Sylhet Today 24 PRINT

কিছু বিদ্বেষ…

আজমিনা আফরিন তোড়া |  ১৭ মে, ২০১৬

দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গল। স্বপ্নে দেখলাম মা, আমার মা  মারা গেছে। এত বাস্তব ছিলো স্বপ্নটা যেন আমি  স্বপ্নের মাঝেই চারপাশের বর্ণ- গন্ধ সহ বুকে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম । ঘুম ভেঙ্গেও সারাদিন বুকের মধ্যিখানে খচখচানি। যে সে স্বপ্ন তো আর নয়! যাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা তাঁর, সেই মমতাময়ীর মৃত্যু বাণী আমায় যেন কোন নারকীয় আযরাঈল কানে কানে বলে গেল। জানি,স্বপ্ন স্বপ্নই। তবুও…

আমার মা, একজন ধর্ষিতা নারী। ধর্ষিতা বলছি কেন! শব্দটা হবে ধর্ষিত। ধর্ষিত শব্দটির কোন লিঙ্গান্তর হতে পারে না। এ কেবল নারীর দলিল করা অধিকার। মা কে আমি প্রতিদিন ধর্ষিত হতে দেখি। কি, ভাবছেন কারো যৌন চাহিদা মেটাতে যেয়ে তিনি ধর্ষিত? না, ঠিক তা নয়। প্রতিদিন মা ধর্ষিত হয় বাবা যখন জোর করে মার উপর কিছু চাপিয়ে দেয় তখন। যখন স্বামী নামক পুরুষটির জন্য তার হাজারটা ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিতে হয় তখন তার ধর্ষণ হয়। সন্তানরা যখন কোন ভুল করে বাড়ি ফেরে আর সকল দায় এসে আমার সেই মমতাময়ী মায়ের উপর পড়ে তখন সে তার সন্তানের সকল অপরাধ মাথায় নিয়ে নীরবে ধর্ষিত হয়।  মাতাল পুরুষটি ঘরে ফিরে যখন উচ্চস্বরে চিৎকার করে পাড়া জাগায় তখন লজ্জায় আমার মা ধর্ষিত হয় শরীরের জোরে যখন মাতাল স্বামী্টি ( শব্দগত অর্থ ঈশ্বর, আদৌ কি তাই?) তার যৌন চাহিদা মেটায়, তখন তো আমার মার আলবৎ ধর্ষণ হয়। যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় আমার মায়ের গায়ে যখন কেরোসিনের আগুন জ্বলে তখনও  আমার মায়ের উপর চলে গণ ধর্ষণ!

ভালোবেসে আপনার কন্যা সন্তানটি যখন প্রথম বার থর থর বুকে প্রেমিকের হাতদুটো ধরে আর ওই প্রেমিক তার দিকে কামুক দৃষ্টিতে তাকায়, তখন ধর্ষিত হয় আপনার সন্তানের ভালোবাসা।

এই ধর্ষিত নারী সমাজ প্রতিদিন তার নিজ ঘরে ডুকরে কাঁদে আর আমরা শিক্ষিত সমাজ কানে তুলা গুজে ( তরুণ সমাজ মোবাইলের হেডফোন গুঁজে ) বসে থাকি। আজ হয়ত সন্তান, তাই মায়ের দুঃখে ক্ষণিক মন খারাপ করে বসে থাকি। কাল ওই আমিই আবার নিজের বিয়ে করে দলিল করা মানুষ (!) টিকে একই উপায়ে ধর্ষণ করছি। এই অবিরাম ধারা চলে আসছে হাজার বছর ধরে। এত কিছুর পর চলে সীমানা নির্ধারণের খেলা।

মেয়ে হয়ে একা কোথাও যাওয়া যাবে না, বোরকা নামক পর্দা ছাড়া বান্ধবীর বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যাবে না! কে ঠিক করে দেয় এই সীমানা? ওই স্বামী,ভাই  বা ছেলে সন্তান!

আজ আমরা মেয়েরা খুব শখ করে পায়ে নূপুর, পায়েল পড়ি। এর আবিষ্কার কিন্তু মেয়ে  মানুষের (!) সীমানা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা থেকেই।পায়ের শব্দে যাতে সহজেই অবস্থান অনুমান করা যায় তাই এই অভিনব কৌশলের প্রচলন। আর আমরা কি সহজেই না প্রতিদিন তা প্রচার করে যাচ্ছি!

যে নারী একই উপায়ে নিজের ঘরে প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে তার আবার বাইরে ভয় কি? বাইরেই বরং সে ঘরের মত নিরাপদ। সেখানে অন্তত বিচার চাইরার মত মোড়লের অভাব পড়বে না!

একজন আমার কথার ঘোর বিরোধিতা করে বললেন, “আমি মনে করি আজকের নারীরা তুলনামুলকভাবে বিগত যুগের চেয়ে অনেক স্বাধীনভাবে চলতে পারে। শিক্ষা, চাকরী, ব্যবসা সবখানেই তো মেয়েরা এগিয়ে”।

দাদা, বলতে পারেন সেই মেয়েদের সংখ্যা শতকরা কত ভাগ? দৃষ্টি সম্প্রসারিত করে একটু গ্রামের চেহারা দেখে আসুন। দেশে নারী স্বাধীনতার কি হাল সেখানে টের পাবেন।
আমি দেখে এসেছি,যেখানে বাজারে গেলে আমার মাকে কু আমন্ত্রণ করা হত। বাবা  নামক পুরুষটি রাতে বাড়ি না থাকলে গভীর রাতে বাড়ির চালে ঢিলের বৃষ্টি হত বাড়ির দরজা খুলবার জন্য। আর সকালে উঠে সেই ঢিলের শব্দকেই জ্বীনের আচর বলে চালিয়ে দেওয়া হত! ক্লাস সেভেন পাস করা বোনকে বিয়ে দেবার জন্য জোরাজুরি হয় সেই গ্রামে। সেই দেশে বসে সুযোগ পাওয়া গুটি কতক শহুরে নারীর সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে অন্তত আমি বলতে পারি না নারী আজ উন্নতির শিখড়ে!

একজন পুরুষ মানুষ তার জীবনে মরে একবার। আর একজন নারী তার সারাটা জীবন দিয়ে মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে মরে বহুবার।

পৃথিবীর সকল নারী মুক্তির স্বাধ পাক। পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠুক। আমার মায়েরা ধর্ষিত হবার আগেই প্রকৃ্ত মৃত্যুর স্বাদ পাক…

আজমিনা আফরিন তোড়া : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.