Sylhet Today 24 PRINT

কীর্তিনাশার বুকে অনন্য কীর্তি

জুয়েল রাজ, লন্ডন |  ১৬ জুন, ২০২২

পদ্মাসেতু কি শুধুই সেতু? না তার চেয়ে বেশী কিছু? পদ্মাসেতু নির্মাণ এবং নির্মাণের পিছনের গল্প আমাদের সবারই কম বেশী জানা। আমি তাই সেই নির্মাণের গল্প বলব না। পদ্মাসেতু আমার কাছে স্বপ্নের চেয়ে বেশী কিছু।

এক পদ্মা সেতু না হলে কি হত? হয়তো কিছুই হতো না। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ শত শত বছর ধরে যে প্রক্রিয়াতে অভ্যস্ত হয়েছিল, প্রমত্তা পদ্মা তাদের জীবনের সাথে যেভাবে ফেরি ডুবি, লঞ্চডুবি, ফেরী দুর্ঘটনা কিংবা ফেরিঘাটে অপেক্ষায় প্রিয়জনের মৃত্যু সেসব নিয়েই তাদের যাপিত জীবন চলে যেত।

কিন্তু বিশাল ক্ষতিটা হতো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। একটি দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্র হিসাবে, একটি দুর্নীতিবাজ সরকার হিসাবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি পেত। আওয়ামী লীগ সরকারের হাজারটা দোষ হয়তো আপনি আমি খুঁজে বের করতে পারব। সেসব নিয়ে আমরা সমালোচনা করব, আলোচনা করব। কিন্তু নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, যে ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে সেটি ও স্বীকার করে উদযাপন করা উচিত।

সমালোচক গণ সহজ কথায় বললে বিরোধিতা কারীগণ, কারণ সমালোচনা এবং বিরোধিতা দুটি ভিন্ন বিষয়, তাই আমি তাদের বিরোধিতাকারী হিসাবেই চিহ্নিত করতে চাই। পদ্মাসেতুর প্রাক্কালিত ব্যয়ের হিসাব নিয়েই আলোচনা করছেন। সেখানে দুর্নীতির অভিযোগ তুলছেন, ঠিক যেন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগেরই মত, সন্দেহ করছেন, দুর্নীতি হতে পারে। যদি প্রতিটা খরচ ধরে ধরে এবং কোন জায়গায় কত দুর্নীতি হয়েছে, তার প্রমাণ সহ বিরোধিতা করতেন তা ছিল সমালোচনা কিংবা বস্তু নিষ্ঠ বিরোধিতা।

কিন্তু তারা সেটি করছেন না। বারবার শুধু অভিযোগ করছেন ১০ হাজার কোটি টাকার সেতু ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের নামে আওয়ামী লীগ লুটেপুটে খেয়ে ফেলেছে! এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞ কি শুধু লোহা ইস্পাত আর সিমেন্টের পিলার বসানোতে সীমাবদ্ধ? এই সহজ হিসাবটি তারা এড়িয়ে যায়। পদ্মার মত উত্তাল খরস্রোতা নদীকে বসে আনা সাধারণ নদী থেকে কয়েক গুণ বেশী ব্যয়বহুল। বিশ্বের ২য় খরস্রোতা নদী হচ্ছে এই পদ্মা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এই নদীর স্রোতের সাথে তলদেশের মাটি সর্বোচ্চ ২১৩ ফুট সরে গিয়েছে। এই তালিকায় প্রথমে আছে আমাজন নদী, যার উপরে এখনো পর্যন্ত ব্রিজ বানানো সম্ভব হয়নি। বহু বছর আগে এর রূপ নাকি আরও ভয়ংকর ছিল। পদ্মা এমনই খরস্রোতা নদী। যার তলদেশের মাটি স্থায়ী না। এই পদ্মা নদীর আরেক নাম হচ্ছে কীর্তিনাশা। কত কীর্তি কত গ্রাম ইতিহাস ঐতিহ্য বিলীন হয়ে গেছে পদ্মার ভাঙনে তার খবর কয়জন রাখে। গানে নাটকে সিনেমায় মাঝে মাঝে আমরা দেখতাম ভাঙনের কবলে পড়ে ঢাকা শহরে উদ্বাস্তু জীবন কাটানো মানুষের গল্প।

পদ্মাসেতু নির্মাণে শুধু নদীর উপর দৃশ্যমান অংশেক বিবেচনায় আনেন অনেক। বাস্তবে, নদীর দুইপাড়ে ভূমি অধিগ্রহণ, সাধারণ মানুষদের পুনর্বাসন, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সহ নানাবিধ প্রকল্প, যার কারণে এটি বহুমুখী প্রকল্প বলা হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি প্রকল্পের আলাদা আলাদা বরাদ্দ হয়েছে। বাজেট বড় হয়েছে।

বিশ্ব মন্দা, করোনাকালীন বৈশ্বিক পরিস্থিতি সব মিলিয়ে, এতো দ্রুত তম সময়ে যে পদ্মাসেতু প্রকল্পটি সম্পন্ন করা হয়েছে সেটিই তো একটি অসম্ভব কে সম্ভব করা হয়েছে। আমাদের একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে৷ ঘি' তে হাত দিলে কিছু ঘি হাতে লেগেই থাকবে। এতো বিশাল একটি প্রকল্প, সেখানে ফেরেশতাগণ নিয়োগপ্রাপ্ত হন নি কাজের জন্য। আপনার আমার মত সাধারণ মানুষই কাজগুলো করছেন। যাদের মাঝে, হিংসা লোভ, সবই আছে। তাই সেই ঘি হাতে কিছু লাগবেই সেটি ও একেবারে অস্বীকার করা যাবে না।

এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞ আমরা সব সময় বিদেশীদের হাত চেয়ে বসে থাকতাম। তারা সদয় হলে, তাদের লাভ নিশ্চিত হলে, নানা ধরণের নিয়ম কানুন আদেশ নির্দেশ মেনে,তাদের পছন্দ মত প্রকল্পগুলোতেই শুধু ঋণ পাওয়া যেত। সেই মোড়লদের মুখে ছাই দিয়ে, পদ্মাসেতু নিয়ে সংসদে দেয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর, ছোট একটি বক্তব্য মূলত বাংলাদেশের ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছিল। সেদিন আমার মত একজন সাধারণ মানুষ ও সন্দেহ পোষণ করেছিলাম, আদৌ কি সম্ভব, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ!

সেদিন কেউ সন্দেহ করেছেন, কেউ অবিশ্বাস করেছেন, কেউ উপহাস করেছেন। কেউ সমালোচনা করেছেন। বড় বড় পত্রিকা শিরোনাম করেছে "পদ্মাসেতু হচ্ছে না"

"নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু হবে" শেখ হাসিনার এই বক্তব্যকে অনেকেই রাজনৈতিক বক্তব্য হিসাবে দেখেছেন। কেউ কেউ, দুর্নীতির অভিযোগ থেকে আওয়ামী লীগের ইজ্জত বাঁচানোর বক্তব্য হিসাবে দেখেছেন। কিন্তু এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনা সবকিছু মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে, বাংলাদেশের সক্ষমতা অর্জনের চূড়ান্ত বার্তাটি পুরো বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। দেশের সাধারণ মানুষ ও প্রধানমন্ত্রীর সেই আহবানে সাড়া দিয়েছিল। সদ্য প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও প্রশংসার দাবীদার, তিনি শেখ হাসিনার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নে সারথি হয়েছিলেন।

পদ্মাসেতু নির্মাণের এই দীর্ঘ যাত্রাপথ খুব সহজ ছিল না। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র সবকিছু মোকাবেলা করে যখন, পদ্মার বুক চিড়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায়, তখন আবার এক শ্রেণি শুরু করে গুজব ছড়ানো, পদ্মাসেতু তে রক্ত লাগবে! ঠিক যেন রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে চাঁদে দেখতে পাওয়ার মত। গুজব গুলো এতোই প্রকট হয় যে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করে। সব ষড়যন্ত্র, গুজব পিছে ফেলে ২৫জুন ২০২২ যখন উদ্বোধনের চূড়ান্ত দিন ঘোষিত হয়, ঠিক তার আগে সীতাকুণ্ডে ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড। দুর্ঘটনা ষড়যন্ত্র যে ভাবেই ঘটুক প্রাণনাশ হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষের।

সেই মৃত্যু নিয়েও পদ্মাসেতুর সাথে মিশিয়ে ছড়িয়ে পড়ে গুজব।

প্রধানমন্ত্রীর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এর বাতিল করে, সেই বাজেটে ফায়ার ফাইটিং হেলিকপ্টার কিনার নির্দেশ দিয়েছেন। আসলে বিষয়টি কি মুড়ি চানাচুর কিনার মত বিষয়, যে ক্যাশ টাকা দিয়ে কাউকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন যে, আজ মুড়ি চানাচুর নয় ফায়ার ফাইটিং বিমান কিনব, আর কেউ গিয়ে কিনে নিয়ে আসল! কিন্তু বাস্তবতা হল, ফায়ার ফাইটিং হেলিকপ্টার কিনতে লাগবে প্রায় শত কোটি টাকা, যা লাগবে তা ব্যবস্থা করতে আলাদা ফান্ড, একনেকে পাস সহ, অনেক ধরণের বাধ্যবাধকতা আছে। ফায়ার সার্ভিস কে ঢেলে সাজাতে হলে নিশ্চয় সেটি পরিকল্পিত ভাবেই নিয়ম মেনে হবে।

আর পূর্ব নির্ধারিত পদ্মাসেতু উদ্বোধনের যাবতীয় পরিকল্পনা ও আনুষ্ঠানিকতা ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকী। ঠিক তখন এই ধরণের গুজবের কারণ কি?

খুবই সাধারণ, শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি বিতর্ক সৃষ্টি করা। অনুষ্ঠান হলে বলবে মানুষের মৃত্যুতে শেখ হাসিনার কিছুই আসে যায়না। এত গুলো মানুষ মরল কয়দিন আগে অথচ কোটি কোটি টাকা খরচ করে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে উৎসব করা হচ্ছে। সেই সব বিতর্ক এবং সমালোচনা উসকে দিতেই ছড়ানো হচ্ছে এই গুজব।

তার আগে পদ্মাসেতুর টোল নিয়ে আরেক দফা সমালোচনা হয়ে গেল। নিজের টাকায় করা সেতুতে টোল দিতে হবে কেন? এবং টোলের পরিমাণ ও বেশী নির্ধারিত হয়েছে বলে এক দল ক্ষেপে গেলেন। অথচ টোল কেন এবং কীভাবে নির্ধারিত হয় সেটি তারা জেনে বুঝে ও সমালোচনাটি করলেন। শুধুই বিরোধিতা করার খাতিরে।

উদাহরণ হিসাবে যদি বলি, যমুনা নদীর উপর, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে মোট খরচ হয়েছিল ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের জুন থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ২১ বছরে সেতুর টোল আদায় থেকে টাকা এসেছে ৫ হাজার ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ২৫ বছরে সেতুতে বিনিয়োগের টাকা তুলে আনার। কিন্তু সেই টাকা উঠে এসেছে সাত বছর আগেই।

অন্যদিকে, পদ্মাসেতুর ফলে, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতিবছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এর মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।

বিবিএস এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব সূচকের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।সেসময় জিডিপি'র আকার ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা।মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৯ ডলার।দারিদ্রের হার ৭০ শতাংশ।

পঞ্চাশ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে রফতানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসেবে যা ৩৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

জিডিপি আকার ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে বেড়েছে ৩৬৯ গুণ। পরিমাণে যা প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা।মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। অর্থাৎ ২,০৬৪ ডলার।

দারিদ্রের হার কমে হয়েছে ২০.৫ শতাংশ।

২০১২ সাল থেকে ২০২২ মাত্র ১০ বছরে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্বমানচিত্রে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আর যার প্রথম পদক্ষেপ ছিল পদ্মাসেতু।

এই যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু করে দেখানো, একটি আত্মবিশ্বাস। নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা শুধু কাগজে কলমে নয়, বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখানো। এবং নিজেদের অর্থায়নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার দ্বার উন্মোচিত হওয়া সে এক নতুন বাংলাদেশের পথচলা। বাংলাদেশকে এখন নানাবিধ উপাধিতে ভূষিত করার প্রতিযোগিতা চলছে। রোল মডেল হিসাবে বিশ্বমঞ্চে উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের নাম।

তাই পদ্মাসেতু শুধু একটি স্বপ্ন নয়, তার চেয়ে বেশী কিছু, প্রমত্ত পদ্মা নিয়ে আব্বাস উদ্দিনের হাহাকার " সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই, বল আমারে তোর কি রে আর কূল কিনারা নাই" - এই কূল কিনার হীন কীর্তিনাশা নদীর অকুলে কূল গড়েছে পদ্মাসেতু। ইতিহাসের শেখ হাসিনার এক অনন্য কীর্তি হয়ে থাকবে কীর্তিনাশার বুকে গড়া কীর্তি।

জুয়েল রাজ, যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক, দৈনিক কালের কণ্ঠের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি ও ব্রিকলেন পত্রিকার সম্পাদক

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.