Sylhet Today 24 PRINT

জেনারেশন গ্যাপ : নাগরিক সমাজের এক নীরব ব্যাধি

প্রিয়াংকা সেনগুপ্ত পিয়া |  ০৫ জানুয়ারী, ২০১৬

জেনারেশন গ্যাপ, সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত কিন্তু কম গুরুত্ব পাওয়া একটি সামাজিক সমস্যা। বিশেষ করে গত দুই দশকে এই বিষয়টা পত্র পত্রিকা বা টিভি মিডিয়াতে বিভিন্নভাবে আলোচনায় উঠে আসলেও এর নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে বা সমাজ কাঠামোয় এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে খুব একটা আলোচনা বা পর্যালোচনা চোখে পড়ে না। গুরুত্বের বিবেচনায় আমি মনে করি এটা নিয়ে আরও গভীরে চিন্তা-ভাবনা ও বিচার বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।

সেই প্রয়োজনবোধ থেকে আমি আমার চিন্তা ভাবনাগুলো এখানে তুলে ধরছি।

তবে তার আগে আসুন আমরা তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যপট থেকে চোখ বুলিয়ে আসি।

দৃশ্যপট-১
প্রথম দৃশ্যপটে উপস্থিত আছেন সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা অষ্টাদশী তরুণী লিমা এবং তার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মা। লিমা গেছেন তার এক বান্ধবীর বাসায়। আজ লিমার বান্ধবীর জন্মদিন, বিরাট আয়োজন। তাই অনেক হৈ-হুল্লোড় আর মৌজ-মাস্তি করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে বেশ রাত হয়ে গেলো। এদিকে লিমার মা ভয়ে-দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে একবার ঘরের ভিতর আরেকবার বারান্দায় পায়চারি করছেন। এর আগে কখনো তার মেয়ে সন্ধ্যার এতো পরে বাড়ির বাইরে থাকেনি। যদিও মেয়ে বলেই গিয়েছে ফিরতে রাত হবে এবং কোথায় গেছে তাও তার জানা, তবুও এক অজানা আতঙ্কে কিছুক্ষণ পর পরই তার পেটের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠছে। রাত ন’টার দিকে যখন লিমার গলার শব্দ পেলেন তখনই তার ভয় আর উদ্বেগ কিছুটা কমলো। অবশ্য সাথে সাথেই প্রচণ্ড বিরক্তি ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। মেয়ে বারান্দায় পা ফেলতেই গলা চড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন মেয়ের দিকে-

“এতক্ষণে তোর আসার সময় হল? তোর সাহস কিন্তু বেশ বেড়ে যাচ্ছে লিমা। রাত কটা বাজে খেয়াল আছে?”

“কই কটা বাজে? জন্মদিনের অনুষ্ঠানে একটু দেরি তো হবেই। আর আমি কি ৫ বছরের ছোট বাচ্চা? এত চিন্তা করার কি আছে?” মাকে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করল লিমা। কিন্তু মা নিশ্চিন্ত হলেন বলে মনে হল না। গজগজ করে বলতে লাগলেন,

“বাচ্চা নও বলেই চিন্তা টা বেশি। তা ওখানে আর কে কে ছিল?”

চোখ সরু করে মায়ের দিকে তাকায় লিমা। “তুমি কি আমাকে কোনভাবে সন্দেহ করছো? কে কে ছিল মানে কি? আমি কি তোমায় মিথ্যা কথা বলে গেছি?”

মা দৃষ্টি সরিয়ে নেন লিমার চোখ থেকে। একটু অন্য দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, “এতো তর্ক করছিস কেন? কে কে ছিল বলতে অসুবিধা কি?

“এইতো রিমি, নাদিয়া, সারা, মোনামি, রাফিদ, রায়ান, অর্ক আমরা এই কজনই।”

মিইয়ে যাওয়া বিরক্তিটা আবার ডালপালা মেললো, সেইসাথে কিঞ্চিৎ বিস্ময়ও। ভীষণ কালো মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন,

“মানে!!? ওখানে ছেলেরা যাবে এটা তো তুমি আমাকে বলোনি? তোমরা কি এখন ছেলেদের সাথেও মেলামেশা কর নাকি??

এবার লিমার বিরক্ত হওয়ার পালা। “মানে কি মা? ছেলেদের সাথে মেলামেশা মানে কি? ওরা আমার বন্ধু।”

“হু!! আমাকে বন্ধুত্ব শেখাতে এসো না। ঘি আর আগুনে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। একটা কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিই, ছেলেদের সাথে মেলামেশা করা আজ থেকে পুরোপুরি বন্ধ। তোমার বাবা এগুলো পছন্দ করেন না।”

লিমার বিরক্তি এখন ভীষণ ক্রোধে পরিণত হয়। “মা,শোন আমি এখন আর স্কুলের বাচ্চা মেয়ে না। অনার্স লাইফে ছেলে মেয়ে একসাথেই লেখাপড়া করে। বন্ধুত্ব এখানে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। যাইহোক, তোমার মত সেকেলে মানুষ এগুলো কিছুতেই বুঝবে না। তোমার সাথে কথা বলে মেজাজ নষ্ট করার কোন মানে নাই। আমি গেলাম।” বলে লিমা হনহন করে তার ঘরে চলে যায়।

মা ভীষণ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের যাওয়ার পথের দিকে। সারাক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে ঘোরা, ভীতুভীতু আদুরে মেয়েটাকে যেন চিনতেই পারছেন না তিনি। এই সেদিনের এইটুকুনই পুঁচকে মেয়েটা এতো বদলে গেলো কি করে!!!!

দৃশ্যপট-২
আমরা এখন আছি একটা আবাসিক এলাকার ক্লাবঘরে। বনেদী পাড়ার পুরনো ক্লাব। পনেরো থেকে পঞ্চাশ, সকল বয়সের সদস্যরাই যার যার নিজের বন্ধু সার্কেল নিয়ে এখানে সক্রিয়।এই মুহূর্তে এখানে একটা জমজমাট সভা হচ্ছে। আসন্ন বিজয় দিবসকে কিভাবে উদযাপন করা হবে তা নিয়ে সরগরম আলোচনা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হল অনুষ্ঠান এর শুরুতে হবে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা আর তারপর হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংক্রান্ত আলোচনায় এসেই ক্লাবের জুনিয়র আর সিনিয়রদের মধ্যে মতভিন্নতা তৈরি হয়ে গেলো।

জুনিয়রদের চাওয়া হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেশাত্মবোধক গান হোক, তবে সেটা অবশ্যই আধুনিক রিমিক্স ভার্সনে। সাথে এবার ডিজে মিউজিকও রাখতে হবে। এই আবদার শুনে সিনিয়ররা একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। বলে কি এই ছেলেরা! এসব কি শুনতে হচ্ছে তাদের!! এও হয় নাকি!!! সাথে সাথেই তুমুল প্রতিবাদ উঠলো সমবেত কন্ঠে।

গলার জোর কি জুনিয়রদেরও কম আছে? তারাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? শুরু হল প্রচণ্ড হট্টগোল। অনেকক্ষণ বাকবিতণ্ডা চলার পর এক পর্যায়ে এক জুনিয়র বলেই দিল, “এই ব্যাকডেটেড দের সাথে কোন আলোচনায় আসাই উচিত না।” শোনামাত্রই সিনিয়ররা আবার হুংকার ছাড়লেন সমস্বরে। এ! বলে কি? সেদিনকার ছেলে-ছোকরাদের কি দুঃসাহস। মুখের উপর এমন কথা বলে দিল!!!

অতঃপর অনেক হল্লা-চিৎকার করে, অনেক বুঝা এবং বুঝানোর পরে অবশেষে সাধারণ সভার সমাপ্তি ঘটল এবং বলাই বাহুল্য কোন ধরণের সিদ্ধান্ত না নিয়ে।

দৃশ্যপট-৩
আমাদের এবারের ঘটনা জেলার প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারী কলেজের টিচার্স কমন রুমে। কলেজের ইতিহাস ডিপার্টমেন্ট এর সহযোগী অধ্যাপক সালাম সাহেব কে খুব বিমর্ষ আর ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় কমন রুম এ বসে থাকতে দেখা গেলো। ব্যাপারটা খেয়াল করলেন পাশের চেয়ারে বসা ম্যাথমেটিক্স ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক রফিক আহমেদ। দুজনে প্রায় সমবয়েসি এবং চাকরির শুরুতে একই দিনে কলেজে জয়েন করেছিলেন। তাই তাদের দুজনের মধ্যে হৃদ্যতা অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই। সালাম সাহেবের এমন নাস্তানাবুদ চেহারা দেখে রফিক সাহেব খানিকটা কৌতুকের সুরে প্রশ্ন করলেন-

কি অবস্থা সালাম ভাই, এখানে এমন জবুথুবু হয়ে বসে আছেন যে? আপনি তো বিরাট ব্যস্ত মানুষ। সচরাচর তো এখানে দেখাই যায় না। তা বিষয় কি? ভাবীর সাথে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?

সালাম সাহেব দুর্বলভাবে জবাব দিলেন, “না তেমন কিছু না। ঠিক আছি, আমি ঠিক আছি।”

রফিক সাহেব বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটা মোটেও ঠিক নেই। এবার একটু সিরিয়াস হয়েই বললেন, “কিছু একটা তো আছেই। আপনি চাইলে আমাকে বলতে পারেন।”

এবার সালাম সাহেব আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন, কি আর বলবো রে ভাই এখনকার ছেলেমেয়েগুলো এত বেয়াড়া হয়ে উঠছে! ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আর আগের মত থাকছে না।

রফিক সাহেব এবার একটু কাছে সরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন? কি সমস্যা? কেউ কিছু বলেছে আপনাকে?”

সালাম সাহেব তার চশমার কাচ রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বলতে লাগলেন, “আজ ক্লাসে একটা বিষয় বুঝাচ্ছিলাম, তার মাঝে এক ছাত্র হঠাৎ করে বলে উঠল, আমি যে ডেফিনিশনটা দিচ্ছিলাম তা নাকি এখন বাতিল হয়ে গেছে। এখনকার ইতিহাসবিদরা নাকি বিষয়টাকে আর এভাবে দেখেন না। কি বেয়াদব ভাবুন তো একবার! আমি এত্ত বছর ধরে এই সাবজেক্টপড়াচ্ছি, কারো সাহস হয় নাই আমার লেকচার নিয়ে প্রশ্ন করার। আর সেদিনকার এইটুকুনই ছোঁড়া আমাকে ইতিহাসবিদ দেখাচ্ছে। এক ধমক দিয়ে ওকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছি। এখন অবশ্য মনে হচ্ছে, এটা একটু বেশিই করে ফেলেছি। এতোটা উত্তেজিত না হলেও চলত।”

এইটুকু বলে খানিকটা নিঃশ্বাস নিলেন সালাম সাহেব। এরপর আবার বিমর্ষ কন্ঠে বলতে লাগলেন, “কি করব বলুন?ডায়াবেটিসের কারণে এখন মেজাজটা আর সামলে রাখতে পারি না। প্রায়ই মাথা গরম হয়ে যায়। যাইহোক, কিছুক্ষণ আগে দপ্তরী কৃষ্ণ এসে জানালো যে, ছেলেটা নাকি সরকারী দলের বড় পাণ্ডা। বড় বড় নেতাদের সাথে উঠাবসা তার। এখন নাকি কলেজ গেটের কাছে একদল ছেলেপিলে নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমার সাথে কি একটা বুঝাপড়া করবে। কি যে করব বুঝে উঠতে পারছি না। এই শেষ বয়সে এসে এমন বিড়ম্বনায় পড়ব কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।”

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। গণিতের শিক্ষক রফিক সাহেব এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন তার সহকর্মীর কথা। চটপটে মানুষ তিনি, অনেক বেশি আপডেটেডও। তিনি ভালোভাবেই জানেন কিভাবে জলে নেমে কুমিরের সাথে লড়াই না করে বরং তাল মিলিয়ে বাঁচতে হয়। এসব গণ্ডগোল তাকে প্রায়-প্রায়ই সামাল দিতে হয়। তিনি আশ্বস্ত করলেন সালাম সাহেবকে, “আরে আপনি এতো ভাববেন না তো। এসব ছেলেদের কিভাবে বশ করতে হয় তা আমার ভালোই জানা আছে।” বলে বেরিয়ে গেলেন কমন রুম থেকে। এরপর হাঁকডাক করে ছেলেদের নিয়ে এসে কখনো আদর করে কখনো আলতো ধমক দিয়ে সালাম সাহেবের সাথে মিটিয়ে দিলেন সব ঝামেলা। ছেলেরা শিষ দিতে দিতে চলে গেলো নিজেদের পথে। সালাম সাহেব একটু নির্ভার হয়ে হাঁটা ধরলেন বাড়ির পথে।

এই তিনটা দৃশ্য ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা এবং ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র নিয়ে হলেও তিনটি জায়গাতেই একটা বিষয়ে ভীষণ সাদৃশ্য আছে, আর সেটা হচ্ছে, “জেনারেশন গ্যাপ”। তো আসুন চেষ্টা করি “জেনারেশন গ্যাপ” বা বাংলায় বলতে গেলে “প্রজন্মের বৈসাদৃশ্য” বিষয়টাকে একাডেমিক চেহারায় সংজ্ঞায়িত করতে। এক কথায় বলতে গেলে জেনারেশন গ্যাপ বা প্রজন্মের বৈসাদৃশ্য হচ্ছে এক প্রজন্মের সাথে অন্য প্রজন্মের মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি-সংস্কৃতি, মতামত প্রকাশের ঢং, পরস্পরের মতকে মূল্যায়ন করার পদ্ধতি ইত্যাদির বৈসাদৃশ্য।

আমাদের চারপাশে একটু ভালোভাবে তাকালেই ব্যাপারটা খুব সহজে বুঝা যায়। যেমন ধরতে পারি উপরে উল্লেখিত প্রথম দৃশ্যপটের কথা। প্রায় সব পরিবারেই বাবা-মা এবং সন্তানদের মাঝে এক ধরণের অদৃশ্য দেয়াল খুব প্রকটভাবে চোখে পড়ে। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে প্রায় সব বাবা-মায়েরই একটা সাধারণ আক্ষেপ তৈরি হতে থাকে যে, তাদের সন্তানরা আর তাদের কথা ঠিকঠাক শুনছে না।

তাদেরই হাতে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সাধনার ধনকে একটা সময় পরে খুব বেশি অচেনা মনে হয়। আবার সন্তানদের দিক থেকেও ভীষণ অভিমান সময়ে-অসময়ে ফুঁসে উঠে। কেবলই মনে হয় বাবা মায়েরা কখনোই তাদের কথা শুনতে চান না, বুঝতে চান না। তারা সব সময়ই নিজেদের ভালোলাগা-মন্দলাগাগুলো সন্তানদের উপর চাপিয়ে দিতে চান। এই চাপিয়ে দেয়ার বিষয়টা আমাদের সমাজে সবসময়ই ছিল কিন্তু দ্বন্দ্ব সংঘাত খুব বেশি ছিল না।

কিন্তু সময়ের হাত ধরে নাগরিক সংস্কৃতি যত বিকশিত হচ্ছে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণাগুলো যতবেশি মজবুত হচ্ছে ততই যেন একাধিক প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মাঝে যুদ্ধংদেহী মনোভাব তীব্রভাবে গড়ে উঠছে। আর এই যুদ্ধক্ষেত্র শুধু যে পরিবারের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী সংগঠন, স্কুল-কলেজ সহ যেখানেই একাধিক মানুষের সমাবেশ, সেখানেই এই যুযুধান পরিস্থিতি লক্ষণীয়। বিভিন্ন সংগঠনে সিনিয়র-জুনিয়রদের যে দ্বন্দ্ব কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যে অসহিষ্ণুতা(যা আমরা দ্বিতীয় বা তৃতীয় দৃশ্যপটে দেখেছি) তার পেছনের অন্যতম কারণ হচ্ছে এই জেনারেশন গ্যাপ।

যার ফলে পারিবারিক অশান্তি, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা, শিক্ষাঙ্গনের বিনষ্ট পরিবেশ ইত্যাদি কারণে সামগ্রিকভাবে সামাজিক অগ্রগতির ধারা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়, কখনো কখনো বিপর্যস্তও হয়। অথচ একটু সচেতনতা ও দৃষ্টিভঙ্গির একটু পরিবর্তনের মাধ্যমেই এই অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যাগুলো খুব সহজেই এড়ানো যেতে পারে। সেই আলোচনায় পরে যাচ্ছি তবে আগে এই জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হওয়ার পেছনের কারণগুলোর সুলুক-সন্ধান করে নেয়া দরকার।

জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হওয়ার প্রধানতম কারণই হচ্ছে, কমিউনিকেশন গ্যাপ বা যোগাযোগ স্থাপনের সংকট। যোগাযোগ বলতে এখানে শুধু কথা বলতে পারা বা শুনে বুঝতে পারাকে বুঝানো হচ্ছে না। অনেক ব্যাপার থাকে যা বলার পরেও অপ্রকাশিত থেকে যায়। কমিউনিকেশন গ্যাপ বলতে এক প্রজন্মের সাথে আরেক প্রজন্মের যথাযথ মত বিনিময় এর পরও এক ধরণের দুর্বোধ্যতা বা অস্পষ্টতা থেকে যাওয়াকেই বোঝানো হয়েছে।

প্রথম দৃশ্যপটের দিকে আরেকবার তাকালে ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্ট হবে বলে মনে হয়। এই যে লিমার মা, তার মেয়ের সন্ধ্যার পরে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়াটা মোটেই পছন্দ করেন না। কিংবা তার অনেকগুলো ছেলেবন্ধু থাক এবং সেই ছেলেদের সাথে সে সময় কাটাক এটা তিনি চান না। এই অপছন্দটা মা হিসেবে তিনি তার মেয়েকে খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, মেয়েও সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে মায়ের যে উদ্বেগ, নিরাপত্তাহীনতাজনিত উৎকণ্ঠা তা কিন্তু মেয়ের উপলব্ধিতে নিয়ে আসতে পারেননি। মেয়ের মনে হচ্ছে, মা এখনও তাকে ছোট্ট খুকি ভাবছেন এবং অযথাই তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। ফলে অবধারিতভাবেই একটা সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আর এই যে মা তার মনের অনুভূতিগুলোকে মেয়ের কাছে পরিপূর্ণভাবে ব্যক্ত করতে পারলেন না, তাকেই আমি যোগাযোগের সংকট বা কমিউনিকেশন গ্যাপ বলে অভিহিত করছি।

তো আসুন এবার দেখে নেই যোগাযোগের সংকট তৈরি হওয়ার পেছনে কি কি কারণ থাকতে পারে যা জেনারেশন গ্যাপের মত একটি অনাকাঙ্ক্ষিত সামাজিক ব্যাধি তৈরি করছে। আমার দৃষ্টিতে কমিউনিকেশন গ্যাপ বা যোগাযোগ সংকটের পেছনে অনেক কারণই আছে তবে তার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে, পুরনো গুরুবাদী সংস্কৃতি, পুরনোদের যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন সংস্কৃতিতে আত্মস্থ হতে না পারা, পুরনোদের পক্ষ থেকে নতুনদের উপর যেকোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা, নতুনদের মাঝে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সবজান্তা মনোভাব, পরমত অসহিষ্ণুতা এবং কমবেশি সবার মাঝেই আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা ইত্যাদি। এই সবকিছু মিলিয়েই দুই প্রজন্মের মধ্যে তৈরি হচ্ছে পাহাড় প্রমাণ বৈরিতা, যোজন যোজন দূরত্ব।

ফলে এই দূরত্ব যদি ঘুচাতে হয়, বৈরিতা যদি মিটাতে হয় তবে উপরে উল্লেখ করা সমস্যাগুলোর সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। আরও যদি কোন সমস্যা থেকে থাকে অন্তরালে, তবে তা উন্মোচন করতে হবে এবং তার সমাধানের পথ উদঘাটন করতে হবে।

আমাদের দেশ এমনিতেই হাজারটা সমস্যায় জর্জরিত, দেশের অগ্রগতি রুদ্ধ হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ ইতিমধ্যেই সক্রিয়। তাই যে সমস্যা একটু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অথবা একটু উদার মানসিকতার চর্চার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব তা নিয়ে আর গড়িমসি করার কোন মানে হয় না। আমরা সবাই যদি যে যার জায়গা থেকে বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবি, খোলামেলা আলোচনা করি এবং আশেপাশের দশজনকে ভাবতে উৎসাহিত করি তাহলেই হয়তো এই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.