Sylhet Today 24 PRINT

একা মেয়েটির বাড়ি ফেরা দিন

হাসান মােরশেদ |  ১৭ মে, ২০২১

১৭ মে ১৯৮১, যে বৃষ্টিস্নাত দিনে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসেন এর প্রায় পাঁচ বছর তিন মাস আগে ঘটে গেছে পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের একটি।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট ভোরে। দেশের বাইরে থাকার সুবাদে বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও তার একমাত্র বোন। এরপর থেকে তাদের উন্মুল প্রবাস যাপন, অসহনীয় বেদনার ভার নিয়ে।

সেই ভোরে যে কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছে তা নয়, প্রকৃত অর্থে সেই ভোরে হত্যা করে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে এবং এর সকল আদর্শ ও স্বপ্ন। সেদিনই রেডিওতে  পিপলস রিপাবলিক’কে  ঘোষণা করা হয়েছে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’- যদিও কুটনৈতিক চাপে এটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। পরবর্তী দিনগুলো প্রবল দুঃস্বপ্নের এই রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য। বর্বর সামরিক শাসন চেপে বসেছে, অবৈধভাবে সংবিধান কাঁটাছেড়া করে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুছে দেয়া হয়েছে, কারাগারে হত্যা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জাতীয় চার নেতাকে, অধ্যাদেশ জারি করে রদ করা হয়েছে ’৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ, মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয়েছে, আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের কারাবন্দি করে বিনা বিচারে নির্যাতন করা হয়েছে, দালাল আইন ও ধর্মীয় রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ’৭১ এর ঘাতক  দালালদের রাজনীতি ও সমাজে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।

জিয়াউর রহমানের অবৈধ সামরিক শাসন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির গতিধারা যেমন নষ্ট করেছে তেমনি সামাজিক মূল্যবোধের সব উপকরণ, শুভবোধের সকল সম্ভাবনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে এক প্রবল হতাশা বিরাজ করছিলো এই সামরিক ও সাম্প্রদায়িক দানবকে রুখতে না পারার ব্যর্থতায়। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক নিবেদিত প্রাণ কর্মী শোকে, ক্ষোভে উত্তাল থাকলেও নেতৃত্বহীনতায় তারা বিমুঢ় ছিলেন। একই অবস্থা ছিলো অন্য সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলোর। সামরিক শাসনের প্রশ্রয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ও আক্রমণে প্রগাঢ় অন্ধকার গ্রাস করছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজকে। ঠিক এই সময়ে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন।

৩৪ বছরের শেখ হাসিনা, শোকে  তখনো আচ্ছাদিত তবু ঋজু, তবু দৃঢ়। নিশ্চয় তিনি জানতেন, ফিরে আসার পর তার পথ পুস্প শোভিত নয়। সামরিক শাসকের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে সেই বৃষ্টিস্নাত দিনে বিমানবন্দরে অপেক্ষমান হাজারো শোকার্ত মানুষ নিশ্চয় তাকে সাহস জুগিয়েছিলো। এই মানুষগুলোর, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের কাছে ফিরে আসা ছাড়া তার কোন বিকল্প ছিলনা। এ কেবল রাজনৈতিক অঙ্গিকার নয়, আদর্শিক ও নৈতিক উত্তরাধিকারও বটে। শেখ মুজিবুর রহমান যখন বেঁচে নেই তখন মানুষের রাজনীতি, মানুষের জন্য রাজনীতির উজ্জ্বল শিখাটি তো শেখ হাসিনাকেই জ্বালিয়ে রাখতে হবে। এদিনটি তাই ব্যক্তি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনই শুধু নয়, হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের শেকড়ে ফেরারও যাত্রা শুরু।
ফিরে আসার পর কিছুই সহজ ছিলনা তার জন্য। আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশ্বস্ত বলে কথিত অনেকের বিশ্বাসঘাতকতা, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার অপচেষ্টা এসব মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন তিনি। সারা দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে।

শেখ হাসিনা ফিরে আসার ১৭ দিন পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান নিহত হন আরেক সামরিক অভ্যুত্থানে। নানা ঘটনা ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ। দীর্ঘ নয় বছর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। ১৯৯০ এ এরশাদ পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার পথ খুঁজে পায়। কিন্তু শেখ হাসিনার পথচলা কি ফুরোয়?

ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার ’৭১ এর শীর্ষ ঘাতক গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আহ্বানে ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে শেখ হাসিনাকে এই আন্দোলনের প্রধান শক্তিদাতা হয়ে উঠতে হয়। ঘাতক দালালদের বিচারের যে প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা করেছিলেন, ২০০৮ এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কাজ তিনি শুরু করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের আইনি  বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা, শেখ হাসিনাকে পৌঁছে দেয় অনন্য উচ্চতায়। এর আগে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল ’৭৫ এর খুনিদের নিয়মতান্ত্রিক বিচারের ব্যবস্থাও করেছেন তিনি।

তার শাসনামলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের অতুলনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে, বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সূচকে  বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায়। কভিড-১৯ এর এই বৈশ্বিক মহামারিতে নানা সীমাবদ্ধতা স্বত্বেও শেখ হাসিনা সামনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুর্যোগ মোকাবেলায়। তার সর্ব্বোচ্চ আন্তরিক প্রচেষ্টা রয়েছে যাতে প্রান্তিক মানুষেরা ভোগান্তির শিকার না হয়।

তবু শেখ হাসিনার পথচলা কিন্তু শেষ নয়, তার আত্মতৃপ্তির কোন সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার সহকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এদেশের মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার” প্রতিষ্ঠা করার।
১৯৮১ এর ১৭ মে হতাশার কাফন মোড়ানো বিবর্ণ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে শেখ হাসিনা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব। ১৯৮৮ তে চট্টগ্রামে পুলিশের গুলি, ২০০৪ এ গ্রেনেড হামলাসহ ১৯ বার হত্যা প্রচেষ্টা তাকে দমাতে পারেনি।

যার বক্ষে বেদনা অপার, বিধাতা তাকেই দিয়েছেন অলৌকিক আনন্দের ভার- মানুষের জন্য, মানুষের পাশে থাকার অসীম আনন্দ। শেখ হাসিনা এই আনন্দে থাকুন আজীবন।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহিত)
হাসান মোরশেদ: লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.