Sylhet Today 24 PRINT

মইনুদ্দিন আহমদ জালাল: জীবননদী, বহে নিরবধি

স্মরণ

উজ্জ্বল মেহেদী |  ১৮ অক্টোবর, ২০২১

এক সুরমায় নদীমাতৃক সিলেট-সুনামগঞ্জ। উৎসমুখ ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ হলে নদী হবে মরুভূমি। বাঁধ ঠেকাতে হবে। সুরমার ক্ষোভ ধারণ করে একে একে প্রতিবাদী কর্মসূচি চলে। নদীতীরের মানুষকে জাগাতে সেই বরাক মোহনা থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত ছিল প্রচারণা। নদীতে পায়রা ওড়ানো, পুষ্পবৃষ্টি, নৌযাত্রা, ক্ষমা করো হে নদী…এ রকম কতশত সফট কর্মসূচি। এই নদীসংগ্রাম একজন মইনুদ্দিন আহমদ জালালের পঞ্চাশ পেরোনো জীবনের শেষবেলার। অকাল বিদায় তাঁকে জীবননদী করে রেখেছে।

জীবননদীর এই মানুষটি যুবরাজনীতিবিদ। পরিচিতি ছিল ভুবনডাঙায়। সিলেটে, রাজধানী ঢাকা, এমনকি দেশের সীমানা ছাড়িয়েও। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর অকস্মাৎ চলে গেছেন তিনি। তিন বছর ঘুরে এল আজ এই দিন, মনে হয় এই তো সেদিন। আঠারোর তারুণ্যে চলে যাওয়ার এই দিনটি পরিচিত মহলে শোক হয়ে বইবে, তরঙ্গহীন নদীজলে তৈরি করবে অকালপ্রয়াণের ঢেউ।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সেই চলে যাওয়া। আদি নিবাস সিলেট শহরের প্রান্তিক দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর। এ গ্রাম যেন শোকের গ্রাম। তার আগে আপ্লুত হয় শহর। বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ফোনে ফোনে কান্না-আক্ষেপ, আহা জীবন। ভারাক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনও। কী করে কী হলো, বিশ্বাসও করতে পারছিলেন না কেউ। অবিশ্বাসকে বিশ্বাস করতে মধ্যরাতে মৃতদেহ দেখে হারানোর ক্রন্দন রোল।


হাজি ইছকন্দর আলী ও সিতারা খানমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে মইনুদ্দিন আহমদ জালাল ছিলেন একমাত্র ছেলেসন্তান। তাঁর বাবা-চাচা সুনামগঞ্জ শহরে আরেক ঠিকানা গড়েন। সেখানেই জন্ম তাঁর। সাল ১৯৬৩, ২৪ ডিসেম্বর। স্কুলছাত্র থাকাকালে প্রগতিশীল শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরের সঙ্গে যুক্ত হন। তারপর তারুণ্যে জ্বলে ওঠেন স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন।

সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল সিলেট ও সুনামগঞ্জজুড়ে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজবন্দীও হয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে একমাস সুনামগঞ্জ জেলে কারাভোগ করেন। এমসি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে সিলেটে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। যুব ইউনিয়নে সিলেটে পরপর দুবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কেন্দ্রীয় সহসভাপতি, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য হিসেবে একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেছেন। যুবরাজনীতির কল্যাণে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে একটি অনিবার্য মুখ হয়ে ওঠেন। পঞ্চাশ পেরোনো বয়সে ৩২টি দেশে যুব উৎসবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের ৬২টি দেশ।

এক সময় আইনপেশায় জড়ান। সুরমা নদীর মতোই, সিলেট ও সুনামগঞ্জ বারের সদস্য। পেশায় মনোযোগ ছিল না। বোহেমিয়ানজীবন। যুব উৎসবের পতাকাতলে দেশ থেকে দেশ ভ্রমণ করেন। পরিভ্রমণের শুরুটা ছিল কিউবা থেকে। বিপ্লবী চে গুয়েভারার যুদ্ধক্ষেত্র আর ফিদেল কাস্ত্রোর প্রতি টান। ডব্লিউএফডিওয়াই আয়োজিত ১৪তম বিশ্ব ছাত্র ও যুব উৎসব ১৯৯৭ সালে কিউবার হাভানা যান। কারণ একটাই, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফিদেল কাস্ত্রোর ঐতিহাসিক উক্তির জন্য। 'আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি...'। ফিদেল কাস্ত্রোর হাত স্পর্শ করে যেন সেই উক্তির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আসা। এরপর যুবরাজনীতিবিদের জীবন চিরযুবা হয়। একে একে বিশ্বের সব যুব উৎসবে যোগ দেন। আলজেরিয়া, ভেনিজুয়েলা, সাউথ আফ্রিকা, ইকুয়েডর, রাশিয়ায় যুব উৎসবে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের মূল ভূমিকা পালন করেন। ২০০৬ সালে বিশ্ব সোশাল ফোরাম পোট এলিগ্রো, ব্রাজিলে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধিত্ব করেন।

এতো গেল দেশের বাইরে দেশে দেশে তৎপরতা। নিজভূমে কী করেছিলেন, স্থানীয় অঙ্গনে কতটা নির্মোহ ছিল তাঁর চালচলন? দলমত নির্বিশেষে এই তৎপরতায় মইনুদ্দিন আহমদ জালাল চিত্রিত হন বিরল বিনয়ী অনন্য একজন হিসেবে। মানুষের বিপদেআপদে তাঁকে পাওয়া যেত খুব সহজে। স্থানীয় আন্দোলন-সংগ্রামে আদর্শিকভাবে তাঁর জ্বলে ওঠা, স্রোতের বিপরীতে একা, অবিচল থাকা ব্যক্তিটিই মইনুদ্দিন আহমদ জালাল।

যাপিত জীবনের সর্বশেষ টিপাইমুখের আন্দোলন নিয়ে নদীসংগ্রামী রূপে আভির্ভূত হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক নদীসংগ্রামী সংগঠন অঙ্গীকার বাংলাদেশের পরিচালক ছিলেন। এর আগে গণআন্দোলনের মুখে সিমিটারের আন্দোলন তথা প্রথম জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। বহুজাতিক গ্যাস কোম্পানি সিমিটারবিরোধী আন্দোলন সিলেটে যুক্ত ছিলেন। বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন মাগুরছড়ায় গ্যাস পুড়িয়ে ধ্বংস করার প্রতিবাদ, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র রক্ষার আন্দোলন, টেংরাটিলায় নাইকোর গ্যাস পোড়ানোসহ জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড, হাওরে ফসলডুবির প্রতিবাদ, প্রতিবেশী দেশের আগ্রাসী তৎপরতায় নদী অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও সোচ্চার ছিলেন।  

শিশুসংগঠন থেকে ছাত্র সংগঠন, যুবরাজনীতি আর আঞ্চলিক আন্দোলনে মইনুদ্দিন আহমদ জালালের প্রেরণায় ছিলেন দুজন। একজনের বসবাস সিলেটে, অন্যজন সুনামগঞ্জে। এ যেন তাঁর দুই বাসভূমের শ্রেষ্ঠ এক অহংকার। গণমানুষের রাজনীতিবিদ পীর হবিবুর রহমান ও কমরেড বরুণ রায়ের প্রতি ছিল অকৃত্রিম এক শ্রদ্ধা ও মান্যতা। মানুষ, জীবন, সমাজ, পৃথিবীকে ভালোবাসার পাঠ নিয়েছিলেন এ দুজনের সান্নিধ্য থেকে। আর সুরমা নদীতো বহমান সিলেট ও সুনামগঞ্জ।
 
জীবন আর নদী। যোগ ছাড়া কোনো বিয়োগ নেই। জীবন যদি নদীর মতো হয়, অথবা জীবনটাই যদি একটা নদী হয়, জীবন ফুরালেও বহে নিরবধি। জালাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মতো। সাংবাদিকতা পেশার যে কোনো কঠিন অবস্থা, কিংবা সমাজ-সংকটে যাত্রাকালে ভরসা ছিল একজন মইনুদ্দিন আহমদ জালাল আছেন বলে।

অকাল বিদায়ে প্রিয় জালাল ভাইহীন মহামারি করোনাকাল পাড়ি দিচ্ছি আমরা। যদি বেঁচে থাকতেন, করোনাকালেও পরম নির্ভরতায় কাণ্ডারী হতেন। অসীম সাহসে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেন, নিজেকে উত্তম প্রমাণে চিরযৌবনের সারথিদের যুথবদ্ধ করতেন। তাঁকে হারানোয়, হারানোর বেদনার এই হাহাকার নদীর মতো বইছে। এটাই জীবননদী, মনের গহীনে বহে নিরবধি।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.