Sylhet Today 24 PRINT

স্মৃতিতে ভয়াল ২১ আগস্ট

আকবর হোসেন |  ২১ আগস্ট, ২০১৬

আজ ২১ আগস্ট। স্মৃতিতে ভাসে ভয়ংকর সেদিনের কথা। আমার দেখা ভয়াল সেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট একটি বিভীষিকাময় দিন। যন্ত্রনা আর কষ্টের দিন, না ভুলার দিন, স্বজন আর প্রিয়জন হারানোর দিন। এই দিনটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ভয়াবহ ও কঠিন দিন। কারন ২১ আগষ্ট দিনটিতে আমি বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিরোধী জনসভায় ছিলাম।

জনসভার আগে কাকার (সুরঞ্জিত সেন) সাথে জিগাতলার বাসা হতে একসঙ্গে জনসভায় স্থলে আসি। ঘটনার ১২ বছর অতিবাহিত হলেও আজো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই দিনের ভয়াল স্মৃতি, এখনো মনের অজান্তে চোখ দিয়ে পানি ঝরে, কখনোবা ভয়ে আতংকিত হয়ে হয়ে উঠি, কখনো বা স্বপ্নে সেই স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে, মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় দু:স্বপ্নে।  তখন আর নিজেকে আর স্থির রাখতে পারি না, যন্ত্রনায় মন ছটফট করে, আমার সামনে সেই দিন প্রান দিতে দেখেছি অনেক সহযোদ্ধাদেরকে। আমি ভাবি সেই দিন আমিও সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর মিছিলে শরীক হতে পারতাম। মাথার ভিতরে একটির পর একটি প্রশ্ন বার বার ঘুরপাক খায়।

২০০৪ সালের ২১ শে আগষ্ট পরন্ত বিকেল ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও দুর্নীতি বিরোধী শান্তিপূর্ন সমাবেশ চলছিল। জনসভা চলাকালীন সময়ের প্রথম দিকে আমি মঞ্চের (খোলা ট্রাকের) খুব কাছাকাছি ছিলাম, অধিকাংশ সময়ইটাই ছিলাম,সঙ্গে থাকা এলাকার বড়ভাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও যুবলীগের কয়েকজন সাথে করে বাটা দোকানের কাছে এসেছিলাম ঝাল-মুড়ির জন্য। আমি সাধারণত কোন সভায় গেলে চারপাশ ঘুরে বেড়াই, মঞ্চের কাছাকাছি থাকি,এটা আমার অভ্যাস,সেদিনও ছিলাম। বাটা দোকানের পাশে আসার মিনিট পাচেঁক পর হঠাৎ একটা বিকট শব্দ শুনতে পেলাম, এর আরো একটা, এরকম একের পর একটা বিকট শব্দে বোমা ফাটছে, আর গ্রেনেড বৃষ্টির মত পড়ছে। কেউ যদি নিজের চোখে এই দৃশ্য না দেখে তাহলে বলে বা লিখে বুঝানোর মত নয়।

শুরু হলো মানুষের দৌড়া-দৌড়ি,চিৎকার,কান্নার রোল, বাঁচাও, বাঁচাও ততক্ষনে রক্তে রঞ্জিত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সহ পুরো এলাকা। কেউ কাউকে উদ্ধারের মত নয়, যে যার মত দৌড়াচ্ছে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে,রক্ত, আর রক্ত, চিৎকার আর চিৎকার। সেদিন নিথর দেহে গুলি পড়েছিলো কেউ উদ্ধার করতে আসেননি। এত সহযোদ্ধার মৃত্যু এত কাছ থেকে দেখব জীবনে কখনো ভাবিনি।

হামলার সময় মহান সৃষ্টি কর্তার কৃপায় ও আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতা কর্মীদের মানব ঢাল তৈরীর ফলে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই দিন শহীদ হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহর্ধমিনী মহিলা আওয়ামীলীগের নেত্রী আইভি রহমান,আব্দুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, হাসিনা মমতাজ,রীনা বেগম, মোস্তাক আহমদ,মাহবুবুর রশীদ, সুফিয়া বেগম,আবুল কালাম আজাদ, লিটন মুন্সি, মোহাম্মদ হানিফ,রেজিয়া আক্তার, রফিকুল ইসলাম, আতিক সরকার, নাসির উদ্দিন, রতন শিকদার, আবুল কাশেম, মোমেন আলী, বেলাল হোসেন, জায়েদ আলী  সহ ২৪ জন নেতাকর্মী। অনেকেই আবার হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। আবার হাসপাতালে নেবার পথে অনেকেই মারা গেছেন। সাবের হোসেন চৌধুর সহ আরো কজন মিলে আমরা সুরঞ্জিত কাকাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাই।  
 
সেই সময় অনেকে মানব প্রাচীর তৈরী করে শেখ হাসিনাকে প্রাণে বাঁচান।  প্রাণে বাঁচলেও শেখ হাসিনা সহ ৫ শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়ে শরীরে স্পিন্টার নিয়ে আজো মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এখনো বাম চোখে ঝাপসা দেখেন। সেই দিন আহত হন জাতির বিবেক ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার অনেক সাংবাদিক বন্ধুরা। সেই দিনের শান্তি পূর্ন সমাবেশে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী,স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিনিধি নিজামী,মুজাহিদদের প্রত্যক্ষ ত্বতাবধানে আওয়ামীলীগকে নেতৃত্ব শুন্য করতে,এদেশ থেকে চিরতরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুন্ঠিত করার লক্ষে দেশরতœ শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলো। সেই দিন সরকারী আইন-শৃংখলা বাহিনী দর্শকের ভুমিকায় থেকে ঘটনা অবলোকন করেছে মাত্র। কেউ হতাহতদেরকে বাচাঁতে এগিয়ে আসেননি বরং আহতদেরকে যারা বাচাতে এগিয়ে এসেছিলেন উল্টো তাদেরকে লাঠি পিটা খেতে হয়েছে। ধিক জানাই তোদেরকে যারা মানুষ হয়ে সেদিন অমানুষের মত আচরণ করেছে তাদেরকে।

তৎকালীন সরকার প্রধান বা তার কোন প্রতিনিধি সেই দিন ঘটনাস্থলে যাননি, মিডিয়াতে নিন্দা বা বিবৃতি দেননি, এমনকি হাসপাতালে পর্যন্ত দেখতে যাননী আহত ও নিহতদেরকে দেখতে। আমাদের স্বাধীন দেশের জন্য এর চেয়ে ঘৃনার আর লজ্জার কি আছে।  

আমি নিজেও সেই দিন সহযোদ্ধাদের সাথে মৃত্যুর মিছিলে সঙ্গী হতে পারতাম, সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় বেঁচে যাই, বেঁচে থাকা সহযোদ্ধা হিসেবে আজো তাদের মৃত্যু আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়,চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই ভয়াল স্মৃতি।

২০০৪ সালের পর থেকে ২১ আগস্ট এলে একাধারে কয়েক বছরই ছুটে গিয়েছি সহযোদ্ধাদের টানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়েতে। এর পর কয়েক বছর ধরে যেতে পারি না, মনটানে, মন চাই ছুটে যেতে, পারিনা। না পারার যন্ত্রনা আমায় কাঁদায়। খুব ইচ্ছে ছিলো যাবার, পারিনি তবে মনে রেখে সহযোদ্ধারা তোমাদের কাছে যেতে না পারলেও আমি তোমাদের ভুলে যায়নি তোমাদের কথা মনে পড়ে,দিন রাত সব সময়। তোমাদের পাশে আছি, থাকব অনাদিকাল। তোমাদের রক্তের বদলা ও বিচারের পূর্ব পর্যন্ত তোমাদের পাশেই আছি। তোমরা ভালো থেকো।

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী 

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.