Sylhet Today 24 PRINT

রাতারগুল জলাবন: ভাবনা ও দুর্ভাবনা

আব্দুল হাই আল-হাদী |  ১৮ জুলাই, ২০১৬

সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। সে নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে সম্প্রতি আরো মহিমামান্বিত ও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করেছে যে জায়গাটি, সেটি হচ্ছে রাতারগুল জলাবন বা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট।

আবেগের আতিশয্যে অনেকে এটাকে ’বাংলার আমাজান’ ’সিলেটের সুন্দরবন’ ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করে থাকেন।

সাম্প্রতিক সময়ে সভ্য (!) ও সুশীল মানুষের দৃষ্টিগোচর হওয়া এ বনকে নিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বিশেষ করে এ বনের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সম্পর্কে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে অনেক বিতর্ক। বন বিভাগ কয়েক কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলেও পরিবেশবাদী ও সচেতন মানুষদের প্রায় সবাই-ই এ প্রকল্পের বিরোধিতা করে বলেছেন, রাতারগুলকে জলারবন হিসেবে থাকতে দিতে হবে। চাপিয়ে দেওয়া যে কোন কর্মকাণ্ড এ বনের জীব-বৈচিত্র্য এবং অস্তিত্বের জন্য কল্যাণকর হবেনা বলে তারা মনে করছেন।

মিডিয়ার কল্যাণে দেশ-বিদেশের প্রায় সবাই গেছেন যে, বাংলাদেশের একমাত্র ‘স্বাদুপানির জলাবন’ হচ্ছে ’রাতারগুল’। উইকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যমতে, সারা পৃথিবীতে স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। এর মধ্যে দুটির অবস্থান ভারতীয় উপমহাদেশে- একটা শ্রীলংকায় আর আরেকটা আমাদের রাতারগুলে।

সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে এই জলাবনের অবস্থান। সিলেটের প্রাণকেন্দ্র থেকে  প্রায় ২৬ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এ বনের অবস্থান হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি ’প্রদীপের নীচে অন্ধকার’র মতোই লোকচক্ষুর আড়ালে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বনবিভাগের তথ্যমতে- এ বনের আয়তন ৩ হাজার ৩২৫ দশমিক ৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর বন ১৯৭৩ সালে ’বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করা হয়। বিশাল এ বনে রয়েছে জল-সহিষ্ণু প্রায় ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। এদের মধ্যে বেত, কদম, হিজল, মুর্তা, করচ, বরুণ, পিঠালি, অর্জুন, ছাতিজাম, গুটিজাম, বটগাছও, ছন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া এ বনে রয়েছে জলচর, স্থলচর ও উভচর নানা প্রজাতির প্রাণি।

রাতারগুল বনে সাপের মধ্যে গুইসাপ, জলঢোড়া ছাড়াও রয়েছে গোখরাসহ বিষাক্ত অনেক সাপ। বর্ষায় বনের ভেতর পানি ঢুকলে এসব সাপ উঠে পড়ে গাছের ওপর।বনের ভেতর রয়েছে মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালি, বানর, ভোঁদড়, বনবিড়াল, বেজি, শিয়ালসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। টেংরা, খলিশা (খইয়া), রিঠা, ভেঢ়া, পাবদা, পুটি, ডানকিনে, আইড়, কালবাউশ, রুইসহ আরো অনেক দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় এই বনে। পাখিদের মধ্যে আছে সাদা বক, কানি বক, মাছরাঙা, টিযা, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল ও বাজ। শীতে মাঝেমধ্যে আসে বিশালতায় সব শকুন। আর শীতকালে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ঘাঁটি গাড়ে বালিহাঁসসহ হরেক জাতের পরিযায়ী পাখি। সিলেট আবহাওয়া কেন্দ্রের তথ্যমতে, এখানে বার্ষিক গড বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪১৬২মিলিমিটার।

জুলাই মাসটি সবচাইতে আর্দ্র যখন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১২৫০ মিলিমিটার, অন্যদিকে বৃষ্টিহীন সবচাইতে শুষ্ক মাসটি হল ডিসেম্বর। মে এবং অক্টোবরে গড় তাপমাত্রা গিয়ে দাঁড়ায় ৩২ডিগ্রী সেলসিয়াসে, আবার জানুয়ারিতে এই তাপমাত্রা নেমে আসে ১২ডিগ্রী সেলসিয়াসে । ডিসেম্বর মাসে এখানকার আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ প্রায় ৭৪ শতাংশ, যা জুলাই-আগস্টে ৯০ শতাংশেরও বেশি।

বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে এ ব্যতিক্রমী 'জলাবন’ নিয়ে যখন উৎসাহ ও আগ্রহ চরমে, তখনই যুগের পর যুগ ’কুম্ভকর্ণের  ঘুমে’ শায়িত বন বিভাগেরও হঠাৎ অতি-উৎসাহ জেগে উঠলো এ বনকে নিয়ে। মিডিয়া ও সচেতন মানুষদের সতর্ক দৃষ্টি তাদের নীরব কিন্তু অ-নিয়মতান্ত্রিক স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটালো।তখন তারা এ বনকেন্দ্রিক আয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সম্ভবত: বিকল্প পথ হিসেবে তাদের চিরাচরিত ধারায় বনের উন্নয়ন ও সংরক্ষণের নামে প্রকল্প গ্রহণ করে। গত ২৩ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘বদলে যেতে পারে বনের প্রকৃতি’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ পড়ে অন্তত: তা-ই মনে হয়। সংবাদে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাতারগুলে পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বন ও পর্যটকদের সুবিধার্থে বন বিভাগ সেখানে পাঁচ কোটি ৬১ লাখ টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ, প্রায় সোয়া চার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে পূর্ত খাতে; বাকি টাকা বনায়ন ও অন্যান্য কাজে ব্যয় করা হবে। প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে সরবরাহ ও সেবা খাত, মেরামত, সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন এবং সম্পদ সংগ্রহ ও ক্রয় বাবদ কতগুলো অপ্রয়োজনীয় খাত দেখানো হয়েছে।  ’রাতারগুল কতল হবে’-শিরোনামে ১০ এপ্রিল  ২০১৪ প্রথম আলোয় প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ’বনের মধ্যবর্তী স্থানের নাম রাঙাকুড়ি। সেখানে পাঁচতলা উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হচ্ছে। বন বিভাগের যুক্তি, বনকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে! পাশে বন বিভাগের বিট কর্মকর্তার কার্যালয়। সেখানেও উঠছে আরেকটি পাকা দোতলা ভবন। সেটি হবে বিশ্রামাগার। ইট-বালুর শহর ছেড়ে পর্যটকেরা আসে বনে, প্রকৃতির কাছে। তাদের জন্য বন বিভাগের ইটের আয়োজন। টাওয়ার-বিশ্রামাগারে যেতে বনের ভেতর ১৫ ফুট চওড়া এক কিলোমিটার লম্বা রাস্তাও নির্মাণ করা হবে।বন বিভাগ রাতারগুলকে ‘জাতীয় উদ্যান’ প্রস্তাব করে দ্রুত এসব অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। বরাদ্দ প্রায় ছয় কোটি টাকা। এর সিংহভাগ যাবে পূর্ত কাজে।’ পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজের চাপ ও আন্দোলনের মুখে বন বিভাগ শেষ পর্যন্ত সাময়িকভাবে কাজ স্থগিত করতে বাধ্য হয়। কিন্তু যেকোনো সময় লোভনীয় সে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে যেতে পারে আমরা আশংকা করছি।

বন বিভাগ ১৯৭৩ সালে ’রাতারগুল’ কে ’বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়ারণ্য’ ও ’সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ ঘোষণা করে। এর মধ্যে চেঙের খাল দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, পেরিয়েছে অনেক সময়। কিন্তু ঘোষণ ছাড়া বন বিভাগ এ বনের জন্য কিছুই করেনি। শুধুমাত্র নিজেদের সেবা করেই তারা সময় অতিক্রম করেছে। কিন্তু হঠাৎ করে সেখানকার উন্নয়ন নিয়ে তোড়জোড় ও হইচই সন্দেহের উদ্রেক করে। আমরা মনে করি করি, বন বিভাগ অযাচিতভাবে প্রকল্পে সরবরাহ ও সেবা খাত, মেরামত, সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন এবং সম্পদ সংগ্রহ ও ক্রয় বাবদ কতগুলো অপ্রয়োজনীয় খাত দেখিয়েছে যার সাথে বনের সত্যিকার সংরক্ষণ ধারণার কোন সম্পর্ক নেই । রাতারগুলকেন্দ্রিক যে কোন প্রকল্প শুধু বন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত এবং বনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে আমরা মনে করছি। বনের বেদখল হওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার করে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার  যাতে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ নিজের মতো প্রাকৃতিকভাবে বংশবৃদ্ধি ও বিকশিত করতে পারে। আমাদের বিশ্বাস- কঠোর নিরাপত্তা ও পাহারার ব্যবস্থা করে কোন বনায়ন না করেই রাতারগুলকে যদি মাত্র ১০ বছর সময়ের জন্য রেখে দেওয়া হয়, তাহলে এ বন প্রাকৃতিক ভাবেই গাছ-গাছড়া ও বন্যপ্রাণীর এক নিরাপদ অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে উঠবে।বনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া এ বনে বনবিভাগ কোন কাজ না করলেই বরং এ বনের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

মিডিয়ার কল্যাণে ’রাতারগুল’ যখন শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তের দৃষ্টিগোচর হয়, তখনই এ নিয়ে এক ধরণের হৈচৈ ও তোড়জোড় শুরু হয়। লেখক, সাহিত্যিক, কবি ও সাংবাদিকদের কলম থেকে কাব্যিক ও মনমাতানো এমন সব লেখা বেরিয়ে আসতে থাকে যা নিয়ে মানুষের মধ্যে রাতারগুলকে নিয়ে তীব্র আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়। লেখালেখির মধ্যে দোষ বা নেতিবাচক কিছু না থাকলেও এটি সর্বস্তরের মানুষের কাছে এতই প্রভাব ফেলে যে মানুষ যেকোনো ভাবে এ বনকে দেখতে চায়। ফলে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এ বনটিতে সারাদেশ থেকে পর্যটকদের ঢল নেমে আসে। মানুষ এটাকে নতুন এক পর্যটনকেন্দ্র  গণ্য করে সেখানে  পিকনিক পার্টি, সংগীতের আসর, খেলাধুলার আসর পর্যন্ত আয়োজন শুরু করে দেয়। এতে সেখানকার বন্যপ্রাণীরা বিরক্তির মধ্যে পড়ে।মানুষের আনাগোনা প্রাণিদের কাছে উপদ্রব হিসেবেই গণ্য হতে থাকে এবং এটাই স্বাভাবিক। পর্যটকদের ফেলা আসা পরিত্যক্ত বর্জ্যে সেখানকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটা যে এখন বন্ধ হয়েছে তা কিন্তু নয় বরং দিন দিন

পর্যটকদের সংখ্যার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। বনবিভাগের স্বার্থকেন্দ্রিক প্রকল্প এবং পর্যটকদের আনাগোনার কারণে হয়তো একদিন রাতারগুল জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ কিন্তু বর্তমানে শ্রীহীন লাউয়াছড়া কিংবা বাইক্কা বিলের পরিণতি বরণ করবে বলে আমাদের আশংকা। তাছাড়া প্রতিযোগিতার বাজারে পাঠকদের তথ্য দিতে গিয়ে অনেক সময় গৌণ বা দুর্বল উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহের কারণে অসত্য বা অনুমাননির্ভর তথ্যও মিডিয়াতে প্রচারিত হচ্ছে যা আসলে কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ এনটিভি অনলাইনে প্রচারিত এক প্রতিবেদনের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। ’বাংলার অ্যামাজন রাতারগুল’ শিরোনামে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে ’রাতারগুল’এর নামকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে ’........ সিলেটের স্থানীয় ভাষায় মুর্তা বা পাটিগাছ ‘রাতাগাছ’ নামে পরিচিত। সেই মুর্তা অথবা রাতাগাছের নামানুসারে এই বনের নাম হয়েছে রাতারগুল’।

আমরা বিনয়ের সাথে নামকরণের এ দাবিকে খারিজ করছি। মুর্তা বা পাটিগাছকে স্থানীয় ভাষায় ’রাতাগাছ’ ডাকা হয় বলে আমাদের জানা নেই। বরং ’রাতা’ স্বতন্ত্র স্থানিক প্রজাতির একটি বৃক্ষ যা সিলেটের গ্রামাঞ্চলে জন্মে থাকে। এ গাছের কাঠ অতীতকালে নৌকা তৈরিতে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানেও ’রাতাগাছ’ একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। অপরদিকে ’গুল’ শব্দটি ’গ্রাম’ শব্দের সমার্থক শব্দ যা লালেং নৃগোষ্ঠী এবং প্রাচীন জৈন্তিয়া রাজ্যের সমতল অংশে ব্যবহার করতে দেখা যায়। লালেংদের (যারা পাত্র হিসেবেও পরিচিত) প্রায় সব গ্রামের নামের সাথেই ’গুল’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন: সিদাইরগুল, চিকনাগুল, কালাগুল, ধুপাগুল, খেড়িগুল, কুশিরগুল,বড়গুল ইত্যাদি। প্রবীণদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে যে, প্রাচীনকালে রাতারগুলে ’রাতাগাছের’ আধিক্য ছিল ;যদিও বর্তমানে সেখানে একটি রাতাগাছেরও সাক্ষাত পাওয়া যায়না। ’রাতাগাছ’র আধিক্যের কাররেই এ বন এবং সংলগ্ন এলাকার নাম ’রাতারগুল’ হয়েছে বলে আমরা নি:সন্দেহ মত পোষণ করছি।

সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলারবনের মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সে বন পুরোপুরি জলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে ও টিকে থাকে। রাতারগুল জলাবনেরও উদ্ভব, বিকাশ এবং অস্তিত্বের পুরোটাই পানির উপর নির্ভরশীল। এ পানির প্রধান উৎস হচ্ছে ’চেঙেরখাল’ যা মূলত: ভারত থেকে নেমে আসা সারি নদীরই নিম্নাংশ। সারি নদী জৈন্তাপুরের লালাখাল সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গোয়াইনঘাটে গোয়াইন নাম ধারণ করে প্রবাহিত হয়েছে। এটি আরো ভাটির দিকে প্রবাহিত হয়ে সিলেট সদরের কাছে চেঙেরখাল নাম ধারণ করে অগ্রসর হয়ে ধলাইকে সাথে নিয়ে ছাতকে সুরমার সাথে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশের সচেতন মানুষদের প্রায় সবাই জানেন যে, ভারত সারি তথা চেঙেরখাল নদীর উজানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করেছে যা ’লেসকা-মাইন্থ্রু হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্ট’ নামে পরিচিত।

ইতিমধ্যে সে প্রকল্পের ৩টি ইউনিটের মধ্যে দুটি থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনও শুরু হয়েছে এবং তৃতীয় ইউনিটের কাজ প্রায় শেষের দিকে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এ বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে নানা কর্মসূচিও পালন করেছে। বাংলাদেশ সরকারও গণ আন্দোলনের কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বাঁধের বিরুদ্ধে ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ব্যাপারটি দু’দেশের মধ্যকার বিষয় এবং এর পরিণতি কী হবে তা আমরা জানিনা  কিন্তু ’রাতারগুলের’ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের আলোচনায় নীতি-নির্ধারক ও গবেষকদের ইস্যুটি অ্যাড্রেস করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি।এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা- রাতারগুলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কাপনা ও খইয়ারখাল নামের ছোট্র নদীদ্বয়ের জন্ম ও পরিণতি সারি নদীতেই ঘটেছে।

মিডিয়া, পরিবেশবাদী ও স্থানীয় যেসব সংগঠন রাতারগুল জলারবনের সংরক্ষণ ও বিকাশে নি:স্বার্থভাবে কাজ করছেন, তারা অবশ্যই পরিবেশ,প্রতিবেশ ,জীববৈচিত্র্য সর্বোপরি দেশের মঙ্গলের জন্যই কাজ করছেন  এবং এজন্য সর্বদাই মানুষ তাদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। তাদের উদ্দেশ্য ও সততা অবশ্যই সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। তাদের তীক্ষ্ম নজরদারি ও তৎপরতা না থাকলে এতদিনে বনটি বনবিভাগের প্রকল্পের বলি হয়ে প্রায় হতশ্রী হয়ে যেত। তারপরও আমরা বিনয়ের সাথে তাদের প্রতি অনুরোধ করবো- স্থানীয় যেসব মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে এ বনের সাথে মিতালী করে জীবনধারণ করেছে, সেসব মানুষকে এ বনকেন্দ্রিক উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। এ বনই যুগ যুগ ধরে তাদেরকে মাছ, মধু ও অন্যান্য আমিষ সরবরাহ করেছে।

এ বনের কাঠই তাদের চুলার জ্বালানীর রসদ জুগিয়েছে। এ বনের মেজাজ ও মর্জি তাদের নখদর্পণে। তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও লোকায়ত জ্ঞান সংগ্রহ করে কাজে লাগানো গেলে তা যে কোন বড় বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতের চেয়েও বেশি কাজ দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। উন্নয়নের আধুনিক অনেক মডেলের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার কারণে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ’লোকায়ত জ্ঞান পদ্ধতি’ বা আইকেএস ক্রমেই জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। যে মানুষগুলো যুগ যুগ ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এ বনকে আপন সন্তানের মতো আগলে রেখেছে, তাদেরকে ঢালাওভাবে বন ধবংসের জন্য দোষারোপ করা অন্যায় হবে।জীবন-জীবিকার তাগিদে হয়তো বাধ্য হয়ে তারা কদাচিৎ এখনো এ বনের গাছ কাটে, মাছ শিকার করে, প্রাণিদের উপর আক্রমণ করে; তারপরও তাদেরকে কলংকিত না করাই ভালো। কারণ একদল নিরক্ষর শিকারী-সংগ্রাহক বননির্ভরশীল মানুষের যুগান্তরের চর্চিত অভ্যাস একদিনে হুট করে ছেড়ে দেবে - এটা আশা করা যায়না।

বনবিভাগ ও সচেতন মানুষজন এ বনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিকরণে কাজ করতে পারে। এ লক্ষ্যে স্থানীয় মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জনসচেতনতার কাজে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে এবং পাড়াকেন্দ্রিক উঠোন বৈঠকের আয়োজন করা যেতে পারে। একই সাথে বনবিভাগ পুরো বনের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার জন্য কঠোর পাহারার ব্যবস্থা করতে পারে। আস্তে আস্তে আইনের কঠোর প্রয়োগের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।

রাতারগুলের ’পলিটিক্যাল ইকোলজি’ বা ’রাজনৈতিক প্রতিবেশ’ গভীরভাবে অনুধ্যানের সাথে সাথে সকল স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ’সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’ তে পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করা গেলে সত্যিকার অর্থেই ’রাতারগুল’ একদিন ’বাংলার আমাজান’ এবং ’সিলেটের সুন্দরবন’-এ পরিণত হবে হবে আমরা আশাবাদী।

রাতারগুল জলাবন হিসেবেই টিকে থাকুক। পর্যটকদের নয় বরং  বন্যপ্রাণি ও উদ্ভিদের বিনোদনকেন্দ্রেই তা পরিণত হবে বলে আমরা আশা করছি।       

আব্দুল হাই আল-হাদী : সভাপতি, সারি নদী বাঁচাও আন্দোলন। ইমেইল : [email protected]

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.