Sylhet Today 24 PRINT

কারান্তরিন আরিফুল হক চৌধুরী : ১ বছর পর

আব্দুল করিম কিম |  ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫

দরজায় দাঁড়ানো পুলিশ। অনুমতি ছাড়া কারো ভেতরে ঢোকার সুযোগ নেই। দুটো বাক্যের এ বর্ণনায় যে কেউ হয়তো ভাববেন ভেতরে থাকা ব্যক্তিটি খুবই ক্ষমতাধর কেউ। তাদের ভাবনাগুলো মোটেও ঠিক নয়। ভেতরের ব্যক্তিটি ক্ষমতাধর কেউ নন। এমনকি কাউকে ভেতরে আসার অনুমতি দেয়ার ক্ষমতাটুকুও তার নেই। অফিসে কিংবা বাসায় নয়, তিনি আছেন হাসপাতালের বেডে, বন্দি হিসেবে। বাইরের পুলিশ নিরাপত্তা দিতে নয়, আছে বন্দির পাহারা হিসেবে।

শরীরের অবস্থা ভীষণ রকম খারাপ তাই আছেন হাসপাতালে। নইলে কারাগারেই থাকতেন। কারণ তিনি এক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত। ক্ষমতা তারও ছিল। ভালবেসেই সে ক্ষমতা তাকে তুলে দিয়েছিল সাধারণ জনগণ। ছিলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, থাকতেনও। তবে সাবেক অর্থমন্ত্রী ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ শাহ্‌ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ায় সাময়িকভাবে সে পরিচয় হারাতে হয়েছে তাকে। কারাবন্দী হিসেবে আরিফুল হক চৌধুরীর দিন এখন কাটছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৪৭ নং কেবিনে। অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় একদম একা নিঃসঙ্গ দিন কাটছে তার।" গত আগস্ট মাসে মানবজমিন পত্রিকায় চৌধুরী মুমতাজ-এর এমন একটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম। আরও চার মাস চলে গেছে।

গতকাল (৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫) সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী'র কারান্তরিন হওয়ার এক বছর পূর্ণ হল। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হিসাবে আরিফুল হক চৌধুরীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত। ঐদিন তিনি হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। দীর্ঘ ৪৩ মিনিট শুনানি শেষে হবিগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠান। সেই থেকে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নগরপিতা শূন্য।

বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী বলে খ্যাত সিলেট মহানগরী যেদিন মেয়রশূন্য এক বছর পরিপূর্ণ করলো সেই দিন বাংলাদেশের শত শত পৌরসভা দিনব্যাপী মেয়র নির্বাচনে ব্যস্ত ছিল। ৯০/১০০ টি দোকান ঘর নিয়ে গড়ে ওঠা অনেক বাজার বা গঞ্জের হাট এখন পৌরসভা। সেই সব পৌরসভার নাগরিক সুবিধা-অসুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষ থাকা দরকার।

৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫-এর নির্বাচনের মাধ্যমে সেই কর্তৃপক্ষের প্রধানকে দলীয়ভাবে নির্বাচিত করেছে ভোটাররা। সেই প্রধান হলেন মেয়র। অকাজের মেয়র থাকলেও যা না থাকলেও তা। অকাজের মেয়রকে একবার দায়িত্ব দিলেও অশ্বডিম্ব প্রসব করবেন; তিনবার দিলেও এর ব্যত্যয় ঘটবে না। কাজের মেয়র কাজের জন্য কারো মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকবেন না। কাজ খুঁজে বের করবেন।

সিলেটবাসী দীর্ঘদিন পর এমন একজন কাজের মেয়র বা নগরপিতা পেয়েছিল, যিনি নগরবাসীকে দুর্ভোগমুক্ত রাখতে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়ে শুরু করেছিলেন সিলেট মহানগরীর উন্নয়ন। সেই মেয়র হলেন 'আরিফুল হক চৌধুরী'।

সিলেটের কৃতিসন্তান বর্তমান অর্থমন্ত্রী ও স্থানীয় সাংসদ আবুল মা'ল আব্দুল মুহিতও মেয়র আরিফের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নগরবাসী হকারমুক্ত ফুটপাত, আবর্জনামুক্ত ছড়া ও খাল, যানজটমুক্ত রাজপথের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের শেষ সীমায় প্রায় পৌঁছে ছিল। কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধভাবে আরিফুল হক চৌধুরীকে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি করা হয়। যা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য, অসঙ্গতিপূর্ণ। এই হত্যাকাণ্ডে আরিফুল হক-এর অন্তর্ভুক্তি সাধারণ নাগরিকদের কাছেও দুরভিসন্ধিমূলক বলে প্রতীয়মান।

২০০১ থেকে ২০০৬ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান-এর পালকপুত্র হয়ে আরিফুল হক ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার করেন; একথা সত্য। সে সময় দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ সর্বমহলে আলোচিত হয়। আবার তাঁর একান্ত নজরদারী ও ইচ্ছার প্রতিফলনে সেই সময় সিলেট মহানগরীর বিভিন্ন সড়ক অবৈধ দখলমুক্ত হয়। কোথাও কোথাও তাঁর নির্দেশ মান্য করে যানচলাচলের সুবিধার্থে ব্যক্তিগত জায়গা জনস্বার্থে কেউ কেউ দান করেন। ফলে সিলেট পৌরসভা ধীরে ধীরে মহানগর হওয়ার পথে অগ্রসর হয়।

সেই সময়ের অপকর্মের জন্য ১/১১-এর সেনা সমর্থক কেয়ারটেকার সরকার আরিফুল হক চৌধুরীকে রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করে। তাঁর নামে একাধিক মামলা হয়। আইনের ফাঁক-ফোঁকরে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেই আরিফ বেকসুর খালাস হয়ে রাজনীতির ময়দানে ফিরে আসেন।

সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বিজয় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে একজন বদলে যাওয়া মানুষকে আবিষ্কার করে নগরবাসী। ক্ষমতাসীন দলের তিনবারের নির্বাচিত মেয়র'কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অবিশ্বাস্য ভাবে আরিফুল হক'কে বৈরী পরিবেশে সিলেটবাসী মেয়র নির্বাচিত করে। নির্বাচিত হয়েও তিনি নিজের বদলে যাওয়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। দলবাজ, দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজদের এড়িয়ে সাহসিকতার সাথে এক নতুন পথ চলার সূচনা করেন। দলীয় পরিচয়ের সীমানা অতিক্রম করে স্থানীয় সরকারের প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। প্রতিনিয়ত তিনি গণমাধ্যম ও নাগরিকদের সম্মুখে নিজের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালান। আলোচনা-সমালোচনার বিশ্লেষণ করে সঠিক পথ নির্ণয় করার ঐকান্তিক ইচ্ছা তাঁর মধ্যে দেখেছি।

তাই ২০০১-০৬ সালের আরিফুল হক চৌধুরীর কঠোর সমালোচক হয়েও বদলে যাওয়া আরিফুল হক'কে পছন্দ করতে শুরু করি। কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দেয়া হল। তাঁর জামিন নামঞ্জুরের সংবাদে কোথাও কোন প্রতিক্রিয়া দেখিনি। যেন এমনটাই স্বাভাবিক। সন্ত্রাসী, দলবাজ, দুর্নীতিবাজ, দখলবাজ, টেন্ডারবাজদের তিনি পাশে রাখলে ঐদিন কোথাও না কোথাও রাস্তা অবরোধ হত। কিছু গাড়ী ভাংচুর হত। দু'একদিন হরতাল হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। সাধারণ নাগরিকরা এসব কিছুই করতে পারে না, কিন্তু নীরবে ফিসফাস আলোচনা করে। ন্যায় হলে খুশী হয়, অন্যায় হলে বিরক্ত হয়।

সিলেটবাসী বিরক্ত। নির্বাচিত মেয়রহীন এক বছরের নগর জীবনে খুশী হওয়ার মত কিছুই ঘটেনি বরঞ্চ পদে পদে বিরক্তি অর্জনের অভিজ্ঞতা হয়েছে বিস্তর। গতকাল আরিফুল হক চৌধুরী'র কারান্তরিন হওয়ার এক বছর পূর্ণ হল। তাঁর মুক্তির জন্য কেউ কোন দাবি জানিয়েছে বলে কোন সংবাদ এপর্যন্ত নজরে আসেনি।

কেউ কিছু না বললেও, আরিফুল হক চৌধুরী'র নির্দোষ হয়ে ফিরে আসার অপেক্ষায় নগরবাসী। দলীয় রাজনৈতিক বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে ওঠে সিলেটকে আলোকিত নগরী করার প্রয়াস তিনি সফল করবেন সুনিশ্চিত।

আব্দুল করিম কিম : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেট।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.