Sylhet Today 24 PRINT

সাম্প্রদায়িক শক্তি ঠেকাতে আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে

হাসান মোরশেদ  |  ১৫ অক্টোবর, ২০২১

চলমান সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নিয়ে বাম তাত্বিকদের কয়েকজনের লেখা পড়লাম। মোটামুটি তাদের সমীকরন একই রকম। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটলে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের ভোটের লাভ হয় আবার বাংলাদেশের ’ফ্যাসিবাদী’ সরকারের ও লাভ হয়, তারা অন্য সব 'জরুরী’ ইস্যু থেকে জনগনের দৃষ্টি সরাতে পারে। মানে  এইসব ঘটনা ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ প্রযোজনা। সরাসরি আক্রমনে যাদের ছবি/ ভিডিও দেখা যায়, যারা পুলিশের হাতে আহত নিহত বা গ্রেপ্তার হয় তারা আসলে মুল অপরাধী না বরং তারা বোকা সোকা ’মজলুম’, না জেনেই ব্যবহৃত হয়।

বাম তাত্বিকরা বিশাল জ্ঞানী। ’ট’ বললে তারা ’টেংরা’ পেরিয়ে একেবারে ’টেংরাটিলায় টিয়া’র ঝাঁক দেখতে পান। তুলনায় মূর্খ আমি, আমার একটা বিশ্লেষন লিখে রাখি।

২০০৮ এর নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, নির্বাচনের ফল নিয়ে কারো তেমন আপত্তি ছিলোনা। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে  যথারীতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ’৭২ এর সংবিধান এসব স্পষ্টভাবেই ছিলো। যুক্তি অনুযায়ী ধরে নেয়া যায় এই ইস্যুগুলোতে আওয়ামী লীগ স্পষ্টভাবেই জনগনের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো। সরকার গঠনের মাত্র তিন মাসের মধ্যে পিলখানায় রহস্যজনকভাবে সামরিক অফিসারদের হত্যা করা হয়, সামরিক অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। সরকার সেদিন ক্ষমতাচ্যুত হতে পারতো। শেখ হাসিনা কীভাবে এই ঘটনা সামলালেন বিস্তারিত তিনিই জানেন তবে আমরাও জানি সেদিন সরকার পতন ঘটানো অনেকের আকাঙ্খায় ছিলো।  এরপর যখন আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধী বিচার শুরু করে জামাত শিবির দেশ ব্যাপী সন্ত্রাস শুরু করে, বিএনপিও যোগ দেয়। ২০১৩ এর ৫ মে হেফাজতের ঢাকা দখল চেষ্টার মাধ্যমে আবারো শেখ হাসিনার পতন ঘটানোর স্বপ্ন দেখা হয়। শেখ হাসিনা এই ধাক্কাও সামলান তাঁর নিজের ক্যারিশমায়৷  বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে শিবিরের ধারাবাহিক আগুন সন্ত্রাসের অংশ নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে। তারেক রহমানের মতো একটা ম্যাগলোম্যানিয়াক বিএনপির একক নেতা হয়ে উঠে দেশের বাইরে থেকে দলকে ব্যস্ত রাখে সন্ত্রাস ও গোপন ষড়যন্ত্রে৷ ফলে সারা দেশে এই দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। বিএনপি পুরোপুরিই জামাত শিবিরের দখলে চলে যায়। এরা নানা ধরনের অন্তর্ঘাত মুলক কর্মকান্ড, মিথ্যে প্রচারনা ও গুজব ছড়িয়ে দেশকে অশান্ত করতে চায়।

এদিকে আওয়ামী লীগ ভেবেছিলো কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক ইসলামী দলগুলোর যেহেতু জামাতের সাথে মতাদর্শিক বিরোধীতা আছে, এদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করা যেতে পারে৷ কিন্তু এরা সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা পেয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে যখন সরকারকেই হুমকী ধামকী দেয়া শুরু করে এবং এক পর্যায়ে বিএনপি জামাতের সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রের সাথে একাত্ম হয় তখন আওয়ামী লীগ এদেরকে সাইজ করে। এটা একেবারেই সাম্প্রতিক ঘটনা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাংগঠনিক ভাবে বামরা এখন ন্যুনতম কোন ঘটনা না। এদের বাদ দিলে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ বনাম জামাত বিএনপি হেফাজত একটা প্রবল সাংঘর্ষিক মেরুকরন ঘটে গেছে। হেফাজতকে বিএনপি জামাত থেকে আলাদা রাখার কৌশল কাজ করেনি বরং ব্যাক ফায়ার করেছে আওয়ামী লীগের জন্য। আওয়ামী লীগ বিরোধী ঐ সম্মিলিত শক্তি নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করার শক্তি বা সাহস রাখেনা। কিন্তু তারা যেটা করতে পারে রেজিমেন্টেড মিলিটান্সির মাধ্যমে পরিস্থিতি অসহয়নীয় করে তোলে আন্তর্জাতিক পক্ষ থেকে আওয়ামী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে। ২০০৯ থেকে একের পর এক এই চেষ্টা চলছে, এই চেষ্টা চলতেই থাকবে- কোনভাবে একটা প্রবল জনরোষ, বিশৃংখলা,  ব্যাপক প্রানহানী ঘটিয় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফট টার্গেট বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী। ঐতিহাসিকভাবে এরা আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরক্ত, সংখ্যায় দেড় কোটি মানুষ একটা বড় শক্তি হলেও জাত পাতের বিভাজনে নিজেদের মধ্যে ঐক্য  বা প্রতিরোধের মানসিকতা দৃঢ় নয়। আওয়ামী লীগের গত বারো বছরে সরকারী চাকুরীতে অমুসলিমরা বৈষম্যের শিকার না হওয়ায় সংখ্যানুপাতে  সরকারী চাকরীতে তাদের আধিক্য লক্ষণীয়,  এটাও জনমনে হিন্দুদের বিরুদ্ধে একটা সফল প্রচারণা। হিন্দুদের উপর আক্রমনে সাম্প্রদায়িক আক্রোশ তো মেটানো গেলোই সরকারকেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জবাবদিহীতায় ফেলা গেলো। আর ঘটনা যদি নিয়ন্ত্রনের বাইরে ঠেলে দেয়া যায় তাহলে সরকার পতনের বহুল কাংখিত সম্ভাবনা তো থেকেই গেলো৷  এই সমীকরনে অন্ততঃ ক্ষতির কিছু নেই।  পুলিশের গুলীতে দুই চারজন মারা গেলে সেটা বরং আগুনে ঘি।

এবার এই সম্মিলিত আক্রমনের বিপরীতে আওয়ামীলীগের ডিফেন্স পলিসি কী? আগেই বলেছি- বাম, সুশীল পক্ষ এই পাওয়ার গেমে ন্যুনতম কোন ফ্যাক্টর না। আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ও আদর্শিক দায়বদ্ধতা আছে দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা সমুন্নত রাখা। আওয়ামী লীগের এই বারো বছরের শাসনামলেই সর্ব্বোচ্চ আদালতের রায়ে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় মুলনীতি হিসেবে পুনঃ সংযোজিত হয়েছে।

 কিন্তু সরকার চালাতে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে নিজের ক্ষতি করে ফেলেছে বেশী।

 হেফাজতিদের আস্কারা দেয়া ছিলো আওয়ামী লীগের ব্যয়বহুল ভুল, মামনুল হকের তান্ডবের সময় আওয়ামী লীগ সেটা টের পেয়েছে। গত বারো বছরে বানের জলের মতো লোকজন আওয়ামী লীগে ঢুকেছে, এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ’অকুপাই আওয়ামী লীগ' স্ট্র‍্যাটেজির অংশ- পরিকল্পনা করে এদেরকে আওয়ামী লীগে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগকে দখলে নেয়ার জন্য। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দূরদর্শীতার অভাবে তৃণমুল থেকে মধ্য পর্যায় পর্যন্ত এরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা এরা মানেনা, শেখ হাসিনা যখন সংখ্যালঘুদের নিজেদের মানুষ বলেন তখন এরা উপহাস করে, তথ্য প্রতিমন্ত্রী যখন বলেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবেনা তখন এরা মন্ত্রীকে গালিগালাজ করে। এই আওয়ামী লীগাররা নাসির নগরে, শাল্লায় হিন্দু নির্যাতন করে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বই আবার  নাসির নগরের অপরাধীদের মনোনয়ন দেয়, অবশিষ্ট ধর্ম নিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতিবাদের মুখে সেই মনোনয়ন বাতিল হয়।

আইন শৃংখলা বাহিনী যতো দায়িত্বশীল হোক, শেখ হাসিনা যতোই কঠোর উচ্চারন করেন সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে-  কোন লাভ হবে না যদি না আওয়ামী লীগ নিজের ভেতর শুদ্ধি অভিযান না চালায়। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস একটি রাজনৈতিক প্রপঞ্চ, এটি রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করতে হবে। একটা মফস্বলে থানার পুলিশের চেয়ে একজন আওয়ামী লীগ নেতার জনপ্রভাব বেশী। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে যদি ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক, অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করা না যায় তাহলে এসব সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আগামীতে আরো বাড়তে থাকবে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটবে।  বিএনপি জামাত হেফাজতীদের দীর্ঘ ষড়যন্ত্র তত্ব সফল হবে তাদের নিজেদের দক্ষতায় নয় বরং আওয়ামী লীগের আদর্শিক বিচ্যুতির কারনে।

হাসান মোরশেদ: লেখক, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.