Sylhet Today 24 PRINT

বৌদির দেশপ্রেম ও আমার লজ্জা

আফরিন জাহান হাসি |  ১৫ নভেম্বর, ২০১৬

বিশাল এক পরিবারের সর্ব কনিষ্ঠ আমি । আত্মীয়, অনাত্মীয়, চেনা ,অল্প চেনা, ঢাকায় নানা কাজে আসা লোকজনের হৈ হৈ রৈ রৈ লেগেই থাকতো আমাদের বাড়িতে । ঐ রকম একটা হৈ হুল্লোড় পরিবেশ থেকে বিয়ের পর আমি এসে উঠলাম আমার বরের কর্মস্থল কাপ্তাই এ প্রকৃতির নিবিড় নির্জনতায়। পাহাড়ের উপর আড়াইশো সিঁড়ি উপড়ে তার অফিস, তারও আরো উপরে আমাদের বাংলো। সব কাজের জন্য লোক আছে, আমার কিছুই করার নেই। আমার বর টিপু বড়কর্তা, সবাই হুজুর হুজুর করায় ব্যস্ত। কাজেই, কারো সাথে প্রাণ খুলে মেশার উপায় নেই।

এরকম সময় আমাদের প্রাণের সঞ্চার করেছিল পাশের ষ্টেশনের শ্যামল স্যার (সামনা সামনি ভাই বললেও, বর স্যার বলতো বলে এভাবেই উল্লেখ করি) আর শিলা বৌদি। ঢাকাতেই আমাদের অন্য সবাই, তাই কাপ্তাই আমাদের জন্য ভীষণ দূর, কাছাকাছি চেনাজানা কেউ নেই। টিপু আগেই বলেছিল, পাশের বৌদি'র সাথে তুমি যে কোনো আলাপ পরামর্শ যা দরকার করতে পারো। উনারা চমৎকার মানুষ, তুমি ভালো গাইডেন্স পাবে।

উনারা শুধু চমৎকার না অসাধারণ মানুষ। আমাদের সমস্ত দায়িত্বই যেন নিয়ে নিলো। সব কিছুতেই বলতো, নতুন বিয়ে আমাদের নাকি এখন শুধু শেখার সময়। কুক থাকলেও বৌদি নিজে রান্না করতো। টেবিল ভরা মজার মজার সব রান্না দিয়ে বৌদি আপ্যায়ন করতো। যদি কখনো আসতে বলতাম, উল্টো যেতে হতো। কারণ আমাকে তো আগে শিখতে হবে, আসলে আমাদের কোন কষ্টই তারা দিতে চাইতো না।

বৌদিদের প্রথম সন্তান তখন মাত্র কথা বলতে শিখছে, আন্নি আন্নি বলে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তো, আমার তখন ভাই-বোনের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর অভাব কিছুটা দূর হতো। উনাদের ফ্যামিলি দেখে আমার ভেতর একটা ফিলিংস হয়েছিল যে আমার বরের ক্যাডার (বিসিএস) খুবই ভালো, অফিসারদের মধ্যে এত সুন্দর সম্পর্ক, যেন নতুন আত্মীয় পেলাম। এরপর দুই ফ্যামিলি দুই জায়গায় বদলি হয়ে গেলো, কিন্তু ভালোবাসা টা রয়ে গেলো।

এরমধ্যে আমরা ভীষণ পারিবারিক জটিলতার মাঝে পরলাম, কিছুতেই সমাধান করতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তার প্রস্তুতি যখন চলছে, আমার বর একদিন বললো, চলো শ্যামল স্যারদের ওখান থেকে ঘুরে আসি। ওনারা তখন চাঁদপুর জেলায়। আমাদের তখন ঐ প্রাণখোলা ভালোবাসার পরিবেশটা খুব দরকার ছিলো। দুই পিচ্চি নিয়েও বৌদি আমাদের আদর যত্নে লেগে গেলেন। আমি নাকি অনেক শুকিয়ে গেছি। জোর করে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন। নাইওরি যাওয়া যেরকম, ওরকম বড় ভাইয়ের মত আমাদের জন্য একগাদা উপহার নিয়ে আসলেন দাদা।

চাঁদপুরে নদীর তীরে ঘুরতে ঘুরতে বৌদি কে বললাম, কানাডা যাওয়ার চেষ্টা করছি, আপনারাও করবেন নাকি? বৌদি সাথে সাথে বললো, উনি নিজের দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চান না। আমাকে ও বোঝালো না যেতে। জিজ্ঞেস ও করলো, আমার কি কষ্ট হবে না! বৌদি যে কষ্টের কথা স্পষ্ট করে বলেছিল, আমার ঐ সিচুয়েশনের কারণে কিনা জানিনা আমি তখন অতো স্পষ্ট করে তা সত্যি বুঝিনি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার দেশপ্রেম এ ঘাটতি ছিল কি? এখন সেই কষ্ট হাড়ে হাড়ে টের পাই প্রতিদিন। বৌদির অনুভূতি পরিষ্কার ছিলো। উনি উনার ডিসিশন এ স্ট্রং ছিলেন। আমাকে এও বলেছিলেন যে ইন্ডিয়াতে কিছু পরিচিত, আত্মীয় আছে, তারপরও ওখানেও যেতে ইচ্ছে করে না। নিজের জায়গা, নিজের দেশ ছেড়ে উনার ভালো লাগে না। লাগবে না উনি জানেন।

আজকে এত বছর পর বৌদির সেদিনের কথা এত করে মনে পরছে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখে। বৌদি যত দৃঢ় ভাবে তার দেশপ্রেমের অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন, আমার মাঝে ঐ দৃঢ়তা থাকলে হয়তো আমি আসতাম না দেশ ছেড়ে। অথচ ঐ বাংলাদেশে তার ধর্মের লোকদের দেশ ছাড়া করতে কি করছে লোকজন! সরকারও কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না তা বন্ধ করতে। বৌদির মত আরো অনেকেরই হয়তো আমার থেকে দৃঢ় ভাবে দেশপ্রেম কাজ করে, তারা চায় না কোনো অবস্থাতেই দেশ ছাড়তে। তারপরও তাদেরই শুনতে হয় তারা নাকি ইন্ডিয়াতে এক পা দিয়ে রেখেছে! আসলে আমাদের নিজেদের মনের কথা তাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছি।

আজকে এখানে একজনের (হিন্দু ধর্মাবলম্বী) কাছ থেকে শুনলাম তার পরিচিত একজন (মুসলমান ধর্মাবলম্বী) তাকে বলছে তোমার আত্মীয়রা (বাংলাদেশে) কেন ইন্ডিয়াতে চলে যাচ্ছে না? তাহলেই তো এগুলো ফেইস করতে হয় না। যে এই সমাধান দিয়েছে সে নিজে দিনে কয়েকবার দেশ ছেড়ে আসার জন্য হা হুতাশ করে। আমি ভেবে পেলাম না যেখানে সে নিজে দেশ ত্যাগের কষ্ট সারাক্ষণ ফিল করছে সে কিভাবে আরেকজন কে এই উপদেশ দেয়? কারণ তার ভেতরে কাজ করছে যে বাংলাদেশ হিন্দুদের নিজের দেশ না। সে কি একবারও চিন্তা করছে, নিত্যদিনের বেড়ে ওঠা যে ভূখণ্ডের জন্য তার হাহাকার, সেই একই হাহাকারও একজন হিন্দুর হওয়াটাই স্বাভাবিক?

তখন থেকেই বৌদির দেশপ্রেমের দৃঢ়তা মাথার মধ্যে ঘুরছে। আমার প্রায়ই আফসোস হয় আমি যদি ঐ ভাবে ফিল করতে পারতাম তখন ! আজকে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী, আদিবাসী দের সঙ্গে যা হচ্ছে তা রোধ না করতে পারলে, এর পরিণতি হবে ভয়ানক। এরপর যারা এগুলো করছে তারা নিজেদের মধ্যে সবল আর দুর্বল ভাগ করে অত্যাচার শুরু করবে। এর প্রতিকারে আমাদের সবাই কে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের শান্তির জন্য, নিজেদের শান্তির জন্য। মানুষের প্রতি মানুষের যে আস্থা ভালোবাসা তা যদি না থাকে এ পৃথিবী আবাসযোগ্য থাকবে না।

আমার একপাশে শিখ ধর্মাবলম্বী আর এক পাশে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী পরিবারের বাস। দুই ফ্যামিলিই অসাধারণ মানুষ । পাঞ্জাবি এবং সাদা দুজনেই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমি মাঝে মাঝে ভাবি আমার যদি তাদের উপর, এখানকার আইনের উপর আস্থা না থাকতো, আমি দুই সন্তান নিয়ে কিভাবে এখানে বসবাস করতাম! আজকে যদি আমার সন্তানদের তার প্রতিবেশীকে নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হতো, কেমন দুর্বিষহ হতো আমাদের জীবন?

অনেক ছোটবেলায় টিভিতে কুইনী নামে একটা সিরিয়াল দেখেছিলাম, সেখানে হিন্দু- মুসলমান দাঙ্গার দৃশ্য দেখে আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম, আজো সেটা আমাকে পীড়া দেয়। তারপরও সান্ত্বনা পেয়েছিলাম এই ভেবে যে সেটা অনেক আগের ইতিহাস ছিল, আজ আর সেই অবস্থা নেই। আমি খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি। সেখানে শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীর সমাহার ছিল বিভিন্ন ধর্মের। একই বেঞ্চে একসাথে মিলেমিশে বেড়ে উঠেছি সব ধর্মের মানুষ। আমাদের প্রাণপ্রিয় টিচার ছিল একজন গারো মেয়ে। নাম তাঁর সুকৃতি চিষিম। ক্লাস ফোরে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর বরের বদলী হয়ে গিয়েছিল অন্য কোথাও। সে কি আমাদের কান্না! আজোও তাঁর ভালোবাসা অনুভব করি। তাঁর মিষ্টি মুখটা স্পষ্ট মনে আছে।

মতিঝিল সেন্টার গভর্নমেন্ট এ আমাদের সবার প্রিয় স্যার ছিলেন তপন স্যার। কলেজে দুই বছর প্রতিদিন আমি, সূচী, জয়া, লিজা- দুজন হিন্দু আর দুজন মুসলমান একসাথে বসেছি। আজকের বাংলাদেশে কি সেই পারস্পরিক ভালোবাসা আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না? এখনো যদি আমার এলাকার কারো কোন দুঃসংবাদ পাই, মনটা বিষাদ হয়ে থাকে। যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী তার এলাকার মানুষের উপর অত্যাচারের খবর দেখছে তার কেমন লাগছে? বাংলাদেশের প্রতি আমার যে নাড়ীর টান, সেই একই টান তো ওখানে বেড়ে ওঠা একজন হিন্দুরও, যেরকম কানাডার প্রতি নাড়ীর টান আমার সন্তানদের। যে আলো-বাতাস এ আমাদের বেড়ে ওঠা তা জড়িয়ে আছে আমাদের সর্বাঙ্গে ,স্বাদ-বর্ণ- গন্ধে।

আমার তো মনে হয় প্রত্যেকেই খুঁজে বেড়ায় নিজ নিজ পরিচিত সেই আলো বাতাস, গন্ধ। আবারো আমি বৌদির দেশপ্রেমের দৃঢ় তার কথা বলবো। আসুন আমরা বুঝতে শিখি একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীও অনেক তীব্রভাবে, স্পষ্টভাবে তার দেশকে ভালোবাসে। এদেশে জন্ম নেয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, আদিবাসী সবারই সমান অধিকার। সরকার থেকে আপামর জনসাধারণ সবার প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ আসুন আমরা বাংলাদেশকে রক্ষা করি। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে, আস্থাকে রক্ষা করি। বৌদি তার দেশ ছেড়ে কোথাও যায়নি। দাদা নিষ্ঠাবান অফিসার। কিন্তু তাদের ভেতরটা কি ভেঙ্গে মুচড়ে যাচ্ছে না, তাদের ধর্মের লোকদের উপর এই অত্যাচার দেখে? যেই সরকারের জন্য তিনি কাজ করে যাচ্ছেন, সেই সরকারের এই বিষয়ে নির্লিপ্ততা দেখে তিনি কি ক্ষুব্ধ হচ্ছেন না? আমাদের জন্য যে ভালোবাসা উনারা দেখিয়েছিলেন, তার প্রতিদানে দিতে পারিনি কিছুই। আর আজকের এই পরিস্থিতি সেই না দিতে পারার লজ্জা বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ। লোভ, ঘৃণা, হিংসা দূর হোক সবার অন্তর থেকে। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জয় হোক ।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.