Sylhet Today 24 PRINT

যে ব্যবসা অংশীজনদের জীবনমান নিশ্চিত করতে পারে না, সেটি টিকে থাকার দরকার কী?

হাসান মোরশেদ |  ২৪ আগস্ট, ২০২২

আমাদের মতো সাধারন মানুষ ইচ্ছেমতো অনেক শব্দ ব্যবহার করে ফেলি। কিন্তু গণমাধ্যমগুলোর শব্দপ্রয়োগে আরেকটু সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যেমন 'চা বাগান মালিক'। উত্তরবঙ্গের সমতল ভূমিতে নতুন সৃজিত বাগানগুলোর বিষয়ে নিশ্চিত নই তবে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের চাবাগানগুলোর বিষয়ে নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি। কোন ব্যক্তি চাবাগানের মালিক নয়।

প্রতিটি চা বাগানের মালিক সরকার। কিছু বাগান সরকার নিজে চালায়, বেশীর ভাগ বাগান ইজারা দেয় নির্দিষ্ট শর্তে। ইজারার মেয়াদ শেষে নতুন করে ইজারা নিতে হয়। ইজারা চলাকালীন সময়েও কেউ শর্ত ভঙ্গ করলে ইজারা বাতিল করার এখতিয়ার সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসকের থাকে। সুতরাং 'চা বাগান মালিক' একটা ভুয়া অহমিকাপূর্ণ পরিচয় মাত্র।

সিলেট অঞ্চলে প্রথম বাগান সৃজন হয় ১৮৫৪ সালে। এর আগে বাংলার বাইরের  বিভিন্ন জায়গা থেকে  শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়। বৃটিশ আমল এবং পাকিস্তান আমলের পুরোটা এর নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাননি, ভোটাধিকার ছিলো না।

মুক্তিযুদ্ধে এই জনগোষ্ঠী ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হন, অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, সিলেট অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য বহু যুদ্ধে এরা মুক্তিবাহিনীর গাইড হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু এঁদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার প্রদান করেন, চা সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেন এবং সুপেয় পানি, স্যানিট্রেশন, চিকিৎসা সুবিধা প্রদান- এগুলো বাগান ইজারার শর্ত হিসেবে যুক্ত করেন।  বাগান শ্রমিকরা যে বংশ পরম্পরায় বঙ্গবন্ধুকে ভগবানের মতো মানেন, সেটা এমনি না। মানুষ হিসেবে, এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি তারা পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে।

বাংলাদেশের সংবিধানে যে ১৮টি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে তার একটি অনুচ্ছেদে [২৮ নং অনুচ্ছেদ] রয়েছে- ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারনে কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না।

আরেকটি অনুচ্ছেদে [৩৪ নং] সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ এবং এই বিধান কোনভাবে লংঘিত হইলে তাহা আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে"
চা বাগানে বিদ্যমান শ্রম ব্যবস্থা পরোক্ষভাবে জবরদস্তিমুলক শ্রম। ইজারার শর্ত অনুযায়ী শ্রমিকদেরকে উন্নত বাসস্থান, সুপেয় পানি, পয়ঃনিস্কাশন, সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা এসব নিশ্চিত করার কথা। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সেটা নিশ্চিত করা হয়না। ইজারার শর্ত ভেঙ্গে চাবাগানের ভেতর রাবার বাগান, আনারস বাগান, মৎস্য খামার, ট্যুরিস্ট লজ বানিয়ে বাগান শ্রমিকদের চাষবাসের সুযোগ সংকুচিত করা হয়।

চা বাগান শ্রমিক পরিবারের সন্তানেরা যে বাইরে অন্য পেশায় জড়িত হচ্ছেন না, তা না। সীমিত হলেও তাঁরা অন্য পেশায় যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশুনোও করছেন অনেকে। কোটা বিরোধীরা সর্বনাশ করার আগে সরকারী চাকরীতে নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে তাঁদেরও বিশেষ অধিকার ছিলো। শ্রীমঙ্গল অঞ্চলে কয়েকজন ইউনিয়ন চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছে এই জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চলে জায়গা কিনে বসবাস করার, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাবার, যোগ্যতা অনুযায়ী যে কোন পেশা গ্রহনের সাংবিধানিক অধিকার তাঁদের রয়েছে।

কিন্তু বাস্তব অর্থে, বিদ্যমান পদ্ধতি বজায় রেখে তাদের জীবনমানের পরিবর্তনের গতি খুবই ধীর। তাদের দাবীমতো দৈনিক মজুরী ১২০ টাকার বদলে ৩০০ টাকা করা হলেও এ ক্ষেত্রে তেমন কোন পরিবর্তন আসবে না।  গণমাধ্যম আরেকটি অর্ধসত্য তথ্য প্রচার করেছে। পঞ্চগড়ের বাগানগুলোতে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরী ৫০০ টাকা। কিন্তু এটুকু বলেনি যে ওখানে শ্রমিকরা বাগানের ভেতর আটকানো না। এঁরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের মতো নিজের বাসস্থান থেকে এসে কাজ করেন।

১২০ টাকার বদলে ৩০০টাকা মজুরী নির্ধারন কোন স্থায়ী সমাধান না। আজকের ৩০০ টাকা কয়দিন পরই মুদ্রাস্ফীতির কারনে ৩০০ টাকা থাকবেনা। তখন শ্রমিকরা আবার আন্দোলনে নামবে ৫০০ টাকার জন্য? এভাবেই চক্রাকারে চলতে থাকবে?

চা বাগান শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা কেনো দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী সমাধানের চিন্তা করেন না, আমি জানি না।

আমার মতে, স্থায়ী সমাধান হচ্ছে বৃটিশ আমলের শ্রম পদ্ধতির পরিবর্তন। শ্রমিকদের বাসস্থান সহ অন্যান্য সবকিছুর জন্য বাগান নির্ভরতা কমানো। বাগান নির্ভরতা না কমানো পর্যন্ত বাগান শ্রমিকের সন্তান  শ্রমিক হবার আশংকাই থেকেই যাবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একই পেশায় রয়ে যাওয়ার পরিবেশ বিদ্যমান রাখাটাই মূল সমস্যা।

শ্রমিকদের এই প্রায় বন্দী অবস্থা থেকে স্থায়ীভাবে মুক্ত হওয়াটা জরুরী। পোষালে তারা বাগানে কাজ করবে, না পোষালে অন্য কিছু করবে। এক্ষেত্রে একটা বড় বাধা গত ২৫০ বছরে এরা ভূমির মালিকানা পায়নি। বাগান থেকে বের হয়ে থাকবে কোথায়? চমৎকার সুযোগ ছিলো, এখনো হয়তো আছে- মুজিব বর্ষের ঘরগুলো বাগান শ্রমিকদের সুযোগ দেয়া। বাগান শ্রমিকদের রবিদাস সম্প্রদায়ের মানুষ জন আছেন। আমি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায় রবিদাস সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ পেয়েছিলাম, এরা বাগান শ্রমিক নন- জুতা তৈরীর কাজ করেন। কথ্য ভাষায় 'মুচি'; সম্প্রদায়।  ভীমখালি ইউনিয়নে বেশ কতগুলো মুজিব বর্ষের ঘর পেয়েছেন এঁরা। সাথে সমাজকল্যান মন্ত্রনালয় থেকে থোক বরাদ্দ তাঁদের ব্যবসা সম্প্রসারনের জন্য।

চা বাগান রয়েছে এমন এলাকায় মুজিববর্ষের যে ঘরগুলো তৈরী হয়েছে সেগুলোতে বাগান শ্রমিকদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে কিনা আমি জানি না। ভূমিহীন, গৃহহীন হিসেবে তাঁদের না পাওয়ার কোন কারন নেই। যদি বরাদ্দ দেয়া না হয় তাহলে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে খাসজমিতে মালিকানা প্রদান করে তাদেরকে স্থায়ী ঠিকানা করে দিতে পারে।

আশংকা থাকে, বাগানের বাইরে স্থায়ী আবাস পেয়ে গেলে বংশানুক্রমিক বাগান শ্রমিকেরা আর বাগানের কাজে ফিরবেন না। অন্য পেশায় চলে যাবেন। এখনকার বাগানগুলোতে যে কেবল বংশানুক্রমিক শ্রমিকরা কাজ করছেন তেমন নয়, সিলেটের কোন কোন বাগানে বরিশাল অঞ্চল থেকে আগত বাঙ্গালী শ্রমিকদেরও দেখেছি।
ইজারাদাররা অবশ্যই হিসাব করে দেখাবেন, পদ্ধতির এই আমুল পরিবর্তনের ফলে বাগানের ব্যবসায় ধ্বস নামবে। যে ব্যবসা তার অংশীদারদের (আধুনিক ব্যবসা ধারনায় উৎপাদনের সাথে জড়িত সকলেই অংশীদার/ স্টেক হোল্ডার) জীবনমান নিশ্চিত করতে পারেনা, সেই ব্যবসা টিকে থাকার দরকার কী?

ফেসবুক থেকে নেয়া
হাসান মোরশেদ: লেখক, গবেষক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.