Sylhet Today 24 PRINT

ক্ষমা করবেন স্যার

আকাশ চৌধুরী |  ০১ মে, ২০২২

একটি আবেগ, একটি অভিমান আমার জীবন থেকে কেড়ে নিলাে বাইশটি বছর। যদিও বিষয়টি খুব সামান্য ছিল; কিন্তু শুধুমাত্র আবেগতাড়িত হয়েই আমি আমি এই বছরগুলােতে নিজের ক্ষতি নিজেই করেছি। বঞ্চিত হয়েছি না জানা অনেক তথ্য থেকে। অথচ এই লােকটার সংস্পর্শে থাকলে জ্ঞানের পরিধি বিলক্ষণ বেড়ে যেতাে। আজ আমি অতি অনুতপ্ত যে; তাঁকে হারিয়ে এই অনুশােচনা করছি।

বলছিলাম সদ্য প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কথা। যাঁকে আমি 'স্যার' বলে সম্বােধন করতাম। তাঁকে হারিয়ে গােটা দেশ আজ স্তব্ধ। বাংলাদেশ হারিয়েছে অন্যরকম একজন অভিভাবক। যাঁর মেধা, দেশপ্রম, সততা এই মাতৃভূমিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। যিনি কিনা সারাজীবন সাফল্যের বরপুত্র ছিলেন।

মুহিত স্যারের সাথে আমার পরিচয় সম্ভবত ২০০০ সাল অথবা ২০০১ সালে; সিলেটের স্থানীয় দৈনিক মানচিত্র পত্রিকার প্রধান সম্পাদক জনাব লুৎফুর রহমানের (বর্তমানে জীবিত নেই) মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে বলার আগে স্যারের সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্য সামান্য তুলে ধরতে চাই।

মাহাজােট বা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি একজন সফল অর্থমন্ত্রী ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এখান থেকেই তাঁর কর্মজীবন শেষ নয়।

মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ইতিহাস, জনপ্রশাসন এবং রাজনীতি নিয়ে ৩০টির অধিক বই লিখা মুহিত স্যার জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত হন।

১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করার পর অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ডে উচ্চশিক্ষা শেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর তখনকার পাকিস্তান এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করার পর দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। আর তখনই তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়।

আমার যতটুকু স্মরণ হয় ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনােনয়নপত্র জমার সময় মানচিত্র পত্রিকার প্রধান সম্পাদক লুৎফুর রহমান ভাই আমাকে নিয়ে ঢাকায় যান। ওই নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে তিনি মনােনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। একদিন পর (তারিখটা স্মরণ নেই) আমাকে বললেন, 'চলাে দেশের খ্যাতিনামা এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়ে আসি।' তখনও আমি জানি না সেই খ্যাতিমান ব্যক্তি কে! ওই সময়কার ছােট একটি ইয়াশিকা ক্যামেরা নিয়ে আমরা হাজির হই ঢাকার বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ সংলগ্ন আবুল মাল আবদুল মুহিত স্যারের বাসায়। লুৎফুর ভাই বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলেন আর আমি সেগুলাে নােট করছিলাম। এসময় মুহিত স্যার সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচিত হলে আলােকিত সিলেট গড়বে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করনে।

হােটেলে ফিরে সেই সাক্ষাৎকারটি আমি লিখি; যেটার শিরােনাম দিয়েছিলাম, 'একান্ত সাক্ষাৎকারে আবুল মাল আবদুল মুহিত/ আমি আলােকিত সিলেট গড়তে চাই।' ফ্যাক্সযােগে এই সাক্ষাৎকার মানচিত্র সিলেট অফিসে পাঠানাের পর তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সােয়েব বাসিত আট কলামে লিড করে দেন। ওই সময়ে নির্বাচন সংক্রান্ত দেশের কােনাে পত্রিকায় এটাই ছিলেন মুহিত স্যারের প্রথম দেয়া কােনাে সাক্ষাৎকার। তৎকালীন সময়ে ওই সাক্ষাৎকারটি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।

কিছুদিন পর মুহিত স্যার সিলেটে আসেন এবং নিয়মিত নির্বাচনী গণসংযোগ শুরু করেন। মুহিত স্যার নির্বাচন সংক্রান্ত খবর সংবাদপত্রে কভার করার জন্য মানচিত্রের প্রধান সম্পাদককে বললে, তিনি আমাকে এর দায়িত্ব দেন। এরপর থেকে কোম্পানীগঞ্জ (আগে সিলেট-১ আসনে ছিল)সহ বিভিন্ন স্থানের গণসংযোগে আমি তার সঙ্গে যেতাম এবং সভা-সমাবেশের খবর দৈনিকগুলোতে সরবরাহ করতাম। অর্থাৎ তার ‘প্রেস সেক্রেটারী’র দায়িত্বটা আমাকেই পালন করতে হয় কিছুদিন।

একদিন তাঁর সঙ্গে গণসংযোগে যাই, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ইফতেখার হোসেন শামীম (বর্তমানে জীবিত নেই), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান এম, তৈয়বুর রহমান (বর্তমানে জীবিত নেই), তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি (বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক) শফিউল আলাম চৌধুরী নাদেলসহ আরও কয়েকজন। সিলেট থেকে গাড়িতে করে কোম্পানীগঞ্জ যাওয়ার পর একটি ছোট নৌকা দিয়ে অবহেলিত এক গ্রামে যাই আমরা। নৌকায় আমাদের সাথে ছিল শহরের প্রীতিরাজ রেস্টুরেন্ট থেকে নেয়া বিরিয়ানির প্যাকেট। দুপুর হয়ে যাওয়ায় আমরা তা সেখানে বসেই খেয়ে নিই।

নৌকা থেকে তীরে উঠার সময় মুহিত স্যার হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। তখনই আমার মন বলেছিল নির্বাচনে তার অবস্থান হয়তো ভাল হবে না। ফলাফল তাই হল। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপি নেতা এম, সাইফুর রহমানের সঙ্গে পরাজিত হন। যা হোক, এর আগে কয়েকদিন সিলেটের হাফিজ কমপ্লেক্সের বাসাই যাই মুহিত স্যারের সঙ্গে সংবাদপত্রে নির্বাচনী খবর নিয়ে আলোচনা করার জন্য। গণসংযোগ শেষে আগের দিনই তিনি আমাকে বলে দিতেন কখন যেতে হবে। যতোদিন সকাল বেলা কোম্পানীগঞ্জে তার সঙ্গে গণসংযোগে গিয়েছি প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় বা রাতে ফিরতে হতো সিলেট শহরে।

আমাকে কাছে পেলেই তিনি শুধু বলতেন ‘তুমি এম এম আকাশ’( ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লের অধ্যাপক)। বলতেন, ‘তোমাকে দেখলেই এম এম আকাশের কথা মনে পড়ে’। একদিন হাফিজ কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ও তৎকালীন সিলেট ব্যুরো প্রধান এম,এ,রহিম তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। তারা গিয়েছিলেন সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য। এর আগেই আমি মুহিত স্যারের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে চলে আসি। এভাবে বিভিন্ন সময় কেটেছে তাঁর সঙ্গে। ওই নির্বাচনের পর তিনি আবার ঢাকামুখী হয়ে গেলেন। মাঝেমধ্যে সিলেটে আসতেন। নির্বাচনের পর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
তবে ২০০৩ সালের জুন মাসে ‘সিলেট নগর উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকে আমি তাঁকে দাওয়াত দিয়েছিলাম।

গোলটেবিলটি ছিল তৎকালীন সময়ে আমার সম্পাদিত অনিয়মিত মাসিক খোলাকলম-এর উদ্যোগে। ‘নগর উন্নয়ন শীর্ষক’ এটাই ছিল সর্বপ্রথম গোলটেবিল। তিনি ঢাকায় অবস্থান করায় টেলিফোনে তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম গোলটেবিলে উপস্থিত থাকার জন্য। আমার বিশ্বাস ছিল তিনি সিলেটের উন্নয়নের স্বার্থে ওই গোলটেবিলে এসে মুল্যবান কিছু কথা বলবেন। কিন্তু টেলিফোনে আমাকে সরাসরি তিনি উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। আমি কোন কষ্ট পাইনি; কারণ আমি জানি তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন অর্থনীতিবিদ এবং এরচেয়েও হয়তো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান তার ছিল। তবে অভিমান করেছিলাম। ২০০৮ সালে তিনি নির্বাচিত হয়ে অর্থমন্ত্রী হন। সেই অভিমান থেকে দেখা করিনি। বলিনি যে স্যার আমি আপনার সেই 'এম এম আকাশ'।

তবে তাঁর কাছে না গেলেও সবসময় শ্রদ্ধা, ভালােবাসা ও শুভকামনা ছিল স্যারের প্রতি। ২০০৯ সালে তাঁকে উদ্দেশ্য করে 'আলােকিত সিলেটের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং কিছু কথা' শিরােনাম একটি লেখা (সাপ্তাহিক রােববার, ৩মে ২০০৯ এ প্রকাশিত) লিখি। সেই লেখাতেও আমি কিছুটা স্মৃতিচারণ করার চেষ্টা করেছিলাম। ওই সময় থেকেই দেখে আসি হঠাৎ করেই অনেকে মুহিত স্যারের সংস্পর্শে যেতে শুরু করেন। যাদের এর আগে বা ২০০১ সালের নির্বাচনে দেখিনি। তাদের অনেকেই হয়ে ওঠেন স্যারের ঘনিষ্টজন।

যা হােক, স্যার আজ আমাদের মধ্যে আর নেই। সদা হাস্যােজ্জ্বল চেহারাটি এখনাে আমার চােখে ভেসে ওঠে। অভিমনা ছেড়ে দিয়ে যদি স্যারের কাছে যেতাম, কােনাে আবদার রাখতাম অবশ্যই তিনি ফিরিয়ে দিতেন না। তার চেয়েও বড় কথা এমন একজন গুণী মানুষের কাছ থেকে আবেগতাড়িত হয়ে যে দূরে থেকেছি তাতে আমার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলাে। কােনাে কিছু পাওয়ার আশায় নয়, তাঁর সংস্পর্শে থাকলেও আমি অনেক কিছু শিখতে পারতাম। না জানা অনেক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আরােহন করতে পারতাম। কেনাে এই বাইশটি বছর নষ্ট করলাম তা ভেবে পাচ্ছি না। আপনার সাথে এই দীর্ঘ সময়টা যে অভিমান করে থাকলাম, যে দু:সাহস দেখালাম সেজন্য আমায় ক্ষমা করে দেবেন স্যার।

লেখক: আকাশ চৌধুরী, বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক সংবাদ।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.