Sylhet Today 24 PRINT

রবির রশ্মির মতো তেজোদীপ্ত পুরুষ বজলুর মজিদ খসরু

সুশান্ত দাস  |  ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। পৃথিবী তার নিজ অক্ষে সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। এতো লক্ষ লক্ষ মাইল দূর থেকেও সামান্য তাপ বিকিরণের সময়ে তেজেদীপ্ততার জন্য তার দিকে তাকানো যায় না। সাহস দেখানোটাও এক বড় চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার।

আমি যে জায়গা থেকে এখন লিখছি এটা হলো পশ্চিমা বিশ্বের প্রাচীন একটি শহর। শীত গ্রীষ্মের ব্যবধানে একঘণ্টার তারতম্য হলেও মূল সময়ের পার্থক্য ৬/৭ ঘণ্টা বাংলাদেশের সাথে। এখানে মধ্যরাত ১টা হলে পূর্ববিশ্বের বাংলায় হচ্ছে সকাল ৬টা। সূর্য উঠবে। আলোকিত হবে। কিচির মিচির পাখির কলকাকলিতে প্রকৃতিও জেগে উঠবে। সূর্য ছড়াবে তার আলো। তেজোদীপ্তময় হয়ে উঠবে সারা বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বকোণে হচ্ছে সুনামগঞ্জ। এই সুনামগঞ্জের সূর্য সন্তান রবি রশ্মির মতো তেজোদৃপ্ত হচ্ছেন অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ খসরু। যার জন্ম ১৯৫২সালের ২এপ্রিল হতে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদিন পর্যন্ত চোখ রাখলে নখে-দর্পণে উঠে আসে রবিরশ্মির মতো তেজোদৃপ্ত তার কর্মযজ্ঞ।

১৯৭১ সালে তরুণ বয়সে দেশ মুক্তির সৈনিক হিসাবে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে ১৯৬৯ সাল হতে কলম সৈনিক (যুগভেরী), নীল পতাকার ছায়া তলে ছাত্র রাজনীতি, বিজ্ঞান মাধ্যমে পড়াশুনা থেকে আইন বিষয়ে পড়াশুনা। পড়াশুনা শেষে আইন পেশাকে বেঁচে নিলেও কাগজ-কলমের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি আমৃত্যু পর্যন্ত। আর তাইতো নবীন প্রজন্ম, মধ্য প্রজন্ম হতে প্রবীণ প্রজন্ম পর্যন্ত, দীর্ঘ কাগজ-কলমের সম্পর্কে বার বার স্মৃতি তর্পণ করছেন। বহুল প্রচারিত দৈনিক সুনামকন্ঠের সম্পাদক বিজন সেন রায়, জ্যেষ্ঠ লেখক কুমার সৌরভসহ আরও অনেকেই শ্রদ্ধার সহিত স্মৃতিচারণ করছেন বারবার। দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর হতে স্থানীয় সবকটি পত্রিকা সহ খ্যাতিমান জাতীয় দৈনিকেও তাকে নিয়ে হচ্ছে বিভিন্ন ফিচার।

জীবনের কিছুটা সময় দেশের বাইরে কাটালেও আশির দশকে প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হন। সুনামগঞ্জ মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত হওয়ার প্রথম দিন থেকেই তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সুনাম। ১৯৮৯ সালে ‘৭১-এর সুনামগঞ্জ’ সম্পাদনা করেন। গঠন থেকে দায়িত্ব বহন করেছেন মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ট্রাস্ট, ক্যাপ্টেন হেলাল শিক্ষা ট্রাস্টের সম্পাদক হিসাবে।

শুধু কি তাই?- নিশ্চয় নয়! মা-মাটি ও হাওরবাসির টানে ২০১৭ সালে গড়ে উঠা ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনে ছিলেন অগ্রদূত। বানভাসি গণমানুষের গণকন্ঠে তুলেছিলেন লুটতরাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। রাজনীতির বাইরে থেকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন হাওর বাঁচাও আন্দোলন।

আরও দেখা যায় করোনা মহামারি বিশ্ব যখন শেখায় মানুষ হতে দূরে থাকতে তখনো এই তেজোদৃপ্ত মানুষটি সুনামগঞ্জের নবীন-প্রবীণদের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন “অসহায়ের পাশে আমরা সুনামগঞ্জ”। দাঁড়িয়েছেন উজ্জ্বল ভাই (প্রথম আলো) উল্লেখিত সেই যাত্রা অভিনয়ের ‘বিবেকের’ ভূমিকায়।

লিখতে বিব্রত লাগলেও সেদিন আমাকে পরম স্নেহে, গ্রুপে তুলে ধরেছিলেন দু-একটি লাইনের মাধ্যমে - “আদর্শবাদী পিতার সন্তান আমাদের সুশান্ত। শ্রীকান্ত দাকে নিয়ে একটা স্মারকগ্রন্থ করছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ। সুশান্তের সাথে আমার পরিচয় বেশি দিনের নয়। বিগত জানুয়ারিতে আমেরিকা থাকার সময় থেকে। ভাল কাজে তার আগ্রহ দেখে আমি অভিভূত। আজকে অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়ে শ্রীকান্ত দাকে আরও সম্মানিত করল। ধন্যবাদ সুশান্ত” - (অ্যাড: বজলুল মজিদ খসরু, আমরা অসহায়ের পাশে সুনামগঞ্জ, ১৭ এপ্রিল ২০২০)।

আজ সব স্মৃতি। বারবার বলতে ইচ্ছে করছে- আংকেল, শেষ প্রয়োজনটাও শেষ করতে দিলেন না।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ক্লান্ত পৃথিবী একটু বিশ্রামের জন্য ঘুমন্ত ভাবাবেগে সূর্যকে আড়ালে ধাবমান; ঠিক ঐ সুযোগে আমাদের সূর্যসন্তানও আমাদের হতে, হয়ে গেলো চিরতরে বিদায়।

এই সূর্য সন্তানের চিরতরে বিদায়ের খবর যখন পূবের আকাশ ধেয়ে পশ্চিমা আকাশে পৌঁছায় তখন দেখি নদী সুরমা, সাগর বঙ্গোপসাগর পাড়ি জমিয়ে মহাসাগর আটলান্টিকের উত্তাল ঢেউকেও গ্রাহ্য না করে শোকের ঢেউয়ে হৃদয় কোনায় কম্পন হচ্ছে। চোখের কোনায় চলে আসে ফোটা ফোটা জল। ইন্টারনেটের পাতা খুলতেই দেখি সুনামগঞ্জের উপর দিয়ে যাচ্ছে শোকের ঢেউ।

সাংবাদিক শামস শামীমের পোস্ট পেয়েও অবিশ্বাসের জ্বালায় ফোন না দিয়ে বিভিন্ন জনদের ইনবক্সে দিতে থাকি ম্যাসেজ। এরই মাঝে প্রতিউত্তরে দিয়ে থাকেন শ্রদ্ধাস্পদ দাদা লেখক কল্লোল তালুকদার। শরীর কম্পনে হাতের চায়ের পেয়ালা রেখে দেই। কি যেন এক অস্থিরতা। বাইরে করোনার থাবা তবুও প্যান্ট পড়ে এই অস্থিরতাকে কাটিয়ে উঠতে হাঁটতে যাই।

হঠাৎ শুনতে পাই মেসেঞ্জারে কলিং টোন। দেখি কানাডা হতে তাজুল কাকু (মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ)। কানাডার সাত-সকালে ভারিকন্ঠে বলছেন তোমার ফেসবুকে “খসরু ভাই চলে যাওয়া সম্পর্কে খবর দেখলাম। আমি সুনামগঞ্জে কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। উনি তো এই মুহূর্তে এখন এই ভাবে যাওয়ার কথা না, আমার সাথে তো গত কিছুদিন যাবত কন্টিনিউয়াসলি যোগাযোগ হচ্ছে”।

আমিও বললাম- হ্যাঁ কাকু, আমিও তেমন কিছু জানি না যদিও। ইদানীং কিছুদিন যাবত আমি যোগাযোগ করতে পারিনি।

রবির মতো তেজোদৃপ্ত মানুষটির সাথে পরিচিতির বাঁধন বেশী দিনের নয়। তবে গাঢ়ত্বটা ছিল অনেক। সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীকে হারানোর পর ভাটির জনপদ শাল্লার ৭১-র প্রেক্ষাপট জানতে দিতে হয়েছে সময় অসময়ে কল। অপত্যস্নেহে ছিল তার ভরপুর কন্ঠ।

তখন তিনি ছিলেন ছেলে দীপের বাসায় আমেরিকায় ভ্রমণরত। বাংলাদেশ হতে আমেরিকার সময় প্রায় ১২ ঘণ্টার ব্যবধান হলেও ব্রিটেন থেকে এর ব্যবধান প্রায় অর্ধেক। দেশের তুলনায় ছিলেন অনেকটাই ফ্রি। সেই সুবাদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার সুযোগ হয়েছে।

অনেক জায়গায় বেড়ানোর বা ঘুরতে সময় হলে বলতেন তুমি ফ্রি থাকলে পরে আবার কল দিও, আমি ফ্রি হয়ে যাব। দেখতাম নাতি-নাতনি, পরিবার পরিজন নিয়ে হাস্যজ্জল ছবি পোস্ট করতেন ফেসবুকে।

এর আগে সুনামগঞ্জের আরেক নাট্য নির্মাতা তুহিন ভাই পাঠান উনার ‘রক্তাক্ত-৭১’এর একটি পাতা। যেখানে শরণার্থী শিবিরের বিশেষ প্রেক্ষাপট নিয়ে কমরেড শ্রীকান্ত দাশের বর্ণনা। আমি তুহিন ভাইয়ের পাঠানো নমুনা দেখে কিছুটা অবাক হলাম। অবাক বললাম এই কারণে কমরেড শ্রীকান্ত দাশের পারিবারের সদস্যদের কাছে এই ঘটনা জানা থাকলেও বাইরে যে এই ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে তখনো জানা ছিল না। এ বিষয়ে খসরু আংকেলকে জিজ্ঞেস করতেই উনি গর গর করে স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন- 'আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়েছি। এখানে বিশদ ভাবে কিছু লেখা হয়নি। তবে পরবর্তীতে বিশদ ভাবে লিখব।' কথা হয়েছিল শরণার্থী শিবিরের কাহিনী নিয়ে আংশিক লিখলেও এই লেখাকে ধরে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ প্রণীত “শিল্পী সংগ্রামী কমরেড শ্রীকান্ত দাশ” বইয়ে লিখবেন বিশদ ভাবে।

আরও বললেন মুক্তিযুদ্ধ মূল ১১টি সেক্টরে বিভক্ত হলেও এর মাঝে বিভিন্ন সাব-সেক্টর সহ নানা গ্রুপ-উপগ্রুপ দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন কাজ করেছে বিভিন্ন অঞ্চলে; তেমনি স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকাররাও কাজ করেছে বিভিন্ন দলে-উপদলে। বললেন, আমার ঠিক এই মুহূর্তে মনে নেই তবে বইয়ে খুঁজলে দেখবো তোমাদের শাল্লা থানায় একমাত্র হবিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাড়া আটগাঁও ইউনিয়নে চেয়ারম্যান খালেক(দৌলতপুর), বাহারা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শরাফত(সুলতানপুর), শাল্লা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কালাই মিয়া চৌধুরী(মনুয়া)সহ আরও বেশ কয়েকজন শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। যারা রাজাকারদের চেয়ে ভয়ানক। আর রাজাকাররা ছিল তো অনেক। ছদ্মবেশী রাজাকাররা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ পরোক্ষ ভাবে করিয়ে থাকলেও কোন কোন রাজাকারা গৃহপালিত গরু, ঘরের ধানের গোলা থেকে ধান, বহুমূল্যবান কাঁসারি আসবাব পত্র, নগদ অর্থ লুট করেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল যুদ্ধবিধ্বস্ত শাল্লাতে প্রায় ৩০টিরও অধিক গ্রাম একেবারে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল পাকিপ্রেমী স্থানীয় ঐ রাজাকারা।

ভাটি অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিংবদন্তী সালেহ চৌধুরী সহ অসংখ্য লেখক অসংখ্য বই লিখেছেন। এর মাঝে অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ খসরু রচিত “রক্তাক্ত-৭১” বইটি ভিন্ন। অনেকে আখ্যা দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার লেখা ‘রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ’ বইকে জেলায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের একটি প্রামাণ্য দলিল। যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চর্চা করছেন, বিশেষ করে তরুণ গবেষক বা গণমাধ্যম কর্মী, তাদের কাছে ইতিহাসের বড় উপাদান বইটি।

তিনি সেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষনাণাধর্মী লেখক যিনি যুদ্ধের সময়ে এক হাতে যেমন যুদ্ধ করেছিলেন আরেক হাতে তেমনি কলমও ধরেছিলেন। স্বচক্ষে দেখে যেমন ভাবে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন তেমনি ভাবে শত্রুদের চিহ্নিত করে বিভিন্ন মাধ্যম হতে লিপিবদ্ধও করেছেন। যা সাহসিকতা ও নৈতিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। কথার ফাঁকে বলতেন অনুকূলের মাঝেও প্রতিকূলে বাস।

তিনি মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতার পর জাতির পুনর্গঠন হতে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা,আইন সেবা দিয়ে তার বহুমুখী প্রতিভায় যেমন সম্পৃক্ততা দেখিয়েছেন অনুরূপ ভাবে প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় তার তেজোদীপ্ততার রশ্মি ভঙ্গুর-লুটতরাজ সমাজকে ভেঙ্গে নতুন সাহসিকতার বাতিও জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। তার তেজোদীপ্তময় জীবন কর্ম, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কর্ম নব প্রজন্ম খুঁজবে বারবার। শারীরিকভাবে অদৃশ্য হলেও তার তেজোদীপ্ততায় গড়ে উঠবে নতুন প্রজন্ম।


সুশান্ত দাস : রাজনৈতিক ও সংস্কৃতি কর্মী।  

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.