Sylhet Today 24 PRINT

পরকাল: জীবনের এক অধ্যায়

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান |  ৩০ মার্চ, ২০২৩

মানুষের জীবনকাল মৌলিকভাবে তিনটি স্তরে বিভক্ত, যথা: (১) রূহের জগত (২) দুনিয়ার জগত ও (৩) পরকালের জগত। আল্লাহ তা’আলা রূহের জগতে সকল রূহকে সৃষ্টি করার পর থেকে মায়ের গর্ভে সৃষ্ট দেহে রূহ ফুঁকে দেয়া পর্যন্ত সময়কে রূহের জগত বলা হয়।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন : (হে রাসূল!) “যখন আপনার রব বানূ আদমের পিঠ থেকে তাদের বংশধরদেরকে বের করলেন এবং তাদেরকেই তাদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলল : ‘আপনি অবশ্যই আমাদের রব। আমরা এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি।’ (আমি এ ব্যবস্থা এ জন্যই করেছি) যাতে তোমরা কিয়ামতের দিন এ কথা বলতে না পার যে, ‘আমরা তো এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না।’ (আল্ আ’রাফ : ১৭২)।

আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেন:“আল্লাহ তা‘আলা যখন আদম (আ.)কে সৃষ্টি করেন তখন তার পিঠে (নিজ হাত দ্বারা) মসেহ্ করেন। এতে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি তার যত সন্তান সৃষ্টি করবেন তাদের সবাই তার পিঠ থেকে বেরিয়ে আসে। তিনি প্রতিটি মানুষের দুই চোখের মাঝখানে নূরের দীপ্তি সৃষ্টি করে তাদের সবাইকে আদম (আ.)-এর সামনে পেশ করেন। আদম (আ.) বলেন : হে আমার রব! এরা কারা? আল্লাহ তা’আলা বলেন : এরা তোমার সন্তান। আদম (আ.) তাদের মাঝের এক ব্যক্তির দুই চোখের মাঝের নূরের উজ্জ্বলতা দেখে বিস্মিত হয়ে বলেন: হে আমার রব! এ ব্যক্তি কে? আল্লাহ তা‘আলা বলেন: এ তোমার সন্তানদের মধ্যে শেষ দিকে আসা জাতিসমূহের একজন ব্যক্তি যার নাম দাঊদ। আদম (আ.) বলেন : হে আমার রব! তার বয়স কত নির্ধারণ করেছেন? আল্লাহ তা’আলা বলেন : ষাট বছর। আদম (আ.) বলেন : হে আমার রব! আমি আমার বয়স থেকে চল্লিশ বছর তাকে দান করলাম। অতঃপর আদম (আ.)-এর বয়স পূর্ণ হলে যখন তার নিকট মৃত্যুর ফেরেশতা আসেন তখন তিনি বলেন : আমার বয়স কি আরও চল্লিশ বছর বাকি নেই? মৃত্যুর ফেরেশতা বলেন: আপনি কি আপনার সন্তান দাউদকে তা দান করেননি? আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আদম অস্বীকার করল, অতএব তার সন্তানরাও অস্বীকার করল। আদম ভুলে গেল, অতএব তার সন্তানরাও ভুলে গেল। আদম ভুল করল, অতএব তার সন্তানরাও ভুল করল।”(তিরমিযি)।

উপরোক্ত আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা রূহের জগতে প্রতিটি মানুষকে অণুর আকারে সৃষ্টি করে তাদের থেকে নিজের রুবুবিয়াতের (তিনি তাদের রব হওয়ার) স্বীকৃতি এবং তাঁর প্রতি তাদের উবুদিয়াতের (আনুগত্য ও দাসত্বের) চুক্তি গ্রহণ করেন। মায়ের গর্ভে সৃষ্ট দেহে রূহের সঞ্চার হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর সময় দেহ থেকে রূহ বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সময়কালকে দুনিয়ার জীবন বলা হয়।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন : “যিনি তাঁর সকল কিছু সৃষ্টি করেন উত্তমরূপে এবং কাদা মাটি হতে মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেন। তারপর তিনি তুচ্ছ পানি থেকে তার বংশধারা চালু করেন। তারপর তিনি তাকে সুগঠনে গঠিত করেন এবং তাতে নিজ প থেকে রূহ ফুঁকে দেন। আর তিনি তোমাদেরকে দান করেন কান, চোখ ও অন্তর। তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।”(আস্ সাজদাহ :৭-৯)।

ইবনু মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সর্বসমর্থিত সত্যবাদী রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আমাদেরকে বলেছেন : “তোমাদের প্রত্যেককে তার মায়ের পেটে চল্লিশ দিন পর্যন্ত শুক্র আকারে জমা রাখা হয়। অতঃপর তা রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়ে এই পরিমাণ সময় থাকে এবং পরে তা মাংসপিণ্ড আকারে অনুরূপ সময় জমা রাখা হয়। অতঃপর একজন ফেরেশতা পাঠানো হয়। তিনি তাতে রূহ ফুঁকে দেন এবং চারটি বিষয় লেখার আদেশ করা হয়। তাহলো : তার রিজিক, তার হায়াত, তার আমল ও সে দুর্ভাগ্যবান হবে অথবা সৌভাগ্যবান হবে। সেই সত্তার শপথ যিনি ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই! তোমাদের কেউ জান্নাতবাসীদের আমল করবে, এমনকি তার মাঝে ও জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাত ব্যবধান থাকবে। অতঃপর তার কিতাবের লিখন সামনে এসে উপস্থিত হবে। ফলে সে জাহান্নামীদের আমল করবে এবং তাতে প্রবেশ করবে। আর তোমাদের কেউ জাহান্নামীদের কাজ করবে, এমনকি তার মাঝে ও জাহান্নামের মাঝে মাত্র এক হাত ব্যবধান থাকবে। অতঃপর তার কিতাবের লিখন সামনে এসে উপস্থিত হবে। ফলে সে জান্নাতিদের আমল করবে এবং তাতে প্রবেশ করবে।” (বুখারী ও মুসলিম)।

“প্রতিটি জীবই মৃত্যুর আস্বাদ গ্রহণকারী এবং নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে। অতএব যাকে আগুন থেকে বিমুক্ত করে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে প্রকৃতপক্ষে সেই সফলকাম হবে। আর দুনিয়ার জীবন প্রতারণার ভোগ ছাড়া আর কিছুই নয়।” (আলে ইমরান : ১৮৫)।

উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসে এ দুনিয়ায় মানুষের সৃষ্টি ও এখানে তার জীবনের যবনিকার কথা বলা হয়েছে। এ দুনিয়ায় কৃত ভালো-মন্দ কাজের ভিত্তিতেই পরকালে তাকে জান্নাত অথবা জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। যাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে হবে পরম সফলকাম। আর যাকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে সে হবে চরম ব্যর্থ ও হতভাগ্য।

মানুষের জড় দেহ থেকে রূহ বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে তৎপরবর্তী জীবনকে পরকাল বলা হয়। পরকাল তিন স্তরে বিভক্ত, যথা: কবর, হাশর ও জান্নাত-জাহান্নাম। কুরআন মাজিদের প্রায় এক তৃতীয়াংশই পরকালের আলোচনায় সমৃদ্ধ। মানুষ শুধুমাত্র তার চতুষ্পার্শ্বে অবস্থিত এই দুনিয়ার জগতের কিছু বস্তু ও বিষয় তার জড় ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ ও অনুধাবন করে। আর অবশিষ্ট জগতসমূহের সকল কিছুই তার নিকট অদৃশ্য (গাঈব)। কুরআন-হাদিসে বর্ণিত সমস্ত অদৃশ্যের প্রতি স্বচ্ছ বিশ্বাস পোষণ করা ঈমানের অংশ।

মানুষ সাধারণত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু ও বিষয় দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। পক্ষান্তরে শ্রুত অদৃশ্য বস্তু ও বিষয় দ্বারা সে তেমন প্রভাবিত হয় না। অতএব কুরআন-হাদিসে বর্ণিত পরকালের বিষয়সমূহের ওপর ঈমান পোষণ করা সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষই তার চাইতে দুনিয়ায় তার চতুষ্পার্শ্বের দৃশ্যমান ঘটনাবলী দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। এমনিভাবে সুদূর ভবিষ্যতে প্রাপ্য কোন ফলাফলের চাইতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্ত ফলাফলের প্রতি তার মনে অধিক আগ্রহ, উৎসাহ ও গুরুত্ববোধ সৃষ্টি হয়। তাই অধিকাংশ মানুষই পরকালের সওয়াব ও পুরষ্কারের চাইতে দুনিয়ার কোন স্বার্থ ও উপকার হাসিলের প্রতি অধিক আগ্রহী ও উৎসাহী হয়। এমনিভাবে পরকালের ভয়াবহ শাস্তির চাইতে দুনিয়ার কোন শাস্তিকে বেশি ভয় করে। তবে সকল কালেই লক্ষ্য করা যায় যে, আল্লাহর অনেক বান্দাই পরকাল সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন ও নিজের আত্মার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ মানবিক দুর্বলতা থেকে নিজেদেরকে উত্তরণ করতে সম হয়েছে। তাই তারা দুনিয়ার চাইতে পরকালের স্বার্থ ও উপকারকে বেশি প্রাধান্য দেয় এবং দুনিয়ার যে কোন দুঃখ-কষ্ট ও শাস্তির চাইতে পরকালের দুঃখ-কষ্ট ও শাস্তিকে অনেক বেশি ভয় করে। বরং তাদের মাঝের অনেকেই পরকালের নাজাত ও পুরস্কারের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে দুনিয়ার জীবনের যে কোন ত্যাগ ও বিসর্জন পেশ করে। এমনকি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তারা অকাতরে নিজেদের জীবনও বিসর্জন দেয়।

আমাদের দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়, বরং মৃত্যুর পর পরকালের অনন্তকালীন জীবনে আমাদেরকে প্রবেশ করতে হবে। তথায় আল্লাহ তা‘আলার নিকট দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ও কাজের হিসাব দিতে হবে। দুনিয়ায় আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল (সা.) প্রদত্ত জীবনবিধান মেনে চললে পরকালে হিসাব-নিকাশের পর আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে অনন্তকালীন সুখের ঠিকানা জান্নাতে বসবাসের সুযোগ দান করবেন। প্রকৃতপক্ষে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সফলতা। আর দুনিয়ায় তাঁর দ্বীনের বিরুদ্ধাচরণ করলে পরকালে হিসাব-নিকাশের পর তিনি আমাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির ঠিকানা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। আর এটাই হলো সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ও পথভ্রষ্টতা। নাঊযু বিল্লাহি মিন্ যালিক !

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন : “প্রতিটি মানুষের কৃতকর্ম আমি তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছি। আর কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য একটা লেখা বের করব, যা সে খোলা কিতাব হিসাবে পাবে। তোমার আমলনামা পড়। আজ তোমার হিসাব নেবার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।”(বনি ইসরাঈল: ১৩,১৪)।

“আর যে সীমা লঙ্ঘন করে এবং দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয়, নিশ্চয়ই জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা। পক্ষান্তরে যে নিজ রবের সামনে দাঁড়ানোর ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রাখে, নিশ্চয়ই জান্নাতই হবে তার ঠিকানা।” (আন্ নাযি’আত: ৩৭-৪১)।

“নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে তাদের জন্যেই রয়েছে এমন জান্নাত যার তলদেশে ঝরনা প্রবাহিত। এটাই বড় সফলতা।” (আল বুরূজ : ১১)।

“যারা পরকালে বিশ্বাস করে না আমি তাদের পাপাচারসমূহকে তাদের কাছে শোভনীয় করে দিয়েছি, ফলে তারা বিভ্রান্তিতে ঘুরে বেড়ায়। এদেরই জন্যে আছে কঠিন শাস্তি এবং এরাই পরকালে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত।” (আন্ নাম্ল : ৪, ৫)।

পরকালে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর নিকট দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কাজের হিসাব দান করার তীব্র অনুভূতি ও বিশ্বাস ছাড়া মানুষের মৌলিক মানবীয় গুণাবলী ও নৈতিক চরিত্রের বিকাশ, উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার জীবনের সকল অন্যায়, অবিচার, বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির মূল কারণ হচ্ছে উক্ত অনুভূতি ও বিশ্বাসের অনুপস্থিতি। পরকালের প্রতি মজবুত বিশ্বাস যাবতীয় অন্যায় ও পাপাচারের মোকাবেলায় মানুষের নৈতিক চরিত্র সুরায় মূলত: একটি মজবুত ঢাল বা প্রাচীরস্বরূপ। পরকালের প্রতি বিশ্বাস ও কুরআন-হাদিসের প্রশিক্ষণ ছাড়া কারো কারো মধ্যে দুনিয়ার সাধারণ ব্যবহারিক জীবনে যে উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতা লক্ষ্য করা যায় প্রকৃতপক্ষে তার কোন মজবুত ভিত্তি ও রক্ষাকবচ নেই। তাই যে কোন মুহূর্তে তার পতন ঘটতে পারে। অতএব তার ওপর আশঙ্কাহীনভাবে নির্ভর করা যায় না।

আসলে দুনিয়া আমাদের প্রকৃত ও স্থায়ী বসবাসস্থল নয়, বরং আমাদের মূল ও স্থায়ী আবাসস্থল হচ্ছে জান্নাত। দুনিয়া হচ্ছে জান্নাতের গমন-পথ মাত্র। মূল গন্তব্যস্থলে পৌঁছার জন্য ভ্রমণকারী যেমন পথিমধ্যে স্বল্পকালীন আশ্রয়স্থল থেকে মূল গন্তব্যস্থলের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে ঠিক তেমন এ দুনিয়া থেকেই আমাদেরকে জান্নাতে যাওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। মূসা আ.এর দাওয়াতে ঈমান গ্রহণকারী ফির‘আঊনের চাচাত ভাই কিবতির কথা উদ্ধৃতি করে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন: “হে আমার কাওম! দুনিয়ার এ জীবন তো তুচ্ছ (ও অস্থায়ী) উপভোগের। নিশ্চয়ই চিরকাল বসবাসের জায়গা তো পরকালই।” (আল্ মু’মিন : ৩৯)। “এ দুনিয়ার জীবন এক মন ভুলানো বিষয় ও খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। নিশ্চয়ই পরকালের আবাসই প্রকৃত জীবন। হায়! এরা যদি তা জানত।”(আল্ আনকাবূত: ৬৪)। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) একটি চাটাইয়ের ওপর শুয়ে ঘুমান। ঘুম থেকে ওঠার পর আমরা তাঁর শরীরে চাটাইয়ের দাগ দেখে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যদি আপনার জন্য একটি তোশক বানিয়ে দিতাম! তিনি বলেন : “দুনিয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক? আমি তো দুনিয়াতে এরূপ একজন মুসাফির, যে গাছের ছায়াতলে বিশ্রাম নেয়, অতঃপর তা ত্যাগ করে চলে যায়।” (তিরমিযি)।

দুনিয়ায় তিনি মানুষের জন্য যে সুখ ও ভোগের ব্যবস্থা করেছেন তা পরকালে জান্নাতের সীমাহীন সুখের তুলনায় সুখ হিসেবেই গণ্য নয়। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেন: “আল্লাহ কাছে পৃথিবীর মূল্য যদি মশার ডানার সমতুল্যও হতো, তাহলে তিনি দুনিয়া থেকে এক চুমুক পানিও একজন কাফিরকেও পান করতে দিতেন না।” (তিরমিযি। সাহ্ল ইবনু সা’দ আস্সা’ইদী)।

অর্থাৎ দুনিয়া ও তন্মধ্যস্থ সমস্ত নিয়ামত তাঁর কাছে মশার ডানার চাইতেও তুচ্ছ। তাই তিনি মু’মিন-কাফির সকলকেই অবধারিতভাবে তা ভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। আর জান্নাতের সীমাহীন সুখ ও নি‘য়ামত সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : আল্লাহ তা’আলা বলেন : আমি আমার নেক্কার বান্দাদের জন্য এমন সব জিনিস প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কোনো কান তার বর্ণনা কখনো শুনেনি এবং কোনো মানুষ তা ধারণা বা কল্পনাও করতে পারেনি। এ কথার সমর্থনে তোমরা এ আয়াত পাঠ করতে পার : “তাদের নেক কাজের প্রতিদান স্বরূপ তাদের জন্য চু শীতলকারী যেসব সামগ্রী গোপন রাখা হয়েছে, তা কোনো প্রাণীই জানে না।” (বুখারী ও মুসলিম। আবু হুরাইরাহ্ (রা.)।

অতএব দুনিয়ার অবৈধ তুচ্ছ ও নগণ্য সুখ ভোগের জন্য বেসামাল হয়ে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ করে পরকালের অনন্তকালীন সীমাহীন সুখ থেকে নিজেকে বি ত করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এমনিভাবে পরকালে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির তুলনায় দুনিয়ায় আল্লাহর হুকুম পালনের কষ্ট কোন কষ্টই নয়। অতএব এ সামান্য কষ্ট পরিহার করে পরকালে জাহান্নামের সীমাহীন কষ্টকর শাস্তিকে নিজের জন্য বরণ করে নেয়া কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। দুনিয়ায় শুধুমাত্র আল্লাহর হুকুম মোতাবেক অর্জিত বৈধ সুখকে বরণ করে পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করাই মু’মিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেন :“কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য থেকে দুনিয়াতে সর্বাধিক প্রাচুর্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাজির করা হবে এবং তাকে জাহান্নামে ফেলে সাথে সাথে বের করে আনা হবে, অতঃপর তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো কোন কল্যাণ দেখেছ, তুমি কি কখনো প্রাচুর্যে দিন যাপন করেছ? সে বলবে, না, আল্লাহর শপথ! হে আমার রব! আবার জান্নাতিদের মধ্য থেকেও একজনকে হাজির করা হবে, যে দুনিয়াতে সবচাইতে দুর্দশা ও অভাবগ্রস্ত ছিল। অতঃপর তাকে দ্রুত জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে সাথে সাথে বের করে আনা হবে, অতঃপর জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি কখনো কোন অভাব দেখেছ, তুমি কি কখনো দুর্দশা ও অনটনের মধ্যে দিন যাপন করেছ? সে বলবে, না, আল্লাহর শপথ! আমি কখনো অভাব-অনটন দেখিনি এবং আমার ওপর দিয়ে কখনো কোন দুর্দশাও অতিবাহিত হয়নি।” (মুসলিম। আনাস রা.)। দুনিয়া ও পরকালের সুখ-দুখের মাঝের ব্যবধান ও পার্থক্য উপলব্ধি করার জন্য এ হাদিসটিই যথেষ্ট। দুনিয়ার জীবনের সবচেয়ে সুখী ব্যক্তিটি পরকালে দ্রুত জাহান্নামে প্রবেশ করে মুহূর্তের মধ্যেই বেরিয়ে আসার পরই দুনিয়ার জীবনের সমস্ত সুখের কথা ভুলে যাবে। এমনিভাবে দুনিয়ার জীবনের সবচেয়ে দুঃখী ব্যক্তিটি পরকালে দ্রুত জান্নাতে প্রবেশ করে মুহূর্তের মধ্যেই বেরিয়ে আসার পরই দুনিয়ার জীবনের সমস্ত দুখের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাবে। অতএব পরকালে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি থেকে নাজাত লাভ করে জান্নাতের অনন্তকালীন সীমাহীন সুখ হাসিল করার জন্য দুনিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে কোন ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করার জন্য মু’মিনের প্রস্তুত থাকা আবশ্যক।

আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এই দুনিয়ায় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করার মতো উপযোগী প্রতিটি উপায়-উপকরণ দান করেন। আল্লাহ্‌ প্রদত্ত উপায়-উপকরণাদির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে অতি সাবলীলভাবে সে আল্লাহর হুকুম মুতাবেক জীবন যাপন করতে পারে। কুরআন-হাদিসে বর্ণিত পরকাল সম্পর্কীয় বিষয়সমূহ এ বস্তুজগতের উপায়-উপকরণাদির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। যেমন প্রতিটি ব্যক্তির মৃত্যুর সময় তার নিকট ফেরেশতার আগমন, মৃত্যুগামী ব্যক্তির সাথে ফেরেশতার কথা বলা, রূহ কবজ করার পর তা ফেরেশতাদের সাথে আনা পাত্রে রাখা, কবরে মৃত ব্যক্তির দেহে পুনরায় রূহ দান করা, মুনকার-নাকীর ফেরেশতাদ্বয়ের তাকে প্রশ্ন করা, কবরবাসীর ওপর শাস্তি ও শান্তি নাজিল করা এবং কিয়ামত, হাশর, হিসাব, পুল অতিক্রম, জাহান্নামবাসীদের ওপর ভয়াবহ শাস্তি, জান্নাতবাসীদের জন্য সীমাহীন শান্তি ইত্যাদি। উক্ত সমস্ত বিষয় জড় ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করা মানুষের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। বর কুরআন-হাদিসে বর্ণিত সমস্ত অদৃশ্য (গাঈব) ও অতীন্দ্রিয় বিষয়ের ওপর অকুণ্ঠচিত্তে খাঁটিভাবে ঈমান পোষণ করে তার আলোকে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত শরীয়ত মোতাবেক জীবন যাপন করাই শুধু মানুষের দায়িত্ব। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন :“নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।” (আল্ বাকারাহ্ : ২০)। “নিশ্চয়ই তাঁর ব্যাপার শুধু এই যে, যখন তিনি কোন কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন তাকে হুকুম দেন, ‘হয়ে যাও’। আর সাথে সাথে তা হয়ে যায়।” (ইয়াসিন : ৮২)।

মানুষের দেহ থেকে শুরু করে আসমান-জমিন ও এর মাঝে আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতার হাজার হাজার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। মানুষ নিজের ইন্দ্রিয়াঙ্গসমূহ দ্বারা প্রতিনিয়ত তা প্রত্যক্ষ করে, অথচ এ জড় জগতের জ্যামিতিক ও গাণিতিক হিসাব-নিকাশের সাথে তার কোন মিল ও সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া তার পে সম্ভব নয়। যেমন, খালি চোখে দেখা যায় না এমন একটি শুক্র কীটকে মায়ের গর্ভে মানুষের আকৃতি দান করা, একটি মেয়াদান্তে তাতে রূহ দান করা, তাকে দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও অনুভূতিশক্তি দান করা, হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে রূহকে ধারণ করে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা, একটি মৃত দানা থেকে অতি দুর্বল লিকলিকে সবুজ-শ্যামল একটি জীবন্ত অঙ্কুর বের করে নিয়ে আসা, গাছের ডালের ভিতর থেকে ফুল অতঃপর সে ফুলের ভিতর থেকে অতি সুমিষ্ট সুস্বাদু উপকারী ফল উৎপন্ন করা, অথচ ঐ পূর্ণ গাছটির নির্যাস বের করলে এক ফোটা মিষ্টি রসও পাওয়া যাবে না! একটি মৃত ডিমের ভিতর থেকে জীবন্ত বাচ্চা বের করে নিয়ে আসা, একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মে চন্দ্র-সূর্যের আবর্তন ঘটানো, দিন-রাতের আবর্তন ঘটানো, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রতিটি জিনিসকে সংঘর্ষহীনভাবে নিজ নিজ কক্ষপথে চলমান রাখা, পৃথিবীতে অবস্থিত সাগর-নদীতে নিয়মিত জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থা করা, জোয়ারের সময় সাগরের পানির চাপে নদীসমূহের পানি ফুলে-ফেঁপে ওঠা ও ভাটার সময় নদ-নদীর পানি হ্রাস পেয়ে সাগরে ভেসে যাওয়া সত্ত্বেও লোনা পানির সাথে মিষ্টি পানির সংমিশ্রণ না ঘটানো, ঘোলা পানিবিশিষ্ট নদী ও স্বচ্ছ পানিবিশিষ্ট নদী পরস্পর পাশাপাশি প্রবহমান হওয়া সত্ত্বেও ঘোলা পানির সাথে স্বচ্ছ পানির সংমিশ্রণ না ঘটানো, মানুষের গুনাহের কারণে অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি সৃষ্টি করা, কয়েক সেকেন্ডের ভূমিকম্পে কোন কোন জনপদকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দেয়া, কয়েক সেকেন্ডের ঘূর্ণিঝড়ে কোন কোন এলাকাকে ল-ভ- করে দেয়া, সমুদ্রের তলদেশে ফাটল সৃষ্টির মাধ্যমে একই সাথে ভূমিকম্প ও আগুনের লেলিহান শিখাবিশিষ্ট ৩০/৪০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কোন কোন উপকূলীয় অ লকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দেয়া ইত্যাদি। আল্লাহর সীমাহীন কুদরতের এ ধরনের আরও শত শত নিদর্শনকে একমাত্র তাঁর কুদরত দ্বারাই উপলব্ধি করা সম্ভব। যেহেতু তাঁর কুদরতকে পরিমাপ করার মতো তাঁর কুদরত ছাড়া অন্য কোনো বৈষয়িক নিক্তি সৃষ্টিজগতের কোথাও তিনি সৃষ্টি করেননি। যেই মহান সত্তা এই জড় ও নশ্বর পৃথিবীতে মানুষের চোখের সামনেই এই ধরনের সীমাহীন বিস্ময়কর শত শত কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেন তিনি কুরআন-হাদিসে ঘোষিত পরকালীন সমগ্র বিষয়ও নিশ্চয় সংঘটিত করতে সক্ষম।

প্রতিটি মু’মিনের সমস্ত কার্যক্রম মৌলিকভাবে দুইভাগে বিভক্ত, যথা : (১) আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর প থেকে প্রদত্ত ব্যক্তিগত ও আনুষ্ঠানিক ইবাদত। যেমন : নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দু’আ, জিকর, তিলাওয়াতুল কুরআন, দ্বীনের দাওয়াত ইত্যাদি। (২) ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় তথা আন্তর্জাতিক জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সামগ্রিক কর্মকাণ্ড। মু’মিনের ব্যবহারিক জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট উক্ত সমস্ত কর্মকাণ্ড আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর বাতানো পদ্ধতিতে সম্পাদিত হলে তা সবই আল্লাহর নিকট ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। ইহ ও পরকালে তিনি মু’মিনকে এর যথাযথ বিনিময় প্রদান করেন। অতএব মু’মিনের দুনিয়ার কাজ ও পরকালের কাজের মাঝে কোন পার্থক্য ও ব্যবধান নেই। বরং একই কাজের মাধ্যমে মু’মিন ইহ ও পরকালের উদ্দেশ্য ও সাফল্য অর্জন করে। লক্ষ্য করা যায় যে, কোন কোন মু’মিন ব্যবহারিক জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট উক্ত কর্মতৎপরতাকে নিছক দুনিয়ার কাজ মনে করে তার প্রতি অনীহা ও ঘৃণা প্রকাশ করে এবং যথাসাধ্য তা থেকে বিরত ও নিঃস্পৃহ থাকার চেষ্টা করে। এটি মূলত: আল্লাহ্‌ প্রদত্ত ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকারই প্রমাণ।

দুনিয়ার জীবনের সমস্ত উপায়-উপকরণ আল্লাহ্‌ প্রদত্ত নি‘য়ামত। এসব উপকরণের ব্যবহার ছাড়া মানুষের দুনিয়ায় বেঁচে থাকা যেমন সম্ভব নয়, তেমন ব্যক্তিগত ও আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমূহ সফল ও সার্থকভাবে আদায় করাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন : (হে রাসূল !) “আপনি বলুন যে, আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সব শোভনীয় বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে নিষিদ্ধ করেছে? আপনি ঘোষণা করে দিন: এ সব বস্তু পার্থিব জীবনে, বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে ঐ সব লোকের জন্যে যারা মু’মিন হবে।” (আল্ আ’রাফ : ৩২)। আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদেরকে যে যুগে যে ধরনের নিয়ামত ও উপকরণ দান করেন সে যুগে সে ধরনের উপকরণের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমেই তারা দ্বীন ও দুনিয়ার সর্বাত্মক কল্যাণ লাভ করতে পারে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের যুগে স্থল পথে উট, গাধা ও খচ্চর এবং নৌপথে নৌকা ছিল যাতায়াতের প্রধান বাহন ও উপায়। তাঁরা এর সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধ, দাওয়াতি কাজ, পণ্য বহন তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল প্রকার যোগাযোগ সম্পন্ন করতেন। উক্ত বাহনসমূহের ব্যবহার ছাড়া মাত্র কয়েক ঘণ্টা জীবন যাপন করাও তাঁদের পে সম্ভব ছিল না। বর্তমান যুগে আকাশ পথে উড়োজাহাজ, স্থলপথে রেল ও মোটর গাড়ি এবং নৌপথে জাহাজ হচ্ছে যোগাযোগের প্রধান বাহন। উক্ত বাহনসমূহের ব্যবহার ছাড়া বর্তমান যুগে দ্বীন ও দুনিয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা কল্পনাই করা যায় না। বর্তমান যুগে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত সর্বাধিক বিস্ময়কর নি‘য়ামত হচ্ছে কম্পিউটার। এর শত শত ধরনের ব্যবহার মানুষের জীবনকে যে কত উন্নত, সহজ ও আরামদায়ক করে তুলেছে তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। এর সঠিক ও মার্জিত ব্যবহার দ্বারা মানুষ তার বৈষয়িক সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে যেমন অতীব সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারে তেমন তার দ্বীনি কাজসমূহও অধিক সফল ও সার্থকভাবে সম্পন্ন করে ইহ ও পরকালীন কল্যাণ দ্বারা তার জীবনকে ধন্য ও মহিমান্বিত করে তুলতে পারে। এভাবে আল্লাহর প্রতিটি নিয়ামতের বেলায়ই এ কথা প্রযোজ্য। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন : “তোমাদের কাছে যে সমস্ত নিয়ামত আছে তা আল্লাহরই পক্ষ থেকে।” (আন্ নাহল: ৫৩)।

অতএব আল্লাহ্‌ প্রদত্ত নিয়ামতসমূহের সঠিক ও মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমেই মু‘মিনকে পরকালীন সুখ ও সাফল্য অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এটি মানুষের স্বভাবসুলভ অভ্যাস যে, যে কোন বিষয়ই যতই গুরুত্বপূর্ণ, বিস্ময়কর, ভয়ানক অথবা আনন্দদায়কই হোকনা কেন তার বর্ণনা শোনার চাইতে তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করা দ্বারা সে অনেক বেশি প্রভাবিত হয়। অতএব কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত মৃত্যু, কবর, কিয়ামত, হাশর, হিসাব, সিরাত, জান্নাত ও জাহান্নামের অবস্থা সম্পর্কে শোনা ও জানার পরও অধিকাংশ মানুষই তেমন ভীত ও প্রভাবিত হয় না এবং তার কঠিন বাস্তবতার কথা তীব্রভাবে উপলব্ধি করে না। তাই লক্ষ্য করা যায় যে, উক্ত বিষয়সমূহের প্রতি বিশ্বাস পোষণকারীদের অনেকেই তা অবিশ্বাস ও অস্বীকার করার মতই নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে, নির্দ্বিধায় ও নির্ভয়ে পাপ কাজ করে। যে ব্যক্তি যত মজবুত বিশ্বাস, আন্তরিকতা, গুরুত্ব ও নিষ্ঠা সহকারে উক্ত বিষয়সমূহ অধ্যয়ন করে এবং হৃদয়ে তার চিত্র যত মজবুতভাবে অংকিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে পারে সে তা দ্বারা তত বেশি প্রভাবিত হয়।

এমনকি কেউ কেউ কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত উক্ত বিষয়সমূহ শুধুমাত্র শোনা, জানা ও অধ্যয়ন করা দ্বারাই তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করার মতই তা দ্বারা তীব্রভাবে প্রভাবিত হয়। অতীত ও বর্তমান সকল কালেই যেমনটি আমরা অনেকের জীবনে লক্ষ্য করি।

স্বাভাবিক স্বভাবসুলভ মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে ওঠে হৃদয়ে পরকালের উক্ত বিষয়সমূহের ব্যাপারে আবেগ, অনুভূতি, আগ্রহ ও কৌতূহল সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন হচ্ছে গভীর অধ্যয়ন ও অনুশীলন এবং ইহ ও পরকালের জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা।

কুরআন ও হাদিসের আলোকে পরকাল সম্পর্কে পর্যাপ্ত অধ্যয়নের অভাবে এ ব্যাপারে মনে পর্যায়ক্রমে উদাসীনতা, অনাগ্রহ, নির্ভয়তা ও দূরত্ব বৃদ্ধি পায় এবং তা ব্যক্তিকে বেশি বেশি পাপ কাজে লিপ্ত হতে সাহায্য করে। যেহেতু পরকাল থেকে বিমুখ করে বিভিন্ন পাপ কাজে লিপ্ত করার মতো শত শত আকর্ষণীয় উপায়-উপকরণ তার চতুষ্পার্শ্বে ছড়িয়ে আছে।

এ জড় ও নশ্বর পৃথিবীতে অবস্থান করে মৃত্যু ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলীর ভয়াবহতা ও বিভীষিকার প্রকৃত ও বাস্তব অবস্থা কল্পনা ও উপলব্ধি করার মতো ক্ষমতা মানুষের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের নেই। মানুষ এ পৃথিবী থেকে ঐ অতীন্দ্রিয় ঘটনাবলী সম্পর্কে যাই কল্পনা করুক না কেন প্রকৃত অবস্থা হবে তার চাইতেও আরও অনেক অনেক বেশি ভয়াবহ ও তীব্র, যা একমাত্র ঐ পরিস্থিতির মাঝে পতিত হওয়ার পরই উপলব্ধি করা যাবে। ঐ জগতে প্রবেশ করার পর অসংখ্য মানুষের নিকটই দুনিয়ায় ঐ জগত সম্পর্কে তাদের কষা হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণিত হবে। কিন্তু তখন আর ভুল সংশোধন করার সুযোগ থাকবে না। অতএব প্রতিটি মানুষেরই কুরআন ও হাদিসের মাপকাঠিতে বার বার ঐ জগত সম্পর্কে নিজের হিসাব মিলিয়ে দেখা জরুরি।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.