Sylhet Today 24 PRINT

সবার উপরে মানুষ সত্য

আফরোজা আক্তার |  ২০ মে, ২০১৬

কানাডার এক পরিবারের কথা বলি। সেই পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল একটা বাড়ি হবে, ছোট্ট একটা বাড়ি। অনেক ঝক্কি ঝামেলার পর বাড়ি হলো তাদের, কিন্তু যে শহরে তারা থাকে সেখানে বাড়ির মর্টগেজ অনেক বেশি। তাই মর্টগেজে একটু সাহায্য হবে, এই ভেবে তারা তাদের সুন্দর বেজমেন্টটা ভাড়া দেবার পরিকল্পনা করলো। দেয়া হল পত্রিকায় বিজ্ঞাপন। এ সমস্ত দেশে পত্রিকায় বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন, অথবা অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে, সময় এবং তারিখ নির্ধারণ করে লোকজন বাসা ভাড়ার খোঁজে বের হয়।

ঠিক সেই পদ্ধতি অবলম্বন করে এক সিঙ্গেল মা তার তিন সন্তান নিয়ে হাজির হল এই পরিবারের প্রথম ভাড়াটিয়া হিসাবে। এ যেন রানি এলিজাবেথ তার রাজপুত্র আর রাজকন্যাদের নিয়ে তাদের ঘরের দরজায় এসে হাজির। পরিবার প্রধানের মন অনেক নরম। সে ভাবল, সিঙ্গেল মা, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, কোনো ঝামেলাঝাটি করবে না। এবং তাই হল। অনেকদিন কেটে গেলো কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই। রানিমাতা নিয়মিত বাড়ি ভাড়া দেন, নিজের মতো করে থাকেন তাঁর বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে। বাড়ির মালিকের সাথে যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন।

হঠাৎ রানিমার যে কি হলো। সে আর সিঙ্গেল মা হয়ে থাকতে চাইলেন না। তিনি তার পূর্ব পরিচিত এক তুর্কি বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করলেন। সে আবার এই দেশে থাকে না, থাকে তুরস্কে। বিয়ে হলো টেলিফোনে। ঘটনা মোড় নিলো এক নূতন দিকে। রানিমার সকাল-সন্ধ্যা এক ধ্যান, কিভাবে তার নূতন স্বামীকে তার কাছে আনবেন। এ দেশে টেলিফোনে কোনো বিদেশিকে বিয়ে করা যত সহজ,  সেই বিদেশিকে কাছে আনা তত সহজ না। ইমিগ্রেশনের অনেক নিয়ম কানুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তার উপর দরকার নিয়মিত কাজ করার প্রমাণসহ সার্টিফিকেট। রানিমা এবার বড়ই বিপদে পড়লেন। এতদিন সিঙ্গেল মা হিসাবে সরকার থেকে যে বিপুল অংকের টাকা পেতেন সামাজিক ভাতা হিসাবে, সেই উপার্জনের খাত  বন্ধ হয়ে গেলো এবার।

সরকারি নির্দেশ এলো রানিমার কাছে, এখন থেকে তার নব্য বিবাহিত স্বামীর আয়- রোজগার তাকে সরকারের কাছে পাঁঠাতে হবে এবং বিবাহিত স্বামীকে কাছে আনতে হলে রানিমাকে নিয়মিত কাজ করতে হবে। কোনো উপায় অন্ত না দেখে রানিমা বের হলেন কাজের খোঁজে। কাজ পেতে কোনো অসুবিধা হলো না তাঁর।

কিন্তু সমস্যায় পড়লেন বাড়িওয়ালা?  তিনি এখন আর নিয়মিত বাড়িভাড়া পাচ্ছেন না। রানিমা তার কষ্টার্জিত অর্থ বাড়িওয়ালাকে দিতে রাজি নন। আগে দিয়েছেন, কারণ সেই টাকা তাঁকে উপার্জন করতে হয়নি বাইরে গিয়ে। শুরু হল বাড়িওয়ালার সাথে রানিমার মন কষাকষি। কিন্তু সেই মন কষাকষির মধ্যেও যেন একটা ভদ্রতা আছে। বাড়িওয়ালা বলেন অনুগ্রহপূর্বক এমাসের মধ্যে আমার ভাড়াটা দাও, আর রানিমা বলেন, আমি টাকা পেলেই তোমাকে ভাড়া দিয়ে দেবো। রানিমা যখন  গ্রীষ্মের ফুরফুরে দিনে তার রাজপুত্র আর রাজকন্যাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন তার বাড়ীওয়ালা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন কীভাবে তার বাড়ির মর্টগেজ যোগাড় করবেন সেই দুশ্চিন্তায়। ধৈর্য ধরে দুমাস কাটানোর পর বাড়িওয়ালা গেলেন ট্রাইব্যুনালের কাছে। ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী রানিমাতা সময় পেলেন দুমাস। এর মধ্যে রানিমা বাড়ি ভাড়া দিতে না পারলে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু রানিমা বিচারকের কাছে যেয়ে বললেন তার আরও সময় লাগবে কারণ রায়ের দিন তিনি উপস্থিত থাকতে পারেন নাই তার কাজ ছিল বলে। এবং তার পক্ষে একদিনও কাজ বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। সুতরাং বাড়িওয়ালা পেলেন নূতন নির্দেশ। তাকে ধৈর্য ধরতে হবে। আর তিন সপ্তাহ তার পরেও যদি রানিমা বাসা না ছাড়েন তখন তিনি পুলিশ অফিসারকে কল দিবেন এবং পুলিশ অফিসার তার ফোর্সসহ এসে রানিমাকে বিতাড়িত করবেন।

সবচেয়ে মজার ঘটনা হল, এর মধ্যে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার সাথে কোনো ধরনের বাক বিনিময় করতে পারবে না। তাকে নিয়মিত গ্যাস- পানি এবং হিটের বন্দোবস্ত রাখতে হবে। এমনকি তুষার পাতের সময় তাকে তুষার পরিষ্কার করে রানিমার যাতায়াত ব্যবস্থা নিরাপদ রাখতে হবে। রানিমা যেন একজন মানুষ হিসাবে তার পূর্ণ মর্যাদা পান।

বাড়িওয়ালা পড়লেন মরণ ফাঁদে। একেতো চার মাস যাবত ভাড়া পাচ্ছেন না, তার উপর সমস্ত ইউটিলিটির তাকে পরিশোধ করতে হবে। বাড়িওয়ালা যেন ভদ্র থেকে আরও ভদ্র হয়ে গেলেন, কারণ  তাকে তো মেনে চলতে হবে সরকারি নির্দেশ। বাড়িওয়ালার যদিও মহাবিপদ, তার পরেও তিনি অভিভূত হলেন একটি দেশের আইনগত ব্যবস্থা দেখে। এই সাথে শিখলেন এবং জানলেন যে একটা রাষ্ট্র কীভাবে তার নাগরিকদের মানুষ হিসাবে মর্যাদা দেয়।

একটা সমাজে ভাল মানুষ, খারাপ মানুষ, চোর, গুণ্ডা, বদমাশ সবই থাকে, কিন্তু তাঁদের পরিচালনার জন্য থাকে একটা রাষ্ট্র। রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব থাকে সমাজকে সুসংগঠিত করা, সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা। যে কোনো অন্যায়ের বিচার হবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত আইন দ্বারা। আইনকে নিজের হাতে তুলে নেবার অধিকার কোনো মানুষের নেই, তা তিনি যতোই ক্ষমতাবান মানুষ হোন না কেন।

আজ আমাদের দেশে একজন সংসদ সদস্য যেভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে একজন শিক্ষককে জনসম্মুখে কান ধরে উঠবস করালেন, তাতে মনে হলো আমি নিজেই যেন কান ধরে উঠবস করছি হাজার হাজার জনতার সামনে। এ লজ্জা আমার একার না, এ লজ্জা পুরো শিক্ষক সমাজের, এ লজ্জা  সমস্ত বাংলাদেশের।  এটাই কি তাঁর দীর্ঘ পঁচিশ বছরের শিক্ষকতার পুরস্কার? এই ঘটনার সম্পূর্ণ ভিডিও দেখার সময় একজন বিবেকবান মানুষ হিসাবে আমি চোখের জল ফেলেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার মত বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ তাদের চোখের জল ফেলেছে একজন মানুষের এমন অপমান দেখে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকার আলবদররা যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে শাস্তি দিয়ে আনন্দ পেয়েছেন, সেই আনন্দের আভাস আমি সেই সংসদ সদস্য এবং তার সঙ্গী-সাথীদের চোখেমুখে দেখেছি।
 
দীর্ঘ ৪৫ বছর পরেও যদি আমরা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাতে পারি, তবে এই উদীয়মান ক্ষমতাধারীদের বিচার করাটাও অসম্ভব বলে মনে হয় না। এই অন্যায়ের বিচারটা খুবই জরুরি। নইলে আমাদের সমাজে কেউই নিজেদের মর্যাদার বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারবে না।

লেখক: কানাডা প্রবাসী

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.