Sylhet Today 24 PRINT

খাদ্যরসিক আলতাফ মাহমুদ শেষ আড়াইদিনে একবারই ভাত পেয়েছিলেন

শাওন মাহমুদ |  ২১ আগস্ট, ২০১৬

একেবারে আমার কুট্টিকালে শিমুল খালা যখন এলপি রেকর্ডে 'সোয়ান লেক' এর মিউজিক ট্র্যাক ছাড়তেন, তখন সেই সুরের সাথে ব্যালে করতে গিয়ে স্বপ্ন দেখতাম ব্যালেরিনা হবার। স্কুলে ক্লাস এইটে থাকতে ইংরেজি ক্লাসের শিক্ষক যখন 'অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি'তে তাঁর পড়াশুনা করবার সময়ের গল্প বলতেন, তখন বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতা করবার স্বপ্ন দেখতাম।

বন্ধুর দেওয়া 'জীবনানন্দ দাসের কবিতা সমগ্র' পড়তে পড়তে আকাশলীনা হবার স্বপ্ন দেখতাম। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই 'চের ডাইরি' পড়ে সংগ্রামী হবার স্বপ্ন দেখতাম। বড়বেলায় 'দা পিয়ানিস্ট' সিনেমা দেখে পিয়ানো শিখে বিশাল শিল্পী হবার স্বপ্ন দেখতাম।

বাবার কথা শুনতে শুনতে বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকা আমি আলতাফ মাহমুদকে চিনে নিয়েছিলাম। কিন্তু গত সাত বছরে শহীদ আলতাফ মাহমুদের ওয়েবসাইটটি তৈরি করতে গিয়ে ব্যক্তি ঝিলু থেকে আলতাফ মাহমুদ হয়ে উঠবার প্রতিটা স্তর পরতে পরতে জানবার পর নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেছি। একজন ঝিলু দি গ্রেটের নিজ জীবদ্দশায় যে ভাবে বাঁচবার কথা ঠিক সেভাবেই বেঁচেছিলেন তিনি।

সতেরো বছর বয়সে ঘর পালানো উড়নচণ্ডী অস্থির ঝিলু তাঁর সাড়ে সাইত্রিশ বছরের জীবনে কেরোসিন বিক্রি থেকে রোলেক্স ঘড়ি হাতে দিয়ে বেড়িয়েছিলেন। করাচীর পিচ ঢালা রাস্তায় হেঁটে স্যান্ডেলের তলা ক্ষয় করে ফেলা মানুষটি নিজে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা চষে বেড়িয়েছেন। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাঁটানো আলতাফ কন্যা শাওন জাম খেতে চাইলে গাড়ির ডিক্কি ভরে জাম কিনে মেয়েকে ওখানে বসিয়ে জাম খাওয়াতেন।

মাত্র একুশ বছরে একুশের গানে সুর দিয়ে অমরত্ব পাওয়া মানুষটি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গেরিলা সাথীদের বাঁচিয়ে দিয়ে বীরের মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন।

খাদ্যরসিক আলতাফ মাহমুদ শেষ আড়াইদিনের শেষে একবারই ভাত পেয়েছিলেন, পেঁপে ভাজি দিয়ে সাদা ভাত আর কাঁচামরিচ মাখিয়ে খেয়েছিলেন।

একবার নিজের মেয়ের কথা বলেছিলেন, হাতের আংটিটা খুলে দিয়ে শাওনকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন একজনকে। নির্মম অত্যাচারে তীব্র জ্বরের ঘোরে সাথের সঙ্গীদের কানে গুনগুনিয়ে বলেছিলেন, তোমরা কেউ কোন কিছু স্বীকার করবে না, সব আমার দোষ, তাই বলেছি ওদের বার বার।

কেন জানি মনে হয়, আলতাফ মাহমুদ শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত স্বপ্ন দেখতেন বেঁচে থাকবার। পকেটে এক টাকা দিয়ে একখানা সিঙ্গারা আর এক কাপ চা ভাগ করে বন্ধুর সাথে মিলে মিশে খেয়ে পার করে বেঁচেছিলেন একসময় তিনি। পালিয়ে ঢাকায় আসবার পর মাথা গুঁজবার জন্য কোন জায়গা না পেয়ে এক বন্ধুর সাথে আরেকজনের বাড়ির উঠানে কত শত দিন পার করে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। ছাত্রছাত্রীদের গান শিখিয়ে যা পেতেন, সেগুলো বিলিয়ে শূন্য হাতে দিন পার করেও বেঁচেছিলেন তিনি।

এমপি হোস্টেলের লম্বা বারান্দায় শেষ দেখা গিয়েছিল তাঁকে। দু পায়ের হাঁটু ভেঙ্গে ফেলেছিল ওরা। বেয়নেট চার্জ আর ফুটন্ত গরম পানির ঝলসানিতে গায়ের চামড়া ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। কপালের চামড়া ঝুলে রক্তাক্ত একটি চোখ বন্ধ ছিল। ছয় ফুট দীর্ঘকায় মানুষটি দুমড়ে মুচড়ে তীব্র জ্বরের তাপ ঘোরে অনেক কষ্ট করে বসেছিলেন বারান্দায়। খুব কাছের দুয়েকজন শুধু চিনেছিলেন তাঁকে।

শেষবারের মত আলতাফ মাহমুদকে ওখানে বসে থাকতে দেখেছিলেন তাঁরা। ছেড়ে দেওয়া সঙ্গীদের বেঁচে যাওয়া পথচলা জোর করে মেলে রাখা একটি ভেজা চোখ দিয়ে দেখেছিলেন তিনি।

জানি তখনও আলতাফ মাহমুদ স্বপ্ন দেখেছিলেন বেঁচে থাকবার।

শাওন মাহমুদ : শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদ কন্যা।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.