Sylhet Today 24 PRINT

COP 30: বাংলাদেশের জলবায়ু সংকট ও প্রত্যাশার দিগন্ত

মোহন রবিদাস |  ০৭ নভেম্বর, ২০২৫

আগামী ১০ থেকে ২১ নভেম্বরে (২০২৫) ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিতব্য COP 30 সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।

Global Climate Risk Index অনুযায়ী আমরা বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, অথচ আমাদের কার্বন নিঃসরণ মাত্র ০.৪৭ শতাংশ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি দশকে ৬-৮ মিলিমিটার হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ১৫-২০ শতাংশ উপকূলীয় এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হতে পারে, যা প্রায় ৩-৪ কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করবে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালীর মতো জেলাগুলোতে লবণাক্ততা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ঐতিহ্যবাহী ধান চাষ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ে ৩-৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, যদিও সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম এবং ৪,০০০+ সাইক্লোন শেল্টারের কারণে মৃত্যু কমেছে, কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষতি বেড়েছে বহুগুণ। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় যেমন সিডর, আইলা, আম্ফান, ইয়াস প্রতিবার কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করছে। বাংলাদেশের ৩৮-৪০ শতাংশ মানুষ কৃষির সাথে জড়িত যা আমাদের GDP-তে ১১-১৩ শতাংশ অবদান রাখে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ ধান উৎপাদন ২০-৩০ শতাংশ কমতে পারে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে ৩,২১,০০০+ আক্রান্ত এবং ১,৭০০+ মৃত্যু হয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্য প্রভাবের প্রমাণ। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি আমাদের GDP-এর ২-৩ শতাংশ, যা ২০৫০ সাল নাগাদ ৯-১২ শতাংশে পৌঁছতে পারে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সামনে রয়েছে ঐতিহাসিক দায়িত্ব ১৮ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন তুলে ধরা।

COP 30 সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান প্রত্যাশা হলো জলবায়ু তহবিলের বাস্তবায়ন এবং Loss and Damage Fund-এর কার্যকর রূপায়ণ। উন্নত দেশগুলো ২০২০ সাল থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যা এখনো পূর্ণ হয়নি, তাই ২০২৫ সালের পর নতুন লক্ষ্যমাত্রা হওয়া উচিত ন্যূনতম ১ ট্রিলিয়ন ডলার যা হতে হবে অনুদান ভিত্তিক, ঋণ নয়। COP 27-এ প্রতিষ্ঠিত Loss and Damage Fund এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি, আমাদের দাবি এই তহবিলের পরিমাণ কমপক্ষে ৪০-৫০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক হওয়া উচিত এবং স্বচ্ছ ও দ্রুত অর্থ বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ চায় NDC 3.0-তে উন্নত দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমাক এবং জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ত্বরিত বিদায় নিক। বর্তমানে জলবায়ু তহবিলের বেশিরভাগ ব্যয় হয় নিঃসরণ হ্রাসে কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য অভিযোজন অধিক জরুরি, তাই তহবিলের ৫০-৫০ বণ্টন প্রয়োজন। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৫-৭ লাখ মানুষ জলবায়ু-প্রভাবিত অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ২-৩ কোটিতে পৌঁছতে পারে, তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে "জলবায়ু শরণার্থী"-এর আইনি স্বীকৃতি এবং পুনর্বাসন ব্যবস্থা জরুরি। আমরা চাই Enhanced Direct Access যাতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো জটিল আন্তর্জাতিক আমলাতন্ত্র ছাড়াই সরাসরি তহবিল পেতে পারে এবং PKSF ও IDCOL-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা আরও শক্তিশালী করতে হবে।

শিল্প বিপ্লবের পর থেকে আজ পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলো—যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, জাপান, অথচ ক্ষতির মূল্য দিচ্ছে বাংলাদেশ, প্যাসিফিক দ্বীপরাষ্ট্র, আফ্রিকার দেশগুলো। বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর কাছে দাবি করছে UNFCCC-এর Common But Differentiated Responsibilities (CBDR) মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে—যারা বেশি দূষণ করেছে তাদেরই বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। সবুজ প্রযুক্তি যেমন সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ, জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি, জলসংরক্ষণ প্রযুক্তি বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে হস্তান্তর করতে হবে এবং বৌদ্ধিক সম্পত্তিধিকার যেন বাধা না হয়। গবেষণা, প্রশিক্ষণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা প্রয়োজন এবং এই সহায়তা হতে হবে অনুদান ভিত্তিক যা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ঋণের বোঝা আরও বাড়াবে না। বাংলাদেশ চায় জলবায়ু ন্যায়বিচারের নতুন ফ্রেমওয়ার্ক যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রাধান্য পাবে, নারী, শিশু, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষ সুরক্ষা পাবে এবং মানবাধিকার রক্ষা হবে। আমরা দাবি করছি জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য আন্তর্জাতিক আইনি সুরক্ষা, পরিকল্পিত পুনর্বাসন ব্যবস্থা, জীবিকার বিকল্প সুযোগ এবং উন্নত দেশগুলোতে "Climate Visa"-র মতো ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হোক। স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক Monitoring, Reporting and Verification (MRV) System প্রয়োজন যাতে প্রতিশ্রুত অর্থ আসলেই দেওয়া হচ্ছে কিনা, প্রকল্পগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা এবং সুবিধাভোগীরা প্রকৃত সহায়তা পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা যায়।

COP 30 সম্মেলনে এমন কিছু নীতিমালা, মেকানিজম ও ফ্রেমওয়ার্ক প্রয়োজন যা বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রসমূহকে উপকৃত করবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে Regional Cooperation Mechanism শক্তিশালী করতে SAARC ও BIMSTEC-এর মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিনিময় এবং যৌথ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। Nature-based Solutions (NbS) Initiative-এর আওতায় ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ, জলাভূমি পুনরুদ্ধার, উপকূলীয় বনায়নের মতো প্রাকৃতিক সমাধানে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, কারণ সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক ঢাল রক্ষা করা অপরিহার্য। বাংলাদেশের উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ ও জলাভূমি প্রচুর কার্বন শোষণ করে যার সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং Blue Carbon ক্রেডিট ব্যবস্থা চালু করতে হবে। Climate Migration Protocol প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য আন্তর্জাতিক আইনি সুরক্ষা, পরিকল্পিত পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং জীবিকার বিকল্প সুযোগ নিশ্চিত করবে। প্যারিস চুক্তির Article 6 (কার্বন মার্কেট মেকানিজম) এর সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন যাতে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে এবং আমাদের সবুজ উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিক কার্বন বাজারে স্বীকৃতি পায়। Gender-responsive Climate Action Framework প্রয়োজন কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নারীদের ওপর সবচেয়ে বেশি এবং তাদের ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। Indigenous Knowledge Integration Framework চালু করতে হবে যা স্থানীয় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান যেমন বন্যা পূর্বাভাসের দেশীয় পদ্ধতি, জলসংরক্ষণ প্রযুক্তি সংরক্ষণ ও প্রয়োগ নিশ্চিত করবে।

বাংলাদেশের শুধু সমস্যা নয়, সমাধানও রয়েছে যা COP 30 সম্মেলনে তুলে ধরা উচিত। আমাদের সাইক্লোন প্রস্তুতি কর্মসূচির ফলে ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে,যা বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মডেল হতে পারে। বাংলাদেশে ৬০ লাখেরও বেশি সোলার হোম সিস্টেম স্থাপিত হয়েছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি। বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট লবণাক্ত-সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, যেমন BRRI dhan47, 67, 73, 97 যা উপকূলীয় এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। বাংলাদেশের ভাসমান কৃষি পদ্ধতি ২০১৫ সালে UNESCO Global Important Agricultural Heritage System (GIAHS) স্বীকৃতি পেয়েছে এবং Practical Action এর সহায়তায় এই উদ্ভাবনী পদ্ধতি বন্যাপ্রবণ এলাকায় সবজি চাষ সম্ভব করেছে। Tidal River Management (TRM) আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবন যা প্রাকৃতিক পলি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি এবং ভূমি উর্বরতা ফিরিয়ে আনে যা খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। Bangladesh Delta Plan 2100 আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা যা ২১০০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু সহনশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৮০টিরও বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় ৩৭ বিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম YouthNet for Climate Justice ও Fridays For Future Bangladesh-এর মাধ্যমে জলবায়ু আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে যা ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করে।

COP 30 শুধু একটি সম্মেলন নয়, এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের মঞ্চ এবং আমাদের প্রতিনিধিদের এখন দৃঢ় কূটনীতির সময় এসেছে। Climate Vulnerable Forum (CVF), LDC Group ও SIDS-এর সাথে একজোট থেকে শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে এবং শুধু আবেগ নয়, বৈজ্ঞানিক তথ্য, পরিসংখ্যান, মানুষের জীবন্ত গল্প দিয়ে ক্ষতির চিত্র তুলে ধরতে হবে। নদীভাঙনে প্রতি বছর ১,০০,০০০+ মানুষ ভূমি হারাচ্ছে, লবণাক্ততায় ১ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং উপকূলীয় ৪৫+ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানি সংকটে ভুগছে—এই সুনির্দিষ্ট তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। আমাদের শুধু সমস্যা তুলে ধরলেই চলবে না, আমাদের সমাধান, উদ্ভাবন, অভিযোজন ক্ষমতা এবং সাফল্যের গল্পও ভাগ করতে হবে যাতে বিশ্ব বুঝতে পারে যে আমরা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত নই, আমরা সমাধানকারীও। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের কথা পৌঁছে দিতে হবে এবং আর ভদ্র আবেদন নয়, দৃঢ়ভাবে আমাদের অধিকার দাবি করতে হবে কারণ এটি সহায়তা নয়, এটি আমাদের ন্যায্য প্রাপ্য। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার কিন্তু আমরা অসহায় নই—আমাদের সাহস, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং জনগণের স্থিতিস্থাপকতা আমাদের শক্তি। COP 30-এ আমাদের কণ্ঠস্বর হতে হবে ১৮ কোটি মানুষের প্রতিধ্বনি, যারা নিজেদের কোনো দোষ ছাড়াই জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে এবং এখন সময় এসেছে বিশ্ববিবেককে জাগানোর, প্রতিশ্রুতি থেকে বাস্তবায়নে যাওয়ার এবং একটি ন্যায়সঙ্গত জলবায়ু ভবিষ্যৎ তৈরির—যেখানে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য সম্মান ও সহায়তা পাবে।

  • মোহন রবিদাস: মানবাধিকারকর্মী ও জলবায়ু গবেষক; E-mail: robidasmohan@gmail.com

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
✉ sylhettoday24@gmail.com ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.