Sylhet Today 24 PRINT

ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনাল এবং আমাদের লজ্জা

ফরিদ আহমেদ |  ০৩ জুলাই, ২০১৬

বিশ্ব ফুটবলে আমি কোনো দলের গোঁড়া সমর্থক নই। দুই একটা প্রিয় দল যে নেই আমার, তা নয়। তবে, পাঁড় সমর্থক বলতে যা বোঝায়, আমি সেরকম কিছু না।

বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলের দলগুলোকে সমর্থন করতে গিয়ে মোটামুটি দ্বিধা-বিভক্ত। কেউ ব্রাজিলের সমর্থক, নতুবা কেউ আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। আমি এ দুটো দলের কোনোটাকেই কখনো সমর্থন করি নাই। এর পিছনে মূলত দুটো কারণ রয়েছে।

এক: আমার কাছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে এই ক্রেজকে বিরক্তিকর মনে হয়। সারা দুনিয়ায় আরো কতো দল খেলছে, কতো দল শিরোপা নিচ্ছে বিশ্বকাপের সেগুলো বাদ দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের এই দুই দলের প্রতি সমর্থনকে ভালো খেলার ভক্তের চেয়ে এক ধরনের অন্ধ ভক্তি বলেই মনে হয়েছে আমার।

দুই: বিচ্ছিন্নভাবে দুই চারজন গ্রেট খেলোয়াড়ের ভক্ত হলেও, ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবলের ভক্ত না আমি। তা সে লোকজন যতই ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবল হচ্ছে ধ্রুপদী ফুটবল, এগুলো বলে যুক্তি খাড়া করুক না কেন। আমি মূলত ইউরোপীয় গতিময় এবং দলবদ্ধ ফুটবলের ভক্ত। একক স্কিলের চেয়ে একটা টিম দল হিসাবে খেলছে, এটা দেখতেই বেশি ভালো লাগে আমার। একক দক্ষতা আমার কাছে স্বার্থপর ফুটবলের প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছু নয়।

আমি প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখা শুরু ১৯৮২ সাল থেকে। সেমিফাইনালের একটা ম্যাচ আর ফাইনালটা দেখেছিলাম শুধু। তখন বাংলাদেশে টেলিভিশন সুলভ ছিল না। অন্যের বাড়িতে গিয়ে এই খেলা দেখা আমার। সেই সময় ইটালির পাওলো রসি বিশ্বকাপের শেষ দিকে এসে টুর্নামেন্টকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। পাওলো রসির কারণে অনেকেই তখন ইটালির সাপোর্টার বনে গিয়েছিল বাংলাদেশে। এর বিপরীতে জার্মানিরও কিছু ভূমিকার রয়েছে। সেই সময় থেকে খেয়াল করেছি জার্মানিকে সুবিধাভোগী হিসাবে চিন্তা করতো বাংলাদেশের মানুষ। এদের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ ছিল সবার। তখনও বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার জন্মায় নাই। ব্রাজিলের কিছু সাপোর্টার ছিল অবশ্য। আর্জেন্টিনার সাপোর্টার বাংলাদেশে জন্মেছে ছিয়াশির বিশ্বকাপের পর থেকে, মূলত ম্যারাডোনার কারণে।

যাই হোক, পাওলো রসির কারণে ইটালিয়ান দলকে সেবার সমর্থন দিলেও, আমি পরবর্তীকে কেমন করে যেন তাদের সমর্থক বনে যাই। তবে, গোঁড়া কোনো সমর্থক না। এর পিছনে যতটা না খেলার ভূমিকা ছিল, তার চেয়ে আমার ধারণা ইটালিয়ান খেলোয়াড়দের রোমান সৌন্দর্যই বেশি দায়ী ছিল। আরেকটা অদ্ভুত কারণ ছিল, সেটা শুনলে লোকে হাসবে অবশ্য। ইটালির নীল রঙের জার্সিটা আমার দুর্দান্ত পছন্দ ছিল। এখনও যদি ইটালি কোনো কারণে নীল জার্সি পরে না নামে, আমার কাছে ইটালিকে ইটালি বলে মনে হয় না। যাই হোক, সময়ের সাথে সাথে আমার সমর্থন পাল্টাতে থাকে। কোনো দলকে সমর্থনের বদলে আমি আসলে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার প্রতি-সমর্থক বনে যাই। এরা যার সাথে খেলে, আমি তাদের সমর্থক। এরা হারলে আমি খুশি, জিতলে মন মরা হয়ে যাই।

গত এক দশক ধরে আমার এই প্রতি-সমর্থনের মাঝখান দিয়ে খুব নীরবে একটা দলের প্রতি সমর্থন চলে গিয়েছে। এদের খেলা আগে আমার মোটেই ভালো লাগতো না, কিন্তু এখন সবচেয়ে উপভোগ করি এই দলটার খেলা। অনেকে হয়তো ভাবছেন আমি স্পেনের কথা বলছি। না, স্পেন নয়, এই দলটার নাম জার্মানি। এদের দুর্দান্ত গতি, স্কিল এবং দল বেঁধে খেলার ভক্ত হয়ে গিয়েছি আমি। ইটালির প্রতি আগের সেই সমর্থন নেই যদিও, তারপরেও তারা আমার প্রিয় দলের তালিকাতে রয়ে গেছে আগের সেই ভালবাসার সুবাদে।

আমার এক সময়ের সেই প্রিয় দল ইটালি আজ আর মাত্র দেড় ঘণ্টা পর ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে নামবে আমার এখনকার প্রথম পছন্দের দল জার্মানির সাথে। কয়েকদিন ধরেই অপেক্ষায় ছিলাম দুই প্রিয় দলের খেলা দেখার জন্য। কিন্তু, এই মুহূর্তে অস্বস্তি হচ্ছে খেলাটা দেখার চিন্তা করতে গিয়ে। এই খেলার সাথে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমরা ফুটবলের গরীব দেশ, এখানে আমাদের কোনো ঠাঁই নেই। কিন্তু, আজ মাঠে, টেলিভিশনে, সারা বিশ্বের নানা বাড়িতে, পাবে, সব জায়গায় এই খেলার সাথে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হবে। সেই উচ্চারণ গর্বের নয়, হবে গভীর লজ্জার।

ঢাকার গুলশানে জঙ্গিরা যে হামলা চালিয়েছিল, সেই হামলায় অনেক বিদেশির সাথে একাধিক ইটালিয়ান নাগরিকও নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যাটা কত, কেউ জানে না। এঁদের স্মরণে এবং শোকে ইটালিয়ান ফুটবল দল আজ মাঠে কালো আর্মব্যান্ড পড়ে নামবে, এই অনুরোধ উয়েফাকে করেছে ইটালিয়ান সকার ফেডারেশন। উয়েফাও অনুমতি দিয়েছে।

এগারোজন রোমান রূপবান খেলোয়াড় যখন মাঠে কালো আর্মব্যান্ড পরে নামবে, তখন আমরা, বাদামি বাংলাদেশিরা হয়তো লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলবো। একদল জঙ্গি আজ আমাদের সারা বিশ্বের সামনে মাথা হেট করে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

ফরিদ আহমেদ : কানাডা প্রবাসী লেখক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.