Sylhet Today 24 PRINT

শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা: অধ্যাপক বিজিতকুমার দে

মিহিরকান্তি চৌধুরী |  ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

এক কালে বিশেষ করে সত্তরের দশকের আগে সিলেট বিভাগে তো বটেই সকল উপজেলায়ও কলেজ ছিল না। সিলেট শহরে ছিল কয়েকটিমাত্র কলেজ। কলেজিয়েট স্কুলের ধারা এই অঞ্চলে তখনও শুরু হয়নি। ছিল মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট মহিলা কলেজ ও মদনমোহন কলেজ। ষাটের দশকে আইয়ুব খানের আমলে ১৯৬৪ সালে মুরারিচাঁদ কলেজ বা এমসি কলেজেকে সিলেট সরকারি কলেজ নামকরণ করে এই কলেজেরই পাশে এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৮৬ সালে শিক্ষাসচিব হেদায়েত আহমেদ মহোদয়ের উদ্যোগে মুরারিচাঁদ কলেজ তার পূর্ব নাম ফিরে পায় এবং এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ সিলেট সরকারি কলেজ নামে ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। মুরারিচাঁদ কলেজ ও এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের মতো সরকারি কলেজে সীমিতসংখ্যক আসন এবং সিলেট মহিলা কলেজে শুধু মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ ছিল। সমাজের অধিকসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর স্থান সংকুলান হতো ১৯৪০ সালে স্থাপিত সিলেটের লামাবাজার এলাকায় অবস্থিত মদনমোহন কলেজে। যোগেন্দ্রমোহন দাস ও মোহিনীমোহন দাস তাঁদের প্রয়াত পিতা মদনমোহন দাসের নামে ১৯৪০ সালে এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। অধ্যক্ষ প্রমোদচন্দ্র গোস্বামী থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ কৃষ্ণকুমার পালচৌধুরী, অধ্যক্ষ আতাউর রহমান পীর, অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, অধ্যক্ষ ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ সুশীল সমাজ, অভিভাবক মহল এবং সরকার ও তার প্রশাসনিক অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে কলেজকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন।

ইতোমধ্যে ২০১৬ সালে কলেজটি পচাত্তর বছরের স্মারক অনুষ্ঠান হীরকজয়ন্তী পালন করেছে যেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কলেজের নির্মাণে, প্রতিষ্ঠায় অধ্যক্ষ মহোদয়গণের, সুশীল সমাজের ভূমিকার কথা মূল্যায়ন হচ্ছে কিন্তু মূল্যায়ন হচ্ছে না শিক্ষকদের, ১৯৪০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সকল শিক্ষকই এই দলে পড়েন। এই কাতারে আরও পড়েন অধ্যাপক প্রমোদচন্দ্র গোস্বামী থেকে শুরু করে অধ্যাপক কৃষ্ণকুমার পালচৌধুরী, অধ্যাপক আতাউর রহমান পীর, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম চৌধুরী বা অধ্যাপক ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ। একটি খেলার দলে সেটা ফুটবল, ক্রিকেট বা হকি যাই হোক একজন দলনেতা প্রথমে খেলোয়াড়, তারপর নেতা। একটি কলেজেও একজন অধ্যক্ষ প্রথমে শিক্ষক, পরে প্রতিষ্ঠান প্রধান। এই মহীরুহ প্রতিষ্ঠানের আংসাঙ হিরো বা অমূল্যায়িত বীর, কৃতবিদ্য শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম এক নাম অধ্যাপক বিজিতকুমার দে।

অধ্যাপক বিজিতকুমার দে পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে মদনমোহন কলেজে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। ওই সময়ে তাঁর সমসাময়িক শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক সুষেন্দ্রকুমার পাল, অধ্যাপক প্রণবকুমার সিংহ, অধ্যাপক বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, অধ্যাপক মো. আকরাম আলী, অধ্যাপক আনসাফ হোসেন কোরেশি, অধ্যাপক নীলকান্ত দে,  অধ্যাপক  বিশ্বনাথ দে, অধ্যাপক ফজলুল হক, অধ্যাপক  গ.ক.ম. আলমগীর, অধ্যাপক প্রবীরকুমার সিংহসহ আরও কয়েকজন প্রতিভাধর শিক্ষককে।

সিনিয়রদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক কৃষ্ণকুমার পালচৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস শহীদ, অধ্যাপক আতাউল হক চেীধুরী প্রমুখ। যে সময়ে কলেজে যোগ দিয়েছেন, শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছেন তখন বেতনভাতাসহ আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা অত্যন্ত অপ্রতুল ছিল। পারিবারিক ফার্মেসি ব্যবসার সুনাম ছিল তবে আর্থিক বিবেচনায় এবং বিশেষ করে বড়ো একটি একান্নবর্তী পরিবারের ভার সামলানো একটি পরিবারের সার্বিক সংগতি শিক্ষকতার মতো একটা ঝুঁকিপূর্ণ পেশাকে তাঁর গ্রহণ করাকে বৈষয়িক ভাবনায় সমর্থন করে না। তারপরও তিনি সাহসী ছিলেন, প্রত্যয়ী ছিলেন, ছিলেন প্রগতিশীল ভাবনায় ভাস্বর এক সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্ব যিনি কালের পরিক্রমায় একজন কৃতী শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, আলোর দিশারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

একটি কলেজে বিশেষ করে ডিগ্রি কলেজে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকদের দাপট বা অথরিটি একটু বেশি কারণ বিভাগ নির্বিশেষে কলেজের সকল ছাত্রছাত্রীর সাথে তাঁদের রয়েছে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ। পাকিস্তান আমলে বা বাংলাদেশ আমলের প্রথম তিনচার বছর স্নাতক পর্যায়ে নকল ধরাটা সব শিক্ষককে দিয়ে হতো না। এজন্য বিশেষ কয়েকজন ছিলেন, বলা যেতে পারে কমান্ডেো বাহিনী। অধ্যাপক বিজিতকুমার দে ছিলেন এমন এক শিক্ষক যাঁর উপস্থিতিতে ছাত্ররা নকল করার ভাবনাকেও প্রশ্রয় দিত না। তাঁর কথাবার্তায় কী যে এক জাদু ছিল সেটা বুঝানো কঠিন। যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে গিয়েছেন শুধু তাঁরাই বোঝেন। সমাজে, কলেজে মিষ্টভাষী, কোমল মনের অধিকারী হলেও, চলাফেরা সহজ, সরল হলেও তার মধ্যে এক বিশেষ দৃঢ়তা ছিল, এককথায় যাকে বলে, ‘সফটস্পোকেন বাট ডমিনেটিং’। পানি তরল কিন্তু আজকাল পানি দিয়ে স্টিল কাটা হয়। সেরকমই এক বিষয়, সেরকমই ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা।  
 
অধ্যাপক বিজিতকুমার দে স্যারের পরিবারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক যেটা আমাদের অভিভূত করে তা হল, তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারের প্রকৃত দর্শনকে ধারণ করা। একান্নবর্তী পরিবারের মূল দর্শন হল ‘এক অন্ন (ভাতের ডেগ), এক মন’। কিন্তু আজকাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ‘এক ডেগ, বহু মন’ । এসকল পরিবারকে ডেগান্নবর্তী পরিবার বলাই শ্রেয়। আর বিজিত স্যারের পরিবারের বিশেষত্ব ছিল ‘এক ডেগ, এক মন’। কালের দাবি মেটাতে দেশেবিদেশে পরের প্রজন্মের সদস্যরা ছড়িয়ে আছেন তবে এখনও এক ডেগকেন্দ্রিক, এক মনকেন্দ্রিক। একান্নবর্তী পরিবার মানেই বড়ো পরিবার। বড়ো পরিবার মানেই বহু মত, বহু স্রোতের সমাহার, বহু বহুর সমাহার। কালের গতিতে ডেগের বিকেন্দ্রিকরণ হলে হতেও পারে। এখনও সবকিছু আদিরসে সিক্ত। বর্তমানে বিজিত স্যারের ভাতিজা দেবাশীষ দে বাসুদা একান্নবর্তী পরিবারের পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িক নানা বিষয়ের সমন্বয় সাধন করছেন। সমাজে একান্নবর্তী পরিবার ইতোমধ্যে এনড্যানজারড স্পেসিস। কিছু কিছু জায়গায় রাজনীতির ভাষায়, ‘লুজ কনফেডারেশান’ আর আরও কিছু জায়গায় এটা এক লাশ যার মধ্যে প্রাণ নেই জেনেও সংশ্লিষ্ট পরিবারের সকল এটাকে টানছেন।

পারিবারিক ফার্মেসি ব্যবসার সুনাম দীর্ঘদিন ধরে ধরে রাখতে তাঁরা সক্ষম হয়েছেন। তিনি তাঁর সব ভাইদের মধ্যে কনিষ্ঠ। তাঁর বড়ো ভাইদের মধ্যে বিনয়েন্দ্রকুমার দে, বিজেন্দ্রকুমার দে, বীরেশচন্দ্র দে ও বিমলেন্দু দে ফার্মেসি ব্যবসার দিকপাল। ঔষধের মান রক্ষায়ই হোক আর কোম্পানির বিল পরিশোধেই হোক তাঁরা অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। এক দেড় মাস মেয়াদ থাকা সত্বেও অনেক দামি ঔষধকে ঝুড়িতে ফেলে দিতে দেখেছি। তাঁদের আন্তরিক ভাবনা পরিবারটির নাম, তাঁদের বাসার নাম এনে দিয়েছে, ‘সেন্ট্রাল ফার্মেসি’। পারিবারিক বন্ধন তাঁদের খুবই দৃঢ়। ‘দাদা’ বলতে অজ্ঞান বিজিত স্যার। একই কথা আনুপাতিক হারে তাঁর বড়ো ভাইদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিরাশি চুরাশি বছরের ভাইও ছিয়াশি বছরের ভাইকে সমীহ করে কথা বলতেন। বাঙালি সমাজ, কৃষ্টি, ঐতিহ্যের আদিরস যাকে বলে। পরের প্রজন্মের তাঁর ভাতিজা-ভাতিজিরাও ‘ছোটোকাকা’ বলতে ভরসার বিশাল এক জায়গার ছবি দেখতে পারেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিভিত্তিক সারস্বত সমাজের সাথে তাঁর যোগাযোগই বেশি। তবে তিনি মাঝেমধ্যে ফার্মেসিতেও বসতেন। তাঁকে ফার্মেসিতে বসা দেখলে মনে হতো ‘সম্ভবত কঠিন কোনও পরিস্থিতিতে তাঁকে আসতে হয়েছে, হয়ত দায়িত্বশীল লোকের অভাবে বা উচ্চমার্গের ভিন্ন কোনও কারণে’।

এক সময় অধ্যাপক বিজিতকুমার দে স্যার, অধ্যাপক মাহবুব আহমেদ স্যার ও টয়োটা টু ডোর পাবলিকা ছিল সিলেটখ্যাত। যথাক্রমে সিলেট- ৩৭৫৩ ও সিলেট ৩৭৭৩ নাম্বারের কার। এগুলোকে অন্তত আধ মাইল দূর থেকে চিনতাম। পয়ত্রিশ, চল্লিশ বছর আগের কথা খুবই তরতাজা, টাটকা রয়েছে মনে। শহরে শত শত গাড়ির মধ্যে চার পাঁচটা গাড়ির রং, হর্ন এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কানে বাজে। অধ্যাপক বিজিত স্যার ও অধ্যাপক মাহবুব স্যারের গাড়ির বাইরে একটা ছিল জনাব এমএস দৌলার লাল রংয়ের সুবারু কার। বাকিগুলোর মধ্যে ছিল মিসেস সুরাইয়া রাজা চৌধুরীর টয়োটা স্প্রিন্টার ও ইউনাইটেড সেন্টারের জনাব আব্দুল মতিন খানের কমলা রংয়ের টয়োটা করোলা। এসব গাড়ির রং ও নাম্বারের বিশেষত্ব ছিল শহরের যেকোনও জায়গায় পার্ক করা থাকলে কোনও টোকাই এসে গাড়ির বডি নিয়ে খেলা করতে পারত না, ইটের টুকরা বা ছোটো পাথর দিয়ে গাড়ির বডিতে দাগ দিতে পারত না। এই সকল গাড়ি সবাই চিনতেন। অটো পাহারা হতো। সিলেট- ৩৭৫৩ নম্বরের টয়োটা টু ডোর পাবলিকা বিজিত স্যার বিক্রি করতে চাইতেন না রামকৃষ্ণ মিশনের সন্যাসী বেলুড় মঠের সহ-সভাপতি স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ ও ঢাকা মিশন প্রধান স্বামী অক্ষরানন্দজী মহারাজ এই গাড়ি চড়েছেন বলে। এমনই ছিল তাঁর গুরুভক্তি।

তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত। রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যক্রম পরিচালনায় অধ্যাপক বিজিত স্যার ও তাঁর পরিবারের অনেক অবদান। প্রায় দু-দশক ধরে সিলেট মিশনে বেলুড় মঠ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত সন্যাসী অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সিলেট রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমের অধ্যক্ষ হিসেবে আসেন স্বামী চন্দ্রনাথানন্দজী মহারাজ। তাঁর আগে মিশনের যাবতীয় দেখাশোনা করতেন অধ্যাপক বিজিত স্যার ও তাঁর পরিবার, অধ্যক্ষ কৃষ্ণকুমার পাল চৌধুরী ও তাঁর পরিবার, বিমলেন্দু দে নান্টু ও তাঁর পরিবার, জ্যোতির্ময় সিংহ মজুমদার চন্দন ও তাঁর পরিবার, অধ্যাপক প্রণবকুমার সিংহ, কামেশ দত্ত নানু, বিথিকা দত্ত প্রমূখ। বেলুড়সহ বিভিন্ন মিশন থেকে আগত অতিথিদের খাওয়াদাওয়া, থাকা সবকিছুই এসকল ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবার সংকুলান করতেন। বর্তমানে স্বামী চন্দ্রনাথানন্দজী মহারাজ সিলেট রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমের অধ্যক্ষ। আরও মহারাজ ও ব্রহ্মচারী আছেন। ছাত্র হোস্টেল আছে। ধর্মাশ্রিত ভাবনা ও সংশ্লিষ্ট অঙ্গনে জড়িত হওয়ার দরুণ সাহিত্যচর্চার সময় কম পেয়েছেন জীবনে। খুবই কম লিখেছেন তবে যা লিখেছেন ভালো লিখেছেন। তাঁর একটিমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ, ‘দিশারী বিচিন্তাস্রোত’ ২০১৮ সালে মদনমোহন কলেজ সাহিত্যপরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। সংকলক ও সম্পাদক কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ। আমরা তাঁর ধর্মভাবনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল তবে লেখালেখিতে, সাহিত্যচর্চায় আরও একটু সময় দিলে সমাজ বা আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে পুরো সমাজ উপকৃত হতো।

অধ্যাপক বিজিতকুমার দে স্যার ধর্মাশ্রিত সংস্কৃতি ভাবনায় উদবুদ্ধ হলেও অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক এক ব্যক্তিত্ব। শুধু তিনিই নন, তাঁর পুরো পরিবারই এই ভাবনায় আশ্রিত। সমাজে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ খুবই ভালো। সমাজের অনেক ভালো পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করেছেন। বর্তমানে বিত্তে, চিত্তে, শিক্ষায়, দীক্ষায়, সমাজ-সংস্কৃতি-প্রগতিশীল ভাবনায় সিলেট শহরের হাতেগোনা পরিবারগুলোর একটি।

অধ্যাপক বিজিতকুমার দে স্যারের বাড়িতে শারদীয় দুর্গাপূজা হয়। একসময় নিমন্ত্রণ দিতে স্যার নিজে বের হতেন। স্যার নিমন্ত্রণ করেছেন কয়েকবার। সপরিবার গিয়েছি। দুচার বার স্যারের ভাতিজা দেবাশীষ দে বাসুদা এবং আরও দুএক বার বাসুদার ছোটোভাই আমার ছাত্র জয়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছি। এখনও পূজা হয় তবে নিমন্ত্রণ আর পাই না। কারণ আছে। স্যারের প্রজন্মে শুধু তিনিই জীবিত আছেন, বয়স প্রায় নব্বই। পরের প্রজন্মের বেশিরভাগ সদস্য দেশের বাইরে। যাঁরা আছেন তাঁদেরও বয়স হয়েছে, সেন্ট্রাল ফার্মেসির মতো বড়ো একটা প্রতিষ্ঠানের ভার সামলানো অনেক কঠিন। তাছাড়া লোকবল কমে গেছে। দেওঘরি (পূজাপার্বনে সহায়তাকারী ব্যক্তি) থেকে শুরু করে রান্নার ঠাকুর, পাচক, গৃহ-সহযোগী কোনও কিছুই আর আগের মতো সহজে পাওয়া যায় না। এখন পূজানুষ্ঠানে সামাজিক দিকটা একটু কম দেখে শুধু ধর্মীয় দিকটা বিবেচনা করে পারিবারিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হচ্ছে। আর সামাজিক পর্বে রেন্ডম সিলেকশনে কেউ কেউ নিমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন।

স্যারের সাথে আমার আত্মীয়তা আছে, সম্পর্কে তিনি আমার তালুই। তাঁর ভাতিজী ডা. গায়ত্রীদির সাথে আমার মাসতুতো ভাই ডা. দেবজ্যোতি দাম শংকরদার বিয়ে হয়েছে। আত্মীয় হিসেবে আমার ব্যর্থতা আছে, যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি না, তাঁদের খোঁজখবরও নিতে পারি না। প্রবাদ আছে, ‘কায়া দেখলে মায়া’। সুতরাং কায়ার অভাবে যা হওয়ার তাই হয়েছে। যতদিন পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছি তার জন্য কৃতজ্ঞ স্যারের কাছে, তাঁর পরিবারের কাছে। পূজাতে স্যারের বাড়িতে বা অন্যত্র ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাওয়ার মধ্যে ধর্মীয় কোনও কারণ বা ভাবনা আমার মধ্যে কাজ করত না, এখন আমার স্ত্রী-পুত্রকন্যার মধ্যেও করে না। তাদের ছোটোবেলা উৎসবমূখর পরিবেশে আনন্দ করতে, মূর্তি দেখতে নিয়ে যাওয়াই ছিল মূখ্য। দেবতার দর্শন তো বাড়িতেই হবে। মূর্তি ও দেবতার মধ্যে পার্থক্যটি আমাদের সন্তানরা যে বুঝতে শুরু করেছে তা একটি ইতিবাচক বিষয়।

সিলেট শহরে বা আশপাশ এলাকায় আমার অত্যন্ত পরিচিত, ঘনিষ্ঠ ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পূজাতে আমাদের কোনও নিমন্ত্রণ হয় না। অনাহুতভাবে তো যাওয়ার প্রশ্ন ওঠেই না। মাঝে মধ্যে দুএক জায়গায় ঝড়ে বক মরার মতো দুএকবার এসেছে। নিমন্ত্রণের এমনিতে কোনও বিশেষ গুরুত্ব নেই। শুধু স্ত্রী-পুত্রকন্যার বুঝতে দেওয়া যে সমাজে কিছু লোক আমাদেরও তাঁদের নিজের মনে করেন। আমার এক মাসতুতো ভাই সিলেট শহর থেকে দশবারো মাইল দূরে তাঁর বাড়িতে দুর্গাপূজায় বলে না। ঠিকই আছে। তিনি বা অন্যরা আমাকে কেন বলবে? আমি কোন হরিদাস পাল যে আমাকে বলতে হবে। এ ব্যাপারে বিজিত স্যার ও তাঁর পরিবারের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। অনেক হিসেবনিকেশ করে দেখেছি আমি মধ্যম স্তরের নিম্ন-মধ্যম মাত্রার একজন শিক্ষক, রিকটার স্কেলের আড়াই থেকে তিন মাত্রার ভূমিকম্পের সমান্তরাল, এর বেশি কিছু নয়। তবে নিজ পরিবারে, নিজের স্ত্রী-পুত্রকন্যার কাছে, ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটা অবস্থান আছে। স্ত্রী-পুত্রকন্যার কাছে, নিজের কাছে আমি কমপক্ষে মোটামোটি মানের এক শিক্ষক, মোটামোটি মানের এক লেখক। সব দইওয়ালা যেভাবে টক হলেও নিজের দইকে মিষ্টি বলে, ভালো বলে সেই রকম একটা বিষয়, ভাবনা। প্রকৃত বিচারে দই ভালো নাও হতে পারে।
 
অধ্যাপক বিজিতকুমার দে স্যারের অনেক প্রগতিশীল ভাবনা আমাদের উজ্জীবিত করে। অধ্যাপক আবদুল আজিজ স্যার বয়সে তাঁর জুনিয়র হলেও ব্রেক অব স্টাডির কারণে আবদুল আজিজ স্যারকে এক পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে পান। এখনও আবদুল আজিজ স্যারকে তিনি শিক্ষকের যথাযোগ্য মর্যাদা দেন। এ ধরনের বোধ সমাজে বিরল।

বিজিত স্যার কথাবার্তায়, আলাপ-আলোচনায়, শুভেচ্ছার আদানেপ্রদানে খুবই স্বতস্ফূর্ত। পরিচিত কাউকে পেলে তাঁর কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে মোটেই ভোলেন না। আদিঅন্ত কুশল জিজ্ঞেস করেন। সে ব্যক্তিটি বিদায় নিলে আশপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কে ছিল? নামটা পুরো মনে করতে পারছি না’ ইত্যাদি। সব তথ্য সরবরাহ করা হলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অমুক ছিল।’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে কুশল বিনিময়কালে বুঝবার কোনও উপায় নেই যে তিনি তাঁকে ভালোভাবে বা একদমই চিনতে পারেননি। এটা স্যারের একটা ব্রান্ড মুভ। অধ্যাপক বিজিত স্যারের ভাতিজা-ভাতিজি ও ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকেই আমার ছাত্রছাত্রী ছিল। সমাজে আমার বন্ধুবান্ধব, অগ্রজ, অনুজ অনেকেরই সরাসরি শিক্ষক তিনি। ক্লাসরুমে না পেলেও তিনি আমারও শিক্ষক, সমাজের শিক্ষক।

অধ্যাপক বিজিত স্যার ছিলেন একাধারে একজন শিক্ষক-শিক্ষাবিদ, সমাজভাবুক এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর পাঠদানে, ভাষণে, বক্তৃতায়, কথাবার্তায়, আলাপ-আলোচনায় রয়েছে গভীর প্রজ্ঞা ও রুচি, নীতি-নৈতিকতা, দূরদৃষ্টি, মানবিক শিষ্টাচারের ছাপ। এগুলোর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে সমাজে। তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্রছাত্রী ছাড়াও এঁদের বা পরের প্রজন্মের অনেকেই তাঁকে শিক্ষক হিসেবে মর্যাদা দেন। এ ধারার ছাত্রছাত্রীরা ছাত্রজীবনে বিজিত স্যারকে প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষক হিসেবে না পাওয়ার অভাব বোধ করেন।

অধ্যাপক বিজিত স্যারের প্রথম পক্ষের স্ত্রী মিসেস কল্যাণী দে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রয়াত হন। তাঁর কর্মজীবনের বিগত পাঁচ দশক ধরে সান্নিধ্য পাচ্ছেন দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মিসেস সুজাতা গুপ্ত মহোদয়ার যিনি স্যারের পাল্লায় পড়ে মিসেস সুজাতা দে হয়েছেন। শুনেছি, মিসেস সুজাতা গুপ্ত মহোদয়া বিয়ের সময় তাঁর মায়ের অর্থাৎ স্যারের শাশুড়িমাতার দেখাশোনার কেউ নেই বলে দিনে মায়ের জন্য কিছু সময় বরাদ্দের শর্তে রাজি হয়েছিলেন। স্যার এ বিষয়ে কোনওদিন আপত্তি করেননি। আর এই সঙ্গে তাঁর সহধর্মিণীর মাতৃভক্তিরও বিশেষ এক মানদণ্ডের সাক্ষাৎ পাই। এইসব ব্যক্তিচর্চিত বিষয়ও সমাজকে প্রভাবিত করে দারুণভাবে।

অধ্যাপক বিজিত স্যারের পরিবারের প্রতি, ভাতিজা-ভাতিজি, নিজের ছেলেমেয়েকে নিয়ে অনেক ত্যাগ আছে। অনেক আবেগী মানুষ। সাথে সাথে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার অসীম এক ক্ষমতা তাঁর মধ্যে রয়েছে। তিনি একজন নিরহংকারী দাতা। প্রচলিত-অপ্রচলিত অনেক দানই তিনি করেছেন জীবনে। দান সশব্দে করতে নেই- সব ধর্মই তার সুপারিশ করে। যুগ যুগ ধরেই তাঁর আদি দান, নিত্যদিনের দান নিঃশব্দ থাকছে, অব্যক্ত থাকছে। এই থাকাটাকে শাস্ত্র যেভাবে সমর্থন করে, তিনিও করেন। তাঁর জীবনের পুরো ঘটনাপ্রবাহের এক শিল্পীত রূপ আসতে পারে সমরেশ বসু বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো ঔপন্যাসিকের কাছ থেকে বা ওই মাপের বা পর্যায়ের কোনও গল্পকারের কাছ থেকে। অনেকেই তাঁর মনের কোমলতা, সরলতা দেখেছেন। আমি তাঁকে খুব নিকট থেকে দেখেছি। কোমলতা, সরলতার পাশাপাশি তাঁর মনের কঠিন রূপ, পাথর রূপ আমি লক্ষ করেছি। জীবনে এই পাথরকেও তিনি কোমল জীবনে, সরল জীবনে মিশিয়ে দিয়েছেন। আলাদাভাবে সন্ধান করে সেই পাথরের সন্ধান আর পাওয়া যাবে না, পাওয়ার নয়। সহজ ও কঠিনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক আদর্শ মানুষ তিনি।

জীবনযুদ্ধে অনুভবের লড়াইয়ে অনেক সময় বিজয়ী হয়েছেন, আবার অনেকবার হয়েছেন বিজিত। তাই তো তিনি বিজিত। এখান থেকেই নামের নানা ব্যঞ্জনা- বিজিত, বিজিতকুমার, বিজিতকুমার দে, অধ্যাপক বিজিতকুমার দে, বিজিতবাবু, বিজিত স্যার।   

অধ্যাপক বিজিত স্যারের অধিকতর সুখকর, স্বাস্থ্যকর ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।  

মিহিরকান্তি চৌধুরী: লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার, সিলেট।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.