিভার্ব :
গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাপটনকে নিয়ে তৈরি "ক্ল্যাপটন ইজ গড" হল বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত গ্রাফিতি। ১৯৬৭ সালে ক্ল্যাপটনের একজন ভক্ত স্প্রে দিয়ে ইসলিংটন স্টেশনের দেয়ালে এই গ্রাফিতিটি তৈরি করেন। ১৯৭০ সালে পাংক রকের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি তৈরি করা হয় এবং ব্ল্যাক ফ্লাগ ও ক্র্যাস ব্যান্ড তাদের নাম ও লোগো দিয়ে গ্রাফিতি করে এই পাংক রকের বিরুদ্ধে।

স্টেনসিল গ্রাফিতির উদ্ভব :
১৯৮১ সালে ব্লেক লে রেট প্যারিসে প্রথম স্টেনসিল গ্রাফিতির প্রচলন করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে নিউ ইয়র্ক, মেলবোর্ন এবং সিডনিতে স্টেনসিল গ্রাফিতির কাজ পরিলক্ষিত হয়।

স্মারক হিসেবে গ্রাফিতি :
মানুষ প্রায়ই তাদের শেষচিহ্ন কংক্রিট দিয়ে বাঁধাই করে। এই ধরনের গ্রাফিতি দম্প্ত্তিদের ভালোবাসার ও কোন একজন মানুষের বিশেষ সময়ের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে তৈরি করা হয়।

বাংলাদেশে গ্রাফিতি :
বাংলাদেশে গ্রাফিতি আঁকার ইতিহাসতো- এই সেদিনের। নব্বইয়ের দশকে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় এলাকায় ‘কষ্টে আছি—আইজুদ্দিন' ও পরের দশকে — ‘অপেক্ষায়...নাজির’ লেখাকে বাংলাদেশে গ্রাফিতি লেখার সূচনা ধরা হলেও প্রকৃত গ্রাফিতি হচ্ছে 'সুবোধ'।

রাজধানীর আগারগাঁও এবং মিরপুরের কয়েকটি দেয়ালে ‘সুবোধ’-এর গ্রাফিতি বাংলাদেশের প্রথম উদ্দেশ্যমূলক গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র। যা দেখে মানুষ থমকে যায়। এই গ্রাফিতির একমাত্র চরিত্র ‘সুবোধ’। এসব গ্রাফিতিতে

লেখা:
‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না।’
‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে।’
‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই’।
‘সুবোধ এখন জেলে, পাপবোধ নিশ্চিন্তে বাস করছে মানুষের মনে’
'সুবোধ, কবে হবে ভোর?'
'সুবোধ তুই ঘুরে দাঁড়া'

এই গ্রাফিতি দেখে মানুষের চিন্তা জগত তাড়িত হয়। ভাবতে ভুলে যাওয়া মানুষ ভাবে, সুবোধ কে?
সুবোধ কি সে নিজেই? তাঁকে কি পালিয়ে যেতে বলছে কেউ?  তাঁকে কেউ ভালোবাসে না-- সে কথাই মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে?

‘সুবোধ’-এর এই দেয়ালচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে অনেকেই সুবোধ এবং এর আঁকিয়ে কিংবা আঁকিয়েদের পরিচয় জানতে কৌতূহলী হয়েছেন। কিন্তু গ্রাফিতি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েনি। এর কারণ হয়তো গ্রাফিতি শিল্পীর অভাব অথবা দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকার অনুমতি পাওয়া যায় না। মালিকপক্ষ আপত্তি জানায়। তবে গ্রাফিতি আঁকাতে পুলিশী বাঁধার কথা ইতিপূর্বে শোনা না গেলেও সম্প্রতি ধর্ষণের প্রতিবাদে রাজধানীর বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকার সময় ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতাকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। ভিডিও চিত্রে দেখা যায় তুলে নেওয়ার সময় পুলিশ অত্যন্ত অসম্মানজনক আচরণ করছে। থানায় নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে। শরীরে সেই চিহ্ন রয়ে গেছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে  ধর্ষণের প্রতিবাদ জানানো যাবে না? গ্রাফিতি আঁকা যাবে না?

গ্রাফিতি শিল্পীদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া রমনা থানার পেটমোটা পুলিশ কর্মকর্তার সাথে সুর মিলিয়ে কবি পরিচয়ে পরিচিত কেউ যখন গ্রাফিতি নিষিদ্ধের দাবি তোলেন তখন ভাবতে হয়- ভাবনার প্রকাশ কোন সমাজ বন্ধ করতে চায়?

আব্দুল করিম কিম : নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.