Sylhet Today 24 PRINT

সেই আমাদের ঈদ!

আফরোজা আক্তার |  ০৭ জুলাই, ২০১৬

“ঐ রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”, গুন গুন করে এই গানটা গাইছি আর হেটে হেটে আমার কাজের জায়গায় যাচ্ছি। হাঁ, সেদিন ছিল রোজার ঈদ। কিন্তু ওয়ার্কিং ডেতে ঈদ হওয়ায়, আমাকে কাজে যেতে হয়েছে। অনেকে অবশ্য ঈদ উপলক্ষে আগে থেকেই ছুটি নিয়ে রাখে। আমি সেটা করি না। কিন্তু, যেখানেই থাকি না কেন মনে মনে ঈদ করি ঠিকই। দীর্ঘ জীবনের অভ্যাস এটা আমার। তখন আমি যে টিম হরটনসে কাজ করতাম ওটা ছিল একটা বড় মসজিদের সামনে অবস্থিত। ঈদ উপলক্ষে আমাদের দোকানেও বিশেষ বন্দোবস্ত নেয়া হত। নামাজ শেষে ঈদের আনন্দে আনন্দিত সবাই এখানে এসে জমায়েত হতো। সবার অনাবিল আনন্দ দেখে আমিও আনন্দিত হতাম।

খুব বেশি আনন্দকে তুলনা করতে আমি এখনও ঈদের আনন্দকেই ব্যবহার করি। যেমন, কোথাও বেড়াতে গিয়ে অনেক মজা হল অথবা কোন আড্ডায় পুরানো বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হওয়ায় অনেক আনন্দ হল, সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করতে গিয়ে আমি সবসময় বলি, 'একেবারে ঈদের আনন্দের মত আনন্দ হয়েছে।' মাঝে মাঝে ভাবি এটা কেনো বলি? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? জীবনের অনেকগুলো বছর পার করার পর উত্তরটা খুঁজে পেলাম। আসলে ঈদের এইযে আনন্দটা, এটা আমার মনের সীমারেখা পার হয়ে আমার মগজের কোনো একটা জায়গায় পাকা আসন গেঁড়ে বসে আছে।

ছোটবেলায় আমাদের কাছে ঈদ মানে ছিল নূতন জামা পরা আর সাজগোজ করে বেড়াতে যাওয়া। ঈদ আমাদের ধর্মীও অংশ হলেও এর তাৎপর্য বুঝেছি অনেক বড় হয়ে। ঈদ আসার প্রায় মাস খানেক আগে থেকে চারিদিকে শুরু হত একটা সাজ সাজ রব। শরীর এবং মনের ভিতর একটা ভিন্ন উত্তেজনা কাজ করতো। সব কাজই যেন করা হত ঈদকে ঘিরে। সবাই যার যার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করতো ঈদকে আনন্দদায়ক করতে। এখন মনে হয়, ওইসময় আমাদের চাহিদাও ছিল অতি সামান্য। একটা ফ্রক জামা অথবা সালোয়ার- কামিজ এবং তার সাথে একটা স্যান্ডেল পেলে মনে হতো পৃথিবীর সবটুকুই যেন পেয়ে গেছি। একটা ঘটনা মনে পড়লে এখনও হাসি পায়। একবার ঈদে সালোয়ার কামিজের সাথে আমি নিলাম সাদা রঙের একটা হিল জুতা। ঈদের ঠিক দুই দিন আগে আব্বাকে নিয়ে জুতা কিনে বাসায় ফিরে সাথে সাথে জুতা জোড়া লুকিয়ে ফেললাম পাছে আমার বন্ধুবান্ধব দেখে ফেলে। ঈদের আগের দিন রাতে সালোয়ার এবং কামিজকে বালিশের নিচে আর জুতার বাক্সকে বালিশের পাশে নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম।

ঈদের আগে চাঁদ দেখার আনন্দটাও ছিল অসাধারণ। সন্ধ্যার ইফতারি খেয়ে নামাজ পড়েই আব্বা আমাদেরকে নিয়ে ঈদের চাঁদ দেখতে বের হতেন। সবাই মিলে এক দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কোনভাবেই যেন চোখের পলক না পড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখতাম। কে প্রথম আবিষ্কার করবে ঐ অর্ধ গোলাকার সরু রেখা? দূর আকাশে ছোট্ট একটা রেখা দেখার সাথে সাথে চিৎকার করে উঠতাম, 'ঐ যে চাঁদ, ঐ যে চাঁদ'। কখনও সেটা সত্যি হতো, কখনও মন খারাপ করে বাসায় ফিরে রেডিও অথবা টেলিভিশনের খবরে চাঁদ দেখা গেছে কিনা তার জন্য অপেক্ষা করতাম। একবার এমনও হল, আমরা খবর শুনলাম সন্ধ্যা থেকে রাত নটা পর্যন্ত। খবরে বলা হল দেশের কোথাও চাঁদ দেখা যায় নাই। তারপর রাত দশটার খবরে বলা হলো নোয়াখালী জেলার কোনো এক অঞ্চলে নাকি চাঁদ দেখা গেছে। ঈদের চাঁদ দেখা গেলে সেই ঘোষণা দেবার সাথে সাথেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে শুরু হতো ঈদের গান 'রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।' রোজার ঈদের আগে এই গানটা না শুনলে মনে হতো কিছু একটা অপূর্ণতা রয়ে গিয়েছে।

ছাব্বিশ রোজার রাতে নামাজের পর হাতে মেহেদি পরার অয়োজনটা ছিল জমজমাট। তখন আমরা বাজার থেকে মেহেদি পাতা কিনে এনে পাটায় বেটে সেই মেহেদি হাতে পরতাম। আমাদের বোনদের মাঝে এ নিয়ে প্রতিযোগিতাও হতো। কে কতো সুন্দর করে নকশা করতে পারে, আবার কার মেহেদির রঙ কত গাঢ় হয় এবং সেই রঙ কত দীর্ঘস্থায়ী হয়। শুনেছি কেউ কেউ গাঢ় রঙ আনার জন্য মেহেদির সাথে চায়ের পাতাও ব্যবহার করত।

ঈদের ঠিক আগের দিন সকাল থেকে শুরু হতো আমাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভিযান। ভাই বোনদের মাঝে ভাগ করে নিতাম কার কী দায়িত্ব। সকাল থেকেই শুরু করতাম ঝাড়া মোছার কাজ। এমনকি আলমারি থেকে সব কাপড় চোপড় বের করে সেগুলো আবার গুছিয়ে রাখতাম। সাথে সাথে শুনতাম আমার মায়ের বকুনি। কারণ সারা বছর মায়ের চিৎকার চেঁচামেচিও আমাদেরকে এই অভিযানে আনতে পারে নাই। আর এখন ঈদের আগের দিন এগুলো করতে যেয়ে আমরা যদি অসুস্থ হই তবে যে সব আনন্দই বৃথা হবে।

ঈদের আনন্দের মূল আকর্ষণ ছিল টেলিভিশনে প্রচারিত ঈদের অনুষ্ঠানমালা। তখন বিনোদনের একমাত্র মাধ্যমই ছিল টিভি। একটাই মাত্র টিভি চ্যানেল ছিল তখন। সেটা ওই বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি। ঈদের ঠিক এক সপ্তাহ আগে থেকে ঈদের নাটক, ঈদের আনন্দমেলা, ছায়াছবির গান, নানা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, ইত্যাদি, বাংলা ছায়াছবি এগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচার করা হত। এখন মনে পড়ে ওই বিজ্ঞাপনগুলো দেখার মধ্যেও যেন একটা অন্যরকম আনন্দ ছিল। বেশীরভাগ ঈদের নাটকগুলো হতো হাসির নাটক। আর যদি সেই নাটকে আরিফুল হক অথবা এ, টি, এম, শামসুজ্জামান অভিনয় করতো তাহলেতো আর কথাই নাই। তা ছাড়া প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে সম্প্রচার করা হত আমজাদ হোসেন পরিচালিত ঈদের নাটক 'জব্বর আলি'। পরিবারের সবাই মিলে ঐ অনুষ্ঠান গুলো উপভোগ করতাম। সারা বছর তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতাম কখন ঈদ আসবে আর কখন ওই অনুষ্ঠানগুলো দেখবো।

এখন প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে পুরো সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আগের চেয়ে মোটামুটি সচ্ছল ভাবেই ঈদ উদযাপন করতে পারে। এখন হয়তো অনেককেই আর এক জামা আর এক জুতা নিয়ে ঈদ করা লাগে না। নিম্নবিত্তদের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি অবশ্য। আগের মতো নয়া পাওয়া নিয়েই ঈদ কাটে তাদের। আমাদের সময়ে আমরা যেমন একটা মাত্র টিভি চ্যানেলের উপর নির্ভরশীল ছিলাম, এখন আর সেরকম নেই। টেলিভিশনে এখন অনেক চ্যানেল হয়েছে। মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছে কোন চ্যানেল রেখে কোন চ্যানেলে চোখ দেবে। এখন কষ্ট করে মেহেদি পাতা বেটে মেহেদি পরতে হয় না। ঈদের আগের দিন অনেকেই পার্লারে গিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি টিউবে ভরা মেহেদি পরে আসে।

ঈদকে কেন্দ্র করে সব কিছুই চলছে। মানুষ কেনাকাটা করছে, মেয়েরা মেহেদি পরছে, ছেলেমেয়েরা একসাথে মসজিদে ঈদের জামাতে যাচ্ছে, ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন চ্যানেলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে তারপরেও মনে হয় কোথাও যেন কিছু একটার অভাব আছে। সব কিছুর মধ্যে খুঁজে পাই কেমন যেন যান্ত্রিকতার ছাপ। আমাদের সেই ছোটবেলার নির্ভেজাল ঈদের আনন্দ আমি কোথাও আর খুঁজে পাই না।আমাদের ছোটবেলার সেই ঈদের আনন্দটাই যেন সেরা আনন্দ ছিল।

আফরোজা আক্তার : প্রবাসী লেখক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.