Sylhet Today 24 PRINT

পাথর তুই শক্ত, নাকি কাগজি-টাকা শক্ত?

প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ |  ৩০ অক্টোবর, ২০২১

আম্বরখানা ও পাঠানটুলা। কম নামেরই দরকার। ইদানীং দেখলাম, বোধহয় আম্বরখানায় ড্রেনের কাজ চলছে। কাজ চলাকালীন কষ্ট, সবাই আমরা মানব। কিন্তু, বিগত কম-সে-কম দুই-আড়াই বছর! কী পাপ করেছে আম্বরখানা চৌরাস্তা-মোড় থেকে পূবদিকে প্রায় শাহী ঈদগাহ পর্যন্ত এক/দেড় কিলোমিটারের রাস্তাটি?

সুপ্রিয় নাগরিকবৃন্দ, আপনার স্বীকার করবেন, “Blame-game is the worst game”,-“দোষাদোষির খেলা-সবচেয়ে বাজে খেলা”– যেটা খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে রাজনীতির ময়দানে। কিন্তু, এতে কোন সমাধানও আসে না, আসে “Might is Right”-এর মধ্য দিয়ে।

এ লেখাটির শক্ত ভিত্তি হচ্ছে নিষ্ঠুর ‘বাস্তবতা’। লেখাটির শিরোনামটির প্রয়োজনে অন্য একটি প্রসঙ্গ এসে যায়। আর, তা হল: আমাদের দেশ আছে; অতএব, অবশ্যই আছে এবং থাকবে আমাদের দেশনীতি। আমাদের রাষ্ট্র আছে; অতএব, অবশ্যই আছে এবং থাকবে আমাদের রাষ্ট্রনীতি। সরকার যে-ই আসতে পারে আসুক, আমরা যারা দেশনীতি-রাষ্ট্রনীতি করি না, অথচ তা-ও পড়াই এবং শেখাই; তাদের কিছু যায়-আসে না। ‘রাজনীতি’ শব্দটি পুরনো একটি শব্দ, এটা ঔপনিবেশিকতার ইঙ্গিতও বহন করে।

আমাদের গণতন্ত্রের দেশে এটা অচল। কারণ, আমাদের কোন রাজাও নেই, আর, তাই, আমরা কারো প্রজাও নই। আমরা একটি সার্বভৌম-স্বাধীন দেশের নাগরিক। আর, আমাদের দু’টো বড় বড় নাম: ‘বঙ্গভবন‘ ও ‘গণভবন’ – কোনটার নামই ‘রাজভবন’ নয়। অতএব, আমাদের দেশে আছে এবং থাকবে: ‘দেশনীতি’, ‘রাষ্ট্রনীতি’, ‘বিদেশনীতি’ ইত্যাদি শব্দ-‘রাজনীতি’ শব্দটি নয়, যেমন= কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে “রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ”। আমাদের রাষ্ট্রনায়কগণ (রাজনীতিকগণ নয়), আমার প্রস্তাবটি ভেবে দেখবেন– এ অনুরোধ করছি। ‘রাজপথ’ শব্দটিও থাকবে না, থাকবে=‘জনপথ’, গণপথ’, ‘পাবলিক রোড’। আমরা অনেকেই দাবি করি: “আমরা বুদ্ধিজীবী”, কিন্তু, চিন্তাশীল মানুষের যে অভাব আছে – তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ঔপনিবেশিক সকল চিহ্ন এ স্বাধীন দেশ থেকে মুছে ফেলতে হবে, যেমন= পোষ্ট-অফিসে চিঠি ফেলার বাক্সের ডিজাইন এবং তার লাল রং, আরও অনেক কিছু আছে, সব লিখতে গেলে অনেক বড় স্পেস লাগবে।

পৃথিবীর অনেক দেশে, বা দেশে দেশে হাজারো হাজারো সমস্যা আছে। আমাদের দেশে বরং কম, আলহামদুলিল্লাহ। হেঁ, যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন না, তাদের দৃষ্টিতে দেশে হাজার নয়, কোটি সমস্যাও থাকতে পারে। আর, এটা হচ্ছে স্রেফ ঔপনিবেশিক রাজনীতির দর্শন, এখানে করারও কিছুই নেই। হেঁ, ক্ষমতায় আসেন, আপনিও দেখবেন এবং বলবেন: দেশে কোন সমস্যা নেই একটিমাত্র সমস্যা ছাড়া; আর, এই একটিমাত্র সমস্যা হচ্ছে: বিরোধী দল, তারা যা-ই বলে, তা-ই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়– এটাও বাস্তবে একটি ঔপনিবেশিক দর্শন। বিরোধী দলে থাকলেও কথা বলতে হবে সেটি, যেটি দেশের জন্য হবে কল্যাণকর। মাতৃভূমির স্বার্থে এসকল মানসিকতা থেকে আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। পবিত্র জুমুয়ার নামাজের পূর্বের বয়ানে আমার পরিচিত একজন খতিব প্রায়ই বলে থাকেন– যা আমাকে প্রতিটি মুহুর্তে মনে রাখতে হবে: “মিট যায়েঙ্গে বাবুয়ানা/ চল যায়েঙ্গে খালি হাত”। এখানে সৌদি বাদশাহ আর বাংলাদেশি ভিখারির মধ্যে কোন তফাৎ নেই।

এবার প্রসঙ্গ: ‘উন্নয়ন’- যা এ লেখার শিরোনামের উদ্দেশ্য। যে সরকারই আসে, শুধু দেয় উন্নয়নের স্লোগান। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। ১৯৮১ সাল। আমি তখন বিদেশে শিক্ষকতায় (ইংলিশ)। মাটির মায়ায় সময় ও কাজের ক্ষতি যা-ই হোক, বিবিসি বাংলা খবর শুনতেই হবে। একদিন যখন শুনছিলাম, এক পর্যায়ে আসলো মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দুঃখজনক মৃত্যুর খবর। যে কোন মৃত্যুর খবরই দুঃখ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু বিবিসি-র ঐ খবর দুঃখের খবরটাকে যেন হাল্কা করে দিল ঐ সময়কার ‘উন্নয়নের’ খবর দিয়ে। ‘উন্নয়নের’ খবরগুলোর মধ্যে একটি ছিল এরকম: বাংলাদেশে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে ধানের এমন বাম্পার ফলন হয়েছে যে, দেশে উৎপাদিত ধানে দেশের সরকারি গুদামগুলো কানায় কানায় ভর্তি, “তিল-ঠাই আর নাহিরে”, এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা ধান-ভর্তি জাহাজগুলো ধান খালাস না করতে পেরে বহিঃনোঙ্গরে আটকে পড়ে আছে। এত অধিক ধানের লোড সামাল দিতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকার হিমশিম খাচ্ছে। বিবিসি-র ঐ বাংলা খবরে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের চতুর্মুখি ‘উন্নয়নের’ ফিরিস্তি গাইতে গাইতে উনার মৃত্যুর দুঃখটাকে ভুলেই দিচ্ছিল। হায় মিডিয়া, তুমি কি-ই না করতে পার?

অথচ, অতীত জ্ঞানীগণ তাদের দূরদর্শিতার মাধ্যমে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় সময়ের গতিতে হরেক রকম উন্নয়নের যে খতিয়ান এবং যে সমস্ত ‘এস.এম.এস’ (আজকের মোবাইল-প্রযুক্তির নামানুসারে) দিয়ে গেছেন, তার মাত্র একটি আমি এখানে উল্লেখ করছি: “আ ঘাটে ঘাট অইব, আ ফতে ফত অইব, আ মানু মানু অইব”। অতএব, যে কোন সরকারের আমলের যে কোন উন্নয়ন বাড়তি মানব-সম্পদের সদ্ব্যবহার ও সময়ের ব্যবধান/ব্যাপার-মাত্র। এটা বৈশ্বিক উন্নয়নেরও একটা ফলশ্রুতি। আরও সহজ কথায়, এটা শেষ পর্যন্ত একটা প্রাকৃতিক নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়, যেমন: দুই কেজি ওজনের নবজাত একটি শিশু ৭০/৮০ বছর বয়সে গিয়ে হয়ে উঠে ৭০/৮০ কেজি। আর, তাই, উন্নয়নের ব্যাপারটা নিয়ে অতিমাত্রার-অতিরিক্ত মাতামাতি অনেকটাই শিশুসুলভ ব্যাপার।

এবার আজকের লেখার মূল বিষয়ে আসা যাক। আম্বরখানার পূর্বদিক, মদিনা মার্কেট টু পাঠানটুলা, শাহী ঈদগাহর দক্ষিণ গেইটের দক্ষিণের রাস্তা=সবগুলোই সিলেট মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, অর্থ-বছর যায়, রাস্তাগুলো করে হায়-হায়। গাড়িগুলো কী সুন্দর নাচ বিনা পয়সায় দেখায়। প্যাসেঞ্জারগণ দোলনা চড়েন মাগনা। তবে কখনো কখনো মা-বাপ তুলিয়া গালি দিতেও ভুলেন না।

এত এত বেলাজ, বেশরম হলেও তো চলে না। একটু হলেও তো শরম-ভরম মান মর্যাদা আছে আমাদের বিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের। তাই, মধ্যে মধ্যে দেখা যায়=এই গর্তে, ঐ গর্তে, এই ভাঙায়, ঐ ভাঙায়, থোড়া মাটি, থোড়া বালুকণা, থোড়া ভাঙা ইটের কঙ্কর ইত্যাদি ফেলা-ও হয়, তবে এক বৃষ্টি হলেই আবার আগের জায়গায়। কাদাপানিতে ভরা গর্ত প্রায়ই বুঝা-ও যায় না, তাই দেখা যায়, কাদামাখা পানির ছিটায় মুসল্লির কাপড় নষ্ট, সেজেগুজে বেরিয়েছে এক যুগল, গাড়ির চাকার নেই একটুও বিবেক, কাদা-পানি ছিটকাইয়া; দিল সব সালওয়ার-কামিজ লেপটাইয়া, অথবা অসভ্য ড্রাইভারটা সুন্দর দু’টো চেহারার দিকে তাকাতে গিয়া সিএনজিটাই দিল উলটাইয়া, ধর ৭ জনে, দেও টান, মরো ধাক্কা, একটু মানবতাবোধও আছে না?

সালুটিকর বাজার থেকে গোয়াইনঘাট। যাওয়া-আসাটা যেন জীবনের চ্যালেঞ্জ। ৮/১০ বছর আগে ছিল এই হাল প্রায় ৫ বছর ধরে। পরে রাস্তার কাজ একসময় হল, কিন্তু টিকল মাত্র ১ বছর। বর্তমানে অবস্থা আগের চাইতে আরও ভয়ংকর। অথচ গোয়াইনঘাটের জাফলং, জৈন্তাপুর, কানাইঘাটের লোভাছড়া এবং কোম্পানিগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, পাথর সাপ্লাই দিচ্ছে গোটা বাংলাদেশে। অথচ স্থানীয় পাথর-খেকোরা নাকি আম্বরখানার দোকানে বসে উনাদের টাকা গুনেন প্রতি সন্ধ্যায়।

ফতেপুর থেকে হরিপুর, তা-ও যেন জীবন-যুদ্ধ। ধোপাগুল হচ্ছে পাথরে বড় আড়ত। অথচ, ওখান থেকে সাহেবের বাজারের রাস্তায় ঢুকার মুখেই যে বিরাটকায় গর্ত আর গর্ত, ভাঙা আর ভাঙা ছিল প্রায় ৫ বছর, তা উন্নয়নের সকল ফিরিস্তিকে পাগলের প্রলাপ বানিয়েছিল আর কি। আম্বরখানা থেকে শাহী ঈদগাহ, সাহেবের বাজারের আগে-পরে, গোয়াইনঘাট টু রাধানগর, হাতিরপাড়া টু ফতেপুর, কাজ মধ্যে মধ্যে হয়, তবে টিকে মাত্র ৬ মাস। আমাদের কৌশলী ইঞ্জিনিয়ারগণ প্রথমে চাকলা-বাকলা উঠান, এতে করে রাস্তা প্রথমেই আগের চাইতে এক ফুট নিচু হয়ে যায়। এর পরে ফেলেন বালুমাটি, তারপর গুণে গুণে ফেলেন ইট-কঙ্কর-পাথর, দেন উপরে পিচ, শেষমেশ প্রতিবার রাস্তা যেখানে হওয়ার কথা ১ ফুট উঁচু (যা দেখেছি বিদেশে), সেখানে হয় এক/আধা ফুট নিচু। আসলো বন্যা, পত্রিকায় খবর বেরুল=যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। বাহ! কি মজা? আর, কেউ পয়সা গুনেন পর্দা টানানো শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত সরকারি অফিসরুমে বসে, কেউ মাঠপর্যায়ে, কেউ বা শহরের কোন দোকানে বসে। আহ্ ! হায়রে দেশ+মানবপ্রেম+সুনাগরিকত্ব! একটি প্রাইভেট কলেজের জন্য পয়সা চাইতে গেলে কোন এক চেয়ারম্যান নাকি বলেই ফেলেছেন– তিনি নাকি নিজেই বাঁচেন চাঁদার উপরে!

প্রতিটি রাস্তায় বরাদ্দ আসে কত, তা আমার মত প্রফেসরের/মাস্টরবেটার জানার কথা নয়। তবে এটুকু বিশ্বাস জন্মেছে: প্রতিটি রাস্তার জন্য যা বরাদ্দ আসে, ঐ বরাদ্দের টাকাগুলোকে ১০০/২০০ টাকার কাগজি নোট বানিয়ে যদি ঐ নির্দিষ্ট রাস্তায় নোটগুলো বিছিয়ে দেয়া যেত, তা হলে হয়ত ৪/৫ লেয়ার হত। আর ঐ কাগজি টাকার ৫টি লেয়ার নিশ্চয়ই পাথর-বালু-পিচের চাইতে শতগুণ অধিক শক্ত হত। তাই, পাথরের কাছে আমার জিজ্ঞাসা=পাথর! তুই শক্ত, না কাগজি নোট শক্ত? জবাব দে।

দেখা যায়-শোনা যায়: ব্রিজ হয়েছে ৬ মাস পূর্বে, তার এপ্রোচ-রোড হয়েছে ৩ মাস পূর্বে, পত্রিকার সৌজন্যে জানা গেল: এক মাস পর এপ্রোচ-রোড দেবে গেছে। আর, ২৫/২০ কিলোমিটার রাস্তা যখন তলিয়ে যায়, তখন রাস্তায় আর গাড়ি চলতে না পারায় বের হয় ছোট-বড় ইঞ্জিন নৌকা। এরাও তো খেয়ে-পরে বাঁচবে। হায়রে, কত শক্তিশালী দেশপ্রেম! আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের পানির উচ্চতাজ্ঞান এতই ওয়ার্ল্ড-ক্লাস যে, মনে হয়, উনাদের জানা আছে: হযরত নূহ (আ.) এর যুগের বন্যা পুনর্বার আসলেও উনাদের বিল্ট (পাকা করা) রাস্তাগুলো কোনদিনই ডুববে না, যদিও তুরস্কের জূদী পাহাড়ের চূড়াও ডুবেই যায়।

পত্রিকান্তরে জানলাম, নারায়ণগঞ্জের এক জায়গায় নাকি শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান থাকলেও জনদুর্ভোগ চরমে। সিলেটের সারি-গোয়াইনঘাট ১৬ কিমি রাস্তা প্রায় ৫ বছর ছিল মরণফাঁদ। পরবর্তীতে কাজ হলেও গত বৃষ্টি আসতে না আসতেই মাঝখানে আবার ভাঙা আর গর্ত। তবে বুঝা গেল: শরম-লাজ-লজ্জা আছে। তাই দেখেছি, গর্তে গর্তে মাটি-বালু-ইটের কংক্রিট দিয়ে কবে যেন ওগুলো ঢেকে দেয়া হয়েছে।

পাথর যেহেতু কাগজি নোটের চাইতেও নরম, সেহেতু, আমি নিশ্চিত, বৃষ্টি আসলেই ওগুলো আবার স্বীয় জায়গায় চলে যাবে।

প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ : প্রিন্সিপাল, ক্যামব্রিজ গ্রামার স্কুল এণ্ড কলেজ, সিলেট; প্রতিষ্ঠাতা ও ২৪ বছরের সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.