Sylhet Today 24 PRINT

নিজেকে চরাতে শিখলেই সমাজ সুশৃংখলভাবে চরবে

মাসকাওয়াথ আহসান |  ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

কোন প্রলেতারিয়েতের দাবীর পক্ষে কথা বলবো! যে কুরবানির গরুতে ইনজেকশন দিয়ে একে হৃষ্টপুষ্ট করে বিক্রি করেছে। এই ইনজেকশন দেয়াতে গরুর গোশত এমন বিষাক্ত হয়েছে যা খেলে শরীরের কিডনি সহ নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।

ইনজেকশন দিয়ে বিষাক্ত কুরবানির পশু বিক্রেতাদের মত প্রোলেতারিয়েত মিটার রিডার বা অফিসের ক্লার্কেরাই অতি দ্রুত বুর্জোয়া হয়ে ওঠে। তখন তাদের একটি ছোট পরিবারে একাধিক গরু-ছাগল কুরবানি দেয়া হয়।

অথচ আগে মানুষ সাতজন মিলে একটি গরু কুরবানি দিতো কিংবা একটি পরিবার একটি ছাগল কুরবানি দিতো। কিন্তু সমাজে অসততা ব্যাপারটা ডাল-ভাত হয়ে যাওয়াতে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এটি একটি অনিবার্য স্প্যানিশ ট্র্যাজেডি। এই অসৎ মানুষেরা

একে অপরের সঙ্গে ভেজাল বা বিষাক্ত খাদ্য বিনিময় করে একে অপরকে ক্রমে ক্রমে হত্যা করছে। ভেজাল গরু বিক্রি করে গিয়ে ঐ টাকা দিয়ে ভেজাল সেমাই কেনা; আবার ভেজাল সেমাই বিক্রি করে ঐ টাকা দিয়ে ভেজাল গরু কিনে খাচ্ছে স্প্যানিশ ট্র্যাজেডির অপরিণামদর্শী মানুষেরা।

অসততার সামাজিক নৈরাজ্যে বেপরোয়া কিছু মানুষ; তাদেরকে বাঁচানো কঠিন। আবার সময়টি সৎ মানুষের জন্য খুবই প্রতিকূল। সচেতনতা ও বিবেকবোধ আজন্ম পাপ যেন। এইক্ষেত্রে সচেতন সমাজ স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতিকদের সমালোচনা করেন; করতে বাধ্য হন। কিন্তু শুধুই কী কয়েকজন রাজনীতিকের দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারে সমাজে এতো বড় মূল্যবোধের ধস সম্ভব!

রাজনীতিকরা সবাই মিলে যে টাকা লোপাট করে; সম্মিলিতভাবে সমাজ এর অনেক বেশী টাকা লোপাট করে। এতে রাজনীতিকদের মাথাপিছু দুর্নীতি বেশী দেখায়, সাধারণ মানুষের মাথাপিছু দুর্নীতি কম হলেও সংখ্যায় তারা অনেক বেশী হওয়ায় তাদের সামষ্টিক দুর্নীতির যোগফলটি অনেক বড়। তাই কেবল রাজনীতিকদের কাঁধে দোষ চাপিয়ে সমাজের সামষ্টিক অপরাধের ইনডেমনিটি ও জাস্টিফিকেশান পাওয়া কঠিন।

অনেকে বলতে পারেন , আমিতো নির্ভেজাল মানুষ; আমাকে এই সামষ্টিক দুর্নীতির দায় চাপাচ্ছেন কেন! এর কারণ চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে শুধু চাচা আপন প্রাণ বাঁচা নীতিতে চলার কারণেই রাজনীতিক, আমলা, কেরানি থেকে গরু বিক্রেতা দুর্নীতি করার সাহস পায়। আর চাচা আপন প্রাণ বাঁচা নীতিতে চলে তো বাঁচা যাচ্ছে যা; খাদ্যেই যেখানে প্রতিদিন বিষ মেশানো হচ্ছে; সেখানে গা বাঁচিয়ে ঠিক কতদিন চলে ফিরে বেঁচে থাকা সম্ভব!

ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকায় নগরবাসী অপরিকল্পিত পশু কুরবানি দিয়ে রক্ত নদী সৃষ্টি করে যে নারকীয় দৃশ্য রচনা করেছে; তার জন্য ঢাকার দুজন মেয়রকে দায়ী করা আসলে তাদের পিনকুশান হিসেবে ব্যবহার করা। তারা কুরবানির জন্য স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। নগরবাসী একটি ট্রাক ভাড়া করে পশুগুলো নিয়ে গিয়ে সেখানে কুরবানি দিলে এই নারকীয় দৃশ্যের অবতারণা হতোনা। শুধু নিজের গৃহটি স্টার প্লাসের নাটকের সেটের মত ঝকঝকে করে সাজিয়ে নিয়ে; বাড়ীর গেটের বাইরের পুরো পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব সরকারের ওপর ছেড়ে দেবার এই যে আত্মকেন্দ্রিক সমাজ মানস; সেটি উন্মোচিত হয়েছে রক্তনদীতে।

আশা করা যায় মেয়রেরা কুরবানি দেবার জন্য স্লটার হাউজ নির্মাণ করার উদ্যোগ নেবেন। বিদ্যমান বাস্তবতায় ধর্মীয় শুচিতা রক্ষার জন্যই "স্লটার হাউজ ফার্স্ট; মস্ক লেইটার" সেটা উপলব্ধি করতে হবে সমাজকে। এখানে অনুভূতিতে আঘাতের বায়না ধরার সুযোগ নেই, কারণ বাংলাদেশের মত দু'একটি দেশ ছাড়া আর কোন দেশে প্রকাশ্যে পশু কুরবানির অনুমতি নেই। সব জায়গায় স্লটার হাউজ বা জবাই বাড়ি রয়েছে। আর কুরবানি দেবার ক্ষেত্রে পরিমিতি বোধ প্রয়োজন রয়েছে। অতীতে যেটি ছিলো; সেই পরিমিতির সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা জরুরী।

বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা; বিশেষত: ঢাকার ধারণক্ষমতা উপচে পড়া যে জনপদ; সেখানে প্রতিটি নাগরিক দায়িত্ববোধের পরিচয় না দিলে নগরী তথা রাষ্ট্রের সামষ্টিক নিমজ্জন ঠেকানো অসম্ভব পড়েছে। এই জীবন নগরীকে নিজ হাতে হত্যার দায় প্রতিটি নাগরিকের। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়; এই মুহূর্তে সবচেয়ে কষ্টের জীবন তাদের যারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। এই জনবিস্ফোরণের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মানে অসম্ভবের প্রতিবেশী হওয়া।

অসততার মড়ক গোটা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক কিছু পশ্চিমা গবেষণায় দেখা যাচ্ছে; প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের মাঝে অসততার প্রবণতা রয়েছে। একটি গবেষণায় পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। অংশগ্রহণকারীদের ২০ টি প্রশ্ন দিয়ে খুব অল্প সময় দিয়ে বলা হয়; প্রতিটি সঠিক উত্তরের জন্য ১০ ডলার দেয়া হবে। পরীক্ষার খাতা জমা নেয়ার পর বলা হয়; আমরা আপনাদের উত্তরপত্রগুলো নষ্ট করে ফেলছি। আপনারা বলুন কে কয়টি উত্তর দিয়েছেন; সেই অনুযায়ী ডলার নিয়ে নিন। উত্তরপত্রগুলো নষ্টের ভান করা হয়। লোকজন ডলার নিয়ে ফিরে যাওয়ার পর উত্তরপত্র দেখে বোঝা যায় ৮০ শতাংশ পরীক্ষার্থী মিথ্যা বলে টাকা নিয়ে গেছে। ফলে পশ্চিমা সততার মিথ ভেঙ্গে পড়ছে এইসব গবেষণায়।

তাই বাংলাদেশ সমাজকে এর শেকড় থেকেই খুঁজে বের করতে হবে অসততার জলাবদ্ধতায় সৃষ্ট রক্ত নদীতে একটি প্রাচীন সভ্যতার এই প্রাত্যহিক নিমজ্জনের পথ থেকে মানুষকে বাঁচানোর পথ। নৈরাশ্যের বাস্তবতায় হা-হুতাশ কোন সমাধান নয়। সমাধান নেই হিংস্র গালিগালাজ কিংবা গুলিগালাজে।

একজন আরেকজনের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের নির্বুদ্ধিতাগুলো এই রক্তাক্ত প্রান্তরে খুবই বেমানান। আমাদের যেভাবেই হোক পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বসবাসযোগ্য বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে। এর জন্য এমন সমাজ প্রয়োজন যেখানে দুর্নীতিকে ঘৃণা করবে সবাই। শিশুদের জীবন বাঁচানোর জন্য রুখে দিতে হবে এই "অসততার ক্রমঃগণহত্যাকে"। আর মানুষ তো গরু-ছাগল নয় যে তাকে চরাতে রাখাল লাগবে। মানুষ নিজেই নিজের রাখাল। নিজেকে চরাতে শিখলেই সমাজ সুশৃংখলভাবে চরবে।

মাসকাওয়াথ আহসান : সাহিত্যিক, সাংবাদিক।

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.