মিহিরকান্তি চৌধুরী | ০৩ অক্টোবর, ২০২৫
ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ ডা. আহমদ রফিক (১৯২৯–২০২৫) ছিলেন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ৯৬ বছরের দীর্ঘ জীবন তিনি কাটিয়েছেন একাধারে সংগ্রাম, সাধনা ও সৃষ্টিশীলতায়।
চিকিৎসক হয়েও তিনি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও ইতিহাসচর্চায়, এবং দেখিয়েছিলেন—মানুষের সেবার প্রকৃত রূপ কেবল দেহ নয়, মনন ও চেতনার জগতেও বিস্তৃত। ভাষা আন্দোলনে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা, রবীন্দ্রচিন্তার গভীর বিশ্লেষণ এবং সমাজ-বাস্তবতা নিয়ে নিরলস গবেষণা তাঁকে যুগস্রষ্টা চিন্তকের মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে আমরা হারালাম এক দিকপাল, যার অনুপস্থিতি আজীবন বাঙালি সংস্কৃতি, মুক্তিচেতনা ও মননের পরিসরে গভীরভাবে অনুভূত হবে।
ভাষা আন্দোলনের সৈনিক
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আহমদ রফিক নিজেকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছেন। তিনি কেবল মিছিলের মানুষ ছিলেন না, ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রামাণ্য ইতিহাসলেখক। তাঁর গ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলন: ইতিহাস ও তাৎপর্য ’এবং ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও কিছু জিজ্ঞাসা ’ আমাদের সেই আন্দোলনের অনন্য দলিল। আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও ত্যাগকে তিনি বইয়ের পাতায় সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি শুধু ইতিহাস লিখেননি, ভাষার মর্যাদা ও জাতিসত্তার প্রশ্নে আমাদের চেতনার পুনর্গঠন করেছেন।
রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ ও চিন্তার অগ্রপথিক
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্থান যে অনন্য ও অমোঘ, তা কারো অজানা নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে কেবল কবি, গল্পকার, নাট্যকার বা সুরকার হিসেবে আবদ্ধ না রেখে তাঁর সামগ্রিক চিন্তাজগতকে বিশ্লেষণ করে যাঁরা সমাজ-ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন, তাঁদের মধ্যে আহমদ রফিক অগ্রগণ্য। তিনি রবীন্দ্রচিন্তাকে শুধু সাহিত্যিক উচ্চতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং সেটিকে তিনি বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে জড়িয়ে দেখেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে তাঁর গভীর অনুসন্ধান প্রমাণ করেছে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজের রূপকারের স্বপ্নদ্রষ্টা। বিশেষ করে গ্রামোন্নয়ন ভাবনা, কৃষি সংস্কার, শিক্ষাব্যবস্থা, মানবিক উন্নয়ন—এসব ক্ষেত্রকে রবীন্দ্রনাথ যেমন নিজের সময়েই ভেবেছিলেন, তেমনি আহমদ রফিক সেই ভাবনাগুলোকে নতুন সময়ের আলোয় বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর প্রবন্ধসমূহে রবীন্দ্রনাথের পল্লি-পুনর্গঠন ভাবনা ও বাস্তব প্রয়াসের সাথে বাংলাদেশের উন্নয়নচিন্তার যোগসূত্র অনুপুঙ্খভাবে উঠে এসেছে। আহমদ রফিক বারবার দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ কেবল নন্দনচেতনার কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাস্তবমুখী সমাজচিন্তক। শান্তিনিকেতনের শিক্ষা-প্রয়াস কিংবা পতিসরের কৃষি উন্নয়নমূলক কর্মসূচিকে তিনি তুলে ধরেছেন আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে। তাঁর বিশ্লেষণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে গেলে কৃষি, শিক্ষা ও গ্রামীণ উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আমাদের টেকসই অগ্রগতি সম্ভব নয়।
তিনি ‘রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্র ট্রাস্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা, রবীন্দ্রচর্চা পত্রিকার সম্পাদক। নওগাঁর পতিসরে রবীন্দ্র-স্মৃতিস্থান পুনরুদ্ধার-প্রয়াসের এই পুরোধা একজীবনের রবীন্দ্রচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি (১৯৯৫) আর বাংলা একাডেমির ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে’ (২০১১) ভূষিত হন। এগুলো শুধু সম্মাননা নয়, বরং রবীন্দ্রচর্চায় তাঁর নিরলস শ্রম ও অসাধারণ অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তাঁর লেখনী স্পষ্ট করে দেয় যে রবীন্দ্রনাথকে কেবল এক কবির আসনে বসালে আমরা তাঁকে অসম্পূর্ণভাবে জানি। তিনি ছিলেন চিন্তার দার্শনিক, সমাজসংস্কারক ও ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টা। আহমদ রফিক সেই স্বপ্নকে নতুন আলোয় তুলে ধরে আমাদের বোঝান যে রবীন্দ্রনাথ আজও প্রাসঙ্গিক—বিশেষ করে ন্যায়বিচার, সমতা ও মানবিক উন্নয়নের লড়াইয়ে।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির চিকিৎসক
আহমদ রফিক ডাক্তারি পড়াশোনা করে চিকিৎসক হয়েছিলেন, কিন্তু পেশায় চিকিৎসক হিসেবে বেশি পরিচিত হননি। তবে তাঁর লেখনী আসলে আমাদের সমাজের চিকিৎসা করেছে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যথার্থই বলেছেন—চিকিৎসক না হয়েও তিনি ছিলেন সমাজের নিরাময়ক। তিনি নজরুল, জীবনানন্দ, বাংলাদেশের কবিতা, শহিদ বুদ্ধিজীবীসহ নানা বিষয়ে লিখে গেছেন। এমনকি চে গুয়েভারার বিপ্লবী চিন্তাও তিনি বিশ্লেষণ করেছেন বাংলাদেশের বাস্তবতায়। তাঁর কবিতা যেমন রাজনৈতিক ও মানবিক চেতনায় ভরা, তেমনি তাঁর প্রবন্ধগুলো আমাদের চিন্তা-চর্চার অবলম্বন হয়ে উঠেছে।
ব্যক্তিজীবন ও একাকিত্ব
আহমদ রফিক ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নিঃসঙ্গ মানুষ। স্ত্রীকে ২০০৬ সালে হারানোর পর তিনি একাই বসবাস করতেন। সন্তান ছিল না, আত্মীয়-স্বজনও ছিলেন না খুব ঘনিষ্ঠ। তাঁর নিজের ভাষায়—“প্রত্যেক মানুষই একাকিত্বের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে।” এই নিঃসঙ্গতাই হয়তো তাঁকে আরো গভীরভাবে সাহিত্য ও সমাজচিন্তায় ডুবিয়ে রেখেছিল। দৃষ্টিশক্তি হারানো, শারীরিক অসুস্থতা—সবকিছুর মধ্যেও তিনি লিখেছেন, ভেবেছেন, অন্যকে প্রেরণা দিয়েছেন। আমি নিজেও তাঁর সাথে ফোনে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি কয়েকবার। তিনি সর্বদা সহানুভূতির সাথে কথা বলতেন, উৎসাহ দিতেন। তাঁর মনের আন্তরিকতা সেই স্বল্প সময়ে স্পষ্ট হয়ে উঠত।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
তাঁর দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে তিনি পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মান তাঁকে ঘিরে রেখেছিল। ২০২৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। অসুস্থ দেহ নিয়েও তিনি সেই অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন—“যে কোনো পুরস্কার প্রেরণা জোগায়, মনে হয় আরও কিছু কাজ করি।” এই কথাই প্রমাণ করে, তাঁর শেষ বয়সেও সৃজনশীলতা ও দায়বদ্ধতা ছিল অব্যাহত।
মৃত্যুতেও দানের মহিমা
২০২৫ সালের ২ অক্টোবর রাত ১০টা ১২ মিনিটে বারডেম হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আহমদ রফিক। মৃত্যুর আগে তিনি নিজের দেহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার কাজে দান করে যান। এটি প্রমাণ করে, জীবনের শেষ মুহূর্তেও তিনি সমাজ ও মানবতার কল্যাণের কথাই ভেবেছেন। তাঁর মতো জ্ঞানী মানুষ নিজের মৃত্যুকেও শিক্ষা ও সেবার মহত্তম প্রয়োজনে পরিণত করে গেলেন।
উত্তরাধিকার ও প্রাসঙ্গিকতা
আহমদ রফিকের জীবন ও কর্ম আমাদের জাতীয় চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর রচনা, বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রচর্চা ও জাতিসত্তা নিয়ে লেখা, আগামী প্রজন্মকে বারবার স্মরণ করাবে—কীভাবে একটি জাতি তার পরিচয় গড়ে তোলে। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, সাহিত্য কেবল নান্দনিক রচনা নয়, এটি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। আজকের অস্থির সময়ে তাঁর লেখা ‘এই অস্থির সময়’ কিংবা ‘জাতিসত্তার আত্মঅন্বেষা’ নতুন অর্থে আমাদের পথ দেখাতে পারে।
আমার সৌভাগ্যের অভিজ্ঞতা
ডা. আহমদ রফিক স্যারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। মাঝেমধ্যে তাঁকে ফোন করলে তিনি সবসময় সহানুভূতি নিয়ে কথা বলতেন, আন্তরিক উৎসাহ দিতেন। তাঁর স্নিগ্ধ কণ্ঠের আড়াল থেকেও বোঝা যেত মনের গভীরতা ও উজ্জ্বল মানবিকতা। তাঁর সঙ্গে যুক্ত আমার এক বিশেষ অভিজ্ঞতা হলো ২০১১ সালের ঘটনা। সে বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। ২০১১ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক ত্রিপক্ষীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আহমদ রফিক তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন ও পল্লিপুনর্গঠন ভাবনা ও সাফল্য : এক পর্যালোচনা’ উপস্থাপন করেছিলেন।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল প্রবন্ধটির ইংরেজি অনুবাদ করার। সেটির শিরোনাম ছিল, “Tagore’s Thoughts on Village Development and Rural Reconstruction: A Review of Successes”। পরবর্তীকালে অনুবাদটি স্থান পায় আন্তর্জাতিক সংকলন Contemporarising Tagore & the World-এ, যা অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই সম্মেলন যৌথভাবে আয়োজন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ), বাংলাদেশ এবং বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন, ও জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া (Academy of Third World Studies), নয়াদিল্লি, ভারত ।
আমার কাছে এটি শুধু একটি অনুবাদের কাজ ছিল না, বরং এক মহামূল্যবান অভিজ্ঞতা। কারণ তাঁর গভীর চিন্তাভাবনাকে অন্য ভাষায় উপস্থাপন করা মানে ছিল তাঁর বোধের নতুন দিগন্তে প্রবেশ করা। এর মধ্য দিয়ে আমি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম, রবীন্দ্রচিন্তাকে তিনি কতটা সমাজসংলগ্নভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং কীভাবে সেই চিন্তাকে বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা আমাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি তাঁর প্রজ্ঞা ও চিন্তার গভীরতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে।
অন্তিম শ্রদ্ধাঞ্জলি
ডা. আহমদ রফিক ছিলেন সাহসী ও দূরদর্শী চিন্তার মানুষ। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তিনি প্রমাণ করেছেন যে জ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেবল নান্দনিকতার জন্য নয়, সমাজ পরিবর্তনের জন্যও অপরিহার্য হাতিয়ার। ভাষার জন্য সংগ্রামী ভূমিকা হোক বা কলমের মাধ্যমে সমাজের অসুখ সারানোর প্রয়াস—সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন নির্ভীক। তাঁর জীবন আমাদের দেখিয়েছে, নিঃসঙ্গতা কখনো সৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করে না; বরং সেই নিঃসঙ্গতার ভেতর থেকেই জন্ম নিতে পারে এক অনন্য সৃষ্টিশীলতা, যা জাতিকে অনন্তকাল পথ দেখাবে।
আজ আমরা তাঁর প্রয়াণে গভীর শোকাহত, কিন্তু একই সঙ্গে কৃতজ্ঞও—কারণ তিনি আমাদের ইতিহাস, সাহিত্য, সমাজচেতনা ও জাতীয় সত্তায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে গেছেন। তাঁর রচনা, গবেষণা ও সংগ্রামী মনন আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেবে—কীভাবে একটি জাতি তার পরিচয়, মর্যাদা ও মানবিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে। তাই আহমদ রফিক শুধু অতীতের অংশ নন, তিনি বর্তমান ও ভবিষ্যতেরও প্রেরণার উৎস।
লেখক পরিচিতি: লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার সিলেট।