Sylhet Today 24 PRINT

নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক বীভৎসতা দেখে এসে

রাজেশ পাল |  ১২ নভেম্বর, ২০১৬

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক হামলার পরের পরিস্থিতি দেখতে এবং আক্রান্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে কিছু সাহায্য নিয়ে শুক্রবার (১১ নভেম্বর)  ওই এলাকায় ঘুরে এসেছি আমরা কয়েকজন। ঘটনার দুই সপ্তাহ হয়ে গেলেও এখনো সেই এলাকায় রয়ে গেছে বীভৎসতার চিত্র।

শুক্রবার বিকেলে  আমাদের রিলিফ টিম নাসিরনগরে পৌঁছে ঘোষপাড়া, কাশিপাড়া,গাংকুল পাড়ার খুব কম বাড়িই দেখেছি যেগুলোর বেড়ার টিন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়নি। একটি আধুনিক সভ্য রাষ্ট্রে এ ধরণের মধ্যযুগীয় বর্বরতা সত্যিই অকল্পনীয়। আর লুটপাট হয়েছে আনুমানিক ৮০/৯০ টি বাড়িঘর আর ১৫ টি মন্দির। যার মধ্যে সার্বজনীন মন্দিরই আছে চারটি। শুধুমাত্র ঘোষ পারাতেই রাধাকৃষ্ণ মন্দির, শিব মন্দির আর দুর্গা মন্দির ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে চরম বর্বরতার সাথে। ঘোষপাড়ার মন্টু ঘোষ এবং বিজন ঘোষের ভাষ্যমতে, এরকম বর্বরতা তাঁরা পাকিস্তান আমলেও দেখেননি।

ঘোষপাড়ার সুপ্রভা সূত্রধর আমাদের কাছে রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে বর্ণনা করেন কিভাবে তাঁর বৃদ্ধা শাশুড়িকে বেপরোয়াভাবে মারধর করা হয়েছে । শুনে চোখের জল আর সামলে রাখতে পারিনি। নমঃশূদ্র পাড়ার সজল সরকার,সুশীল সরকারের বাড়ীসহ সর্বমোট ১৫/২০ টি বাড়ীতে  ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। একেবারে করুণ অবস্থা দেখলাম কাশিপাড়ার হতদরিদ্র মানুষগুলোর। প্রতিটি ঘরের টিন দেখলাম ক্ষতবিক্ষত। আর ভেতরে তাণ্ডবের চিহ্ন। কাশিপাড়ার মোটামুটি অবস্থা সম্পন্ন দীপাবলি সূত্রধরের বাড়ীতে গিয়ে দেখলাম  , তাঁর ভাষ্যমতে সর্বমোট সাড়ে চার ভরি স্বর্ণালংকার লুট করা হয়। এমনকি তাঁর কানের দুলগুলো পর্যন্ত টেনে ছিঁড়ে নিতে চায় তারা। তিনি তখন বাধ্য হয়েই কানের দুলগুলো খুলে দেন। দিনেদুপুরে ডাকাতি আর কাকে বলে।

ওখানকার শোভা চৌধুরীর বাড়ীটি ছিলো এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম মিলনকেন্দ্র। বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র ছিলো তাদের। যেগুলো ব্যবহার করা হতো পুরো এলাকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সবগুলোই ভেঙে গুড়ো গুড়ো করে ফেলা হয়েছে। হারমোনিয়ামটির ধ্বংসাবশেষ এখনো আছে। এই সন্তানসম বাদ্যযন্ত্রগুলো বাঁচাতে চাইলে বাড়ীর কর্ত্রী শোভা চৌধুরীকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। এখনো তাঁর সারা শরীর যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় আছে। আমাদের কাছে বারবার শুধু জানতে চাইছিলেন তাঁর অপরাধ কি ছিলো ? কিন্তু উত্তরটা জানা থাকলেও দিতে পারিনি।

রসরাজের নিজের পাড়ায় এখনো চাপা আতংক কাটেনি। ঘটনার ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো বাড়ী ফেরেননি অনেক পরিবার। আর সরকারী সাহায্য বলতে পেয়েছেন মাত্র দুই বান টিন আর ৬ হাজার টাকা। তাও মাত্র ১৬ টি পরিবার। অথচ দুই শতাধিক বাড়ী যে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত তা আমরা নিজেরাই দেখেছি। আর রিলিফের ক্ষেত্রেও চলছে ব্যাপক স্বজনপ্রীতির সার্কাস। কারো ঘরে যাচ্ছে ডাবল ত্রাণ। কেউ একেবারে কিছুই পাননি। এক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে সবাই ভাই ভাই। বরাবরের মতোই।

স্থানীয় লোকজন, আর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, তারা এই ন্যক্কারজনক ঘটনার পেছনে পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা আর গাফিলতিকেই বড় করে দেখছেন। আগের রাতে এভাবে মাইকিং করার পরেও তারা দুইটি উগ্রপন্থী ধর্মীয় সংগঠনকে সমাবেশ করার সময়ে প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করেননি মোটেও। আর এত কাছাকাছি থানা থাকা স্বত্বেও কয়েকঘন্টা ধরে তাণ্ডব চলার সময়ে পুলিশ কোন প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেই বলেন, “ হাতে গুলিভরা শটগান ছিলো। কিন্তু অর্ডার না থাকায় কিছুই করতে পারলাম না। আর অর্ডার পাবোই কোত্থেকে? ওসি স্যার ,ইউএনও স্যারতো হুজুরদের মিটিং এ গিয়ে হাত মিলিয়ে আসছেন।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

যা হয়েছিল সেদিন
গত ৩০ অক্টোবর (রোববার) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এলাকায় ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হন ওই এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। ঘটনার সূত্রপাত এর আগের দিন ২৯ অক্টোবর (শনিবার) হরিপুর ইউনিয়নের রসরাজ দাস নামের প্রায় অশিক্ষিত এক ছেলের নামে খোলা ফেসবুক একাউন্টে ধর্মীয় অবমাননামূলক একটি ছবি পোস্ট দেয়ার অভিযোগ থেকে।


ওইদিনই যা স্থানীয় পর্যায়ে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। তড়িৎ গতিতে বেলা আড়াইটার দিকে গ্রেফতার করা হয় রসরাজকে। যদিও জানা যায় পোস্ট দেয়া এবং তোলপাড় হবার পুরো সময়ে বাড়িতে মোবাইল রেখে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত ছিল রসরাজ। তবে রসরাজকে গ্রেফতার করা হলেও উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি। ঐদিন হরিপুর বাজারে মিছিল সমাবেশ হয়। পাশাপাশি হরিপুর এবং নাসিরনগর এলাকায় মাইকিং করা হয়। মাইকিং এ আতংকিত হয়ে হরিপুরের রসরাজের পাড়ার প্রায় ৩০০ ঘর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন সেদিন রাতেই জীবন বাঁচাতে যে যেদিকে পারেন পালিয়ে যান। ৩০ অক্টোবর সকাল ৯-১০ টার মধ্যে মনুষ্যবিহীন খালি পাড়াতেই ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালানো হয়।

অন্যদিকে নাসিরনগরে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত নাসিরনগর কলেজ মোড় এলাকায় ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত সমাবেশ করে। আর হেফাজতে ইসলাম আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠ এলাকায় সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সমাবেশ করে। দুই সমাবেশেই চরম সাম্প্রদায়িক এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন বক্তারা। ওসি ,ইউএনও এবং আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতাও সেখানে তাদের সাথে পূর্ণ সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। এই দুই সমাবেশ থেকেই কয়েক হাজার মানুষ একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দু পাড়াগুলোর উপরে মধ্যযুগীয় কায়দায় দুপুর ১২টার দিকে। প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা ধরে চলে এই তাণ্ডব। কিন্তু এগিয়ে আসেনি পুলিশ। অধিকাংশ হামলাকারীর হাতে লাঠিসোটার পাশাপাশি দা, রামদা, কুড়ালের মতো দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রও ছিলো যথেষ্ট পরিমাণে। এ থকে সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে হামলার ঘটনা ছিলো সম্পূর্ণরূপে পূর্বপরিকল্পিত। হামলা করার প্রস্তুতি নিয়েই তারা সমাবেশে এসেছিল।

আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দল
দেশজুড়ে আলোচিত আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের  বিষয়টি আমাদের সরজমিনে তদন্তেও উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে আমরা স্থানী জনগণ,সাংবাদিক এবং বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলি। এখানকার আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে মূলত: দুইটি গ্রুপ সক্রিয়। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন মন্ত্রী ছায়েদুল হক। আরেক গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সভাপতি সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। এই হামলার সাথে মোকতাদির গ্রুপের লোকজন জড়িত বলেই জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সাধারণ মানুষের ধারণা ছায়েদুল হককে বিপাকে ফেলতেই এই ঘটনা করেছে তারা।

বিডিনিউজ-এর রিপোর্টের সূত্র ধরে জানতে চাইলে, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার, হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি,হরিপুরের হরিণবেড় বাজারের যে দোকান থেকে রসরাজ দাসের ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে কথিত ধর্ম অবমাননার ছবি পোস্টের খবর পাওয়া যায় এবং লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করা হয় তার মালিক জাহাঙ্গীর এরা সবাই মোকতাদির চৌধুরীর অনুসারী বলেই জানান স্থানীয়রা। তবে ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য স্ট্যাটাস দিয়ে উস্কানি দেয়া ফারুক মন্ত্রী ছায়েদুলের অনুসারী। তার বাবা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ছিল সেকারণে এলাকায় সে ‘রাজাকারের পোলা” হিসেবেই পরিচিত বলে স্থানীয়রা জানান আমাদের। এছাড়া ঘটনার সাথে অন্যান্য যেসব নেতাদের নাম উঠে এসেছে তাদের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আবদুল আহাদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উপজেলা সভাপতি আদেশচন্দ্র দেব এবং জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী বিউটি কানিজ, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শহিদুল হক মোকতাদির চৌধুরীর অনুসারী আর নাসিরনগর উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এটিএম মনিরুজ্জামান মন্ত্রী ছায়েদুলের অনুসারী বলে পরিচিত বলে স্থানীয়রা জানান আমাদের।

সবার সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারলাম, দুই সিনিয়র নেতার গ্রুপের দুই পাতি-নেতা হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি আর নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়া ফারুকের মধ্যকার ইউপি নির্বাচনের দ্বন্দ্বের  জের ধরেই এই ঘটনার জন্ম। এই দুইজনকে রিমান্ডে নিয়ে ডিম থেরাপি দিলেই আশা করি সব রহস্য উন্মোচন হয়ে যাবে মূহুর্তেই। আর সেই সাথে দায়িত্বে চরম অবহেলা করার জন্য ওসি আর ইউএনও র বিরুদ্ধেও নেয়া উচিৎ কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। বুঝিয়ে দেয়া উচিৎ এটা মগের মুলুক নয়, বাঙালীর মুল্লুক। এখানে এসব ফাজলামো  চলবে না।

পরিশেষে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার সাথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত থাকা সকল সম্মানিত বন্ধুদের জন্য অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। তাই ধন্যবাদ দিয়ে আপনাদের আর ছোট করবোনা। শুধু এতটুকুই বলি, আপনাদের মতো কিছু ভালো মানুষ এখনো আছেন বলেই ,আজো অমানিশার অন্ধকারে সকল সূর্যরশ্মি হারিয়ে যেতে পারেনি। একদিন এভাবেই বিনির্মিত হবে সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নসোপান।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.