Sylhet Today 24 PRINT

আমার চোখে বাবার স্বপ্ন

বিশ্বের প্রায় ৫২টি দেশে ‘বাবা দিবস’ পালিত হয়। পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য দিনটি বিশেষভাবে উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। প্রতি বছর জুনের তৃতীয় রবিবার পালিত হয় ‘বাবা দিবস’। এ ধারাবাহিকতায় এবছর ১৯ জুন দিবসটি পালিত হচ্ছে

আফরোজা আক্তার |  ১৯ জুন, ২০১৬

স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি। স্বপ্ন আছে বলেই আমরা আগামী দিনের অপেক্ষায় থাকি। এই স্বপ্ন দেখায় কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এমনকি স্বপ্ন দেখতে কোনো পয়সাও খরচ করতে হয় না। শুধু খেয়াল রাখতে হয় যে সেই স্বপ্ন পূরণ করার ক্ষমতা আমাদের আছে কিনা। সবার সব ক্ষমতা থাকে না, এই সত্যকে মেনে নিয়ে নিজের সাধ্যানুযায়ী কিছু করার অঙ্গীকারকে আমি সার্থকতা বলে মনে করি।

আর দশ জন মানুষের মত আমার বাবারও একটা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ছিল নিজের হাতে খামার করবেন তিনি, যেখানে জমিতে উৎপন্ন হবে শাক-সবজি, ফল-মূল, পুকুরে মাছ।  
                                        
আমার বাবা যখন ঢাকা কৃষি কলেজে পড়তেন তখনও ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেনি। বাবা আমার কৃষিতে মাস্টার ডিগ্রি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গ্রাজুয়েশন করেই ধরতে হয়েছে তাকে সংসারের হাল। কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে, তার ছেলেমেয়েদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না।বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে কর্মরত থেকে তার দীর্ঘ কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন।অতঃপর ছোট বোনের মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে মায়ের হাতে সংসার  বুঝিয়ে দিয়ে রওয়ানা হয়েছেন নিজের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে।

যে অভিজ্ঞতা এবং স্বপ্নকে  বুকে ধারণ করে দীর্ঘ কর্মময় জীবন অতিবাহিত করেছেন, তারই বাস্তব রূপ দিতে চলে গেলেন তাঁর গ্রামের বাড়িতে, তাঁর স্বপ্নের দেশে। শুরু করলেন দিনরাতব্যাপী কাজ। দুই ধরনের প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করলেন তিনি। স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী। দীর্ঘ দিনের অব্যবহৃত জমিগুলোকে চাষাবাদের আওতায় আনতে তিনি অনেক শ্রম দিয়েছেন। জমিগুলোকে উর্বর করতে ব্যবহার করেছেন জৈব সার। গ্রামবাসীর কাছ থেকে সংগ্রহ করা গোবর কম্পোজ করে সেই সার জমিতে ব্যবহার করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে কাজ করার সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার কৃষি বিভাগে কর্মরত তাঁর বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতায় উন্নত জাতের শাক-সবজি এবং ফলমূলের চারা সংগ্রহ করেছেন।

প্রকল্প শুরুর ঠিক ছয়মাস পর ২০০৫ সালের জুন মাসে, আমার সুযোগ এলো প্রথমবারের মত বাংলাদেশে যাওয়া। ঢাকা শহরে কিছুদিন কাটানোর পর চলে গেলাম আমার প্রিয় গ্রামে। বাবা সরকারী চাকুরীজীবী ছিলেন বিধায় আমরা বাবার সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থান করেছি। প্রতি দু’এক বছর পর পর বাবা আমাদেরকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে  নিয়ে যেতেন। অনেক ছোট বেলা থেকে বাবা এই কাজটি করে এসেছেন। আমরা শহরে বসবাস করে যেন নিজের মাটিকে ভুলে না যাই সেটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আমরা ভাইবোনেরা কেউই সেটা ভুলি নাই। আমাদের কাছে গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দটা আসলে পশ্চিমা দেশের মানুষের মেক্সিকো, জামাইকা অথবা কিউবা ভ্রমণের মত। আর আমাদের ভ্রমণ আনন্দদায়ক করতে যিনি সদা সর্বদা আমাদের পাশে আছেন তিনি আমার শ্রদ্ধেয় চাচি। বাবার এই প্রকল্পের আর একটি অংশ জুড়ে ছিলাম আমরা সবাই। আমরা যারা দেশে এবং দেশের বাইরে বসবাস করছি তাদের থাকা খাওয়ার যাতে সুবন্দোবস্ত হয় সেটাও নিশ্চিত করেছিলেন তিনি সেখানে। গ্রামে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সুন্দর একটা বাড়ি করেছিলেন তিনি। গ্রামীণ পরিবেশে আধুনিক সব বন্দোবস্ত পেয়ে আমাদের ভ্রমণটা যেন আরও আনন্দদায়ক হয়েছিল।

বাবা ঘুরে ঘুরে দেখালেন তার স্বপ্নে গড়া প্রকল্প। যতই দেখেছি ,ততই অভিভূত হয়েছি। কলার বাগানে কলা ঝুলছে, পেঁপের বাগানে পেঁপে, আমের বাগানে আম্রপালিতে তখন সবেমাত্র আম আসতে শুর করেছে। শাক-সবজির কথা তো বাদই দিলাম। শুধু মনে হচ্ছিল আমরা কেন শহর পানে ছুটি? যে শহরে নিঃশ্বাস নেবার মত একটু জায়গা নেই। যে শহরে নিঃশ্বাসে আমরা নেই বিষাক্ত বাতাস, যে শহরে সামান্য একটু পথ যেতে ঘনটার পর ঘণ্টা রাস্তায় ব্যয় করতে হয়, সেই শহরের মায়া কাটিয়ে আমরা কি আমাদের মায়াময় গ্রামে নিজেদের ঠিকানা গড়ে তুলতে পারি না?

বাবার প্রকল্প বাস্তবায়নে ছোটখাটো সমস্যা দেখা দিলেও মূল বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো পণ্য বাজারজাতকরণে। আজ থেকে দশ বছর আগে গ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থা তত ভাল ছিল না। সময়মত বাজারে না নেবার কারণে অনেক টাটকা শাকসবজি নষ্ট হয়েছে। বাবা কিন্তু হাল ছাড়েননি।তিনি তার ক্ষুদ্র মূলধন নিয়ে প্রকল্প চালিয়ে গেছেন। নিজের প্রয়োজন মিটিয়েছেন, প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করার পরেও অবশিষ্ট শাকসবজি এবং ফলফলাদি ঢাকায় বহন করে আনতেন নিজের পরিবারের জন্য। আমার একমাত্র ভাই ঢাকায় থাকে। কিন্তু, তার আন্তরিক ইচ্ছা থাকার পরেও কর্মব্যস্ততার কারণে ঢাকা থেকে গ্রামে এসে বাবাকে সাহায্য করতে পারে নাই সেভাবে।

আমার এক চাচাতো ভাই ঢাকা শহরের জীবন যাপনে ইতি টেনে এখন বাবার অভিজ্ঞতা এবং তার  কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীর  সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে শুরু করলো একই ধরনের প্রকল্প।   বাড়ির পিছন দিকে ছিল একটা ছোট্ট পুকুর। সেখানে শুধু মাছের চাষ করা হত। সেই পুকুরটাকে দীঘি আকারে কেটে দীঘির চারপাশের উঁচু যায়গায় করা হল বেগুন, ঢেঁড়স আর মরিচের চাষ। আর দীঘির উপর চারপাশে মাচা করে করা হল করল্লার চাষ। এ এক অদ্ভুত মনভোলানো দৃশ্য। এখন যাতায়াত ব্যবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো। সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ভ্যান চলে আসে বাড়ির উঠানে। টাটকা শাক-সবজি বাজারজাত হতে সময় লাগে ঘণ্টাখানেক। এ এক অদ্ভুত আনন্দময় জীবনযাত্রা। একমাত্র মাটির মায়া যার আছে, সেই শুধু অনুভব করতে পারবে এই আনন্দ।

এই সবকিছু মিলে বাবার যেন আনন্দ রাখার আর রাখার জায়গা নেই। এবার তাকে থামায় কে? কিন্তু হ্যাঁ, তাকেও থামিয়েছে একজন। সে হচ্ছে নিয়তি নামের এক নিষ্ঠুর পরিণতি। আমার বাবা এখন ঘাতকব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত। বার্ধক্য তাঁর কর্মক্ষমতা কমাতে পারে নি, কিন্তু এই মরণব্যাধী আমার বাবার মতো প্রচণ্ড রকমের আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভর এবং কর্মময় একজন মানুষকে এখন অন্যের মুখাপেক্ষীতে পরিণত করে ফেলেছে। সারাজীবন ডায়াবেটিস নিয়ে তিনি লড়াই করে গেছেন। কেউ বুঝতেই পারে নি কখনো তাঁর অসুস্থতা। কিন্তু, ক্যান্সারের সাথে লড়াইয়ে সুবিধা করতে পারেননি তিনি।  

ঘরবন্দি এখন তিনি। ঢাকার স্কয়ার হসপিটালের আধুনিক চিকিৎসার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত করছেন দিনগুলি। বয়স এবং ব্যাধি কেড়ে নিয়েছে আগের সে শারীরিক গতিশীলতা এবং চঞ্চল কর্মময়তা। স্থবির এবং মন্থর এখন বাবার নড়াচড়া। শুধু চোখ দুটো এখনো আগের মতোই সজীব, সদাচঞ্চল এবং স্বপ্নময়। হাজারো অ-বাস্তবায়িত স্বপ্নের খেলা সেখানে নিরন্তর। বাবা হয়তো তাঁর সব স্বপ্নের পূরণ করে যেতে পারবেন না। কিন্তু, আমরা তাঁর সন্তানেরা, আমরা কি পারবো তার স্বপ্ন পূরণ করতে?

আফরোজা আক্তার : কানাডা প্রবাসী লেখক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.