Sylhet Today 24 PRINT

কবির মৃত্যু, সমাজব্যবস্থার দায়

মিসবাহ জামিল |  ০৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

পার্থ মল্লিক

তরুণ কবি পার্থ মল্লিক মারা গেছেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি তিনি হঠাৎ স্ট্রোক করেন। তারপর ৫ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। পার্থ কবিতা লিখতেন। রেখে গেছেন একটা কবিতার বই ‘মানুষ রঙের পাখিরা’। বইটা সম্ভবত ২০২০ বা ২০২১ খ্রিস্টাব্দের বইমেলায় প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি রেখে গেছেন কিছু স্মৃতি। তার স্মৃতি রোমন্থনে আমরা বুকের ভেতর শোকের বাগান করছি’। শোক জানাচ্ছি, শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। এরপর হয়ত তাকে আমরা ভুলে যাব। তার কবিতার বইটা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে কিনা সেটা অন্য কথা।

অকালে চলে যাওয়ার পেছনে কারণ কী? আমরা সেটা ভাবছি না। ভাবা কর্তব্যের বলে মনে করছি না এজন্য হয়ত ভাবছি না। একদিন শোক-শ্রদ্ধা জানিয়েই ক্ষান্ত দিচ্ছি বিষয়টাকে। আমরা ভাবছিই না এই মৃত্যুর দায় সমাজব্যবস্থার। সমাজের উচ্চ শ্রেণির কর্তারা তার প্রতি সামান্য দয়াপরবশ হলে হয়ত অকালে একটা প্রাণ হারিয়ে যেত না। কেউ কেউ ভাবতে পারেন সে আর মহান কে? মরলেই কী আর বাঁচলেই কী! এটা হয়ত ঠিক তিনি মহান কেউ হতে পারেননি। তার মাঝে আমরা মহৎ কিছু পাইনি। তার মাঝে যা ছিল তা সম্ভাবনা। আমরা কি তার সম্ভাবনার কথা অস্বীকার করতে পারি? নিশ্চয় পারি না।

তারুণ্যের মাঝে প্রবল সম্ভাবনা থাকে। বেঁচে থাকলে হয়ত আমাদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারতেন। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে এমন আফসোস রেখে গেলেন পার্থ। এই আফসোসটা হয়ত সবাইকে নাড়া দেবে না, কাউকে-কাউকে দেবে।


পার্থ মল্লিক কবিতা লেখার পাশাপাশি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। উদীচী সম্পর্কে আমরা জানি। এটা প্রগতিশীল একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন। উদীচী করার জন্য একজন প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে হয়ত প্রচুর বাহবা পেয়েছেন। কিন্তু বাহবায় কি আর পেট ভরে? পেট এসব বাহবা চায় না। চায় ভাত। ভাত জোটানোর চূড়ান্ত লড়াই করেছেন তিনি। প্রগতির লড়াইয়ে তার সঙ্গী হয়ত অনেকে ছিলেন। ভাত জোটানোর লড়াইয়ে ক’জন ছিলেন সেটাই ভাবার বিষয়। কবিতালেখক হিসেবে উচ্চপর্যায়ে চাকরি করেন এমন কবিসাহিত্যিকদের কাছেই বেশি ঘুরেছেন চাকরির জন্য। তার বিশ্বাস ছিল, অন্তত কবিসাহিত্যিকরা তার প্রতি বিমুখ হবেন না, দয়াপরবশ হবেন। তার বিশ্বাস চূর্ণ হয়েছে বারবার। কেউ কেউ তাকে পাত্তা দিলেও চাকরি দিতে পারেননি। আবার কেউ কেউ পাত্তাই দেননি। এড়িয়ে গেছেন চূড়ান্তভাবে।

বড় একটা করপোরেট অফিসের কর্তা, বড় সাহিত্যিক তাকে অফিসে যেতে বলেছিলেন। অফিসে গেলে কথা বলার আদবটুকুও দেখাননি মহান এই সাহিত্যিক। অথচ পার্থ খুব আশা নিয়ে গিয়েছিলেন তার কাছে। ভেবেছিলেন চাকরি হয়ে যাবে নিশ্চিত। চাকরি দেওয়ার মতো ক্ষমতা ওই সাহিত্যিকের ছিল বলেই। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হলো। এভাবেই তাকে বিষিয়ে তুলছিল আমাদের সমাজব্যবস্থা।

পার্থের মা-বাবা দুজনেই অসুস্থ ছিলেন। তার ছিল অর্থকষ্ট, বেকার থাকার বিষণ্ণতা। এসবের চাপ থেকেই হয়ত স্ট্রোক হয়। যার পরিণতি মৃত্যু। অথচ আমাদের কবিসাহিত্যিকরা সমাজ বদলানোর দায় কাঁধে নিয়ে লিখতে আসেন। নানান নীতিকথা শোনান। সমাজ বদলানোর কত প্রয়াস যে তাদের মধ্যে পাওয়া যায় তার সীমারেখা নাই। তারা পার্থ মল্লিককে একটা চাকরির ব্যবস্থা বা বাঁচার অবলম্বন করে দেওয়াকে সমাজ বদলানোর অংশ মনে করেননি। এই হলো আমাদের সাহিত্যিকদের মানসিকতা। আমার একটা কবিতার পঙক্তি আছে এমন—‘সবাই কমরেড বলে ডাকে মাগার ভাত দেয় না’। পার্থ মল্লিকের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটল!


আমাদের এমপি-মন্ত্রী তথাকথিত জনদরদিরা মুখে উন্নয়নের ফেনা তোলেন। বাংলাদেশকে ইউরোপ-আমেরিকা-সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করেন। দেশে যে পার্থরা ধুঁকে ধুঁকে মরছেন তারা কি দেখেন না বা জানেন না? দেখেন এবং জানেনও। কিন্তু এসবে তাদের ন্যূনতম টনক নড়ে না। তারা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চিন্তায়ই দিন পার করেন। উন্নয়নের তুলনাটা হয়ত উপমা হিসেবে ব্যবহার করেন কবি হওয়ার খায়েশ থেকে। এমপি-মন্ত্রী হয়ে ত বিরাট লাট সাহেব হয়েছেন এখন কবি হবেন বৈকি!

পার্থ মল্লিকের মৃত্যুর দায় এসব এমপি-মন্ত্রী লাট সাহেবদের তথা এ সমাজব্যবস্থার। এই সমাজব্যবস্থা আরও অসংখ্য পার্থকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং দেবে। অথচ সামান্য ভূমিকা নিলে হয়ত পার্থ মল্লিককে অকালে প্রয়াত হতে হতো না। এই সমাজব্যবস্থা পরিবর্তন জরুরি। সমাজের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। নইলে আরও অসংখ্য পার্থকে এভাবে অকালে হারিয়ে যেতে হবে।


পার্থ মল্লিকের পরিবারে বাবা, মা আর এক বোন আছে। তার বাবা গোপাল মল্লিক গানের শিক্ষক। এলাকায় ছেলেমেয়েদের গান শেখান। এটাই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। এর বাইরে তাদের সহায় সম্পত্তি নাই, বাঁচার কোনো অবলম্বন নাই। কিন্তু তিনি সস্ত্রীক অসুস্থ। পার্থের মৃত্যুর আগ থেকেই অসুস্থ ছিলেন তারা। এখন কে ধরবে সংসারের হাল? কী হবে তাদের? এখন তারা কি শোকে মারা যাবেন, না কি অনাহারে?

আদতে শোকে মানুষ মরে না। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় বটে। গ্লানি নামের ছালা টেনে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকে, বাঁচতে হয় বলেই। এই করুণ সময়ে সরকারকে পার্থ মল্লিকের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি। আশা করি সরকার একটা ব্যবস্থা করবে এই পরিবারের। নয়ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ভুল প্রমাণিত হবে। ভুল প্রমাণিত হবে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। ব্যর্থ হয়ে যাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার।

মিসবাহ জামিল: কবি।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.