Sylhet Today 24 PRINT

বন্ধু শাকিল বেঁচে থাকবে কর্মে-সৃষ্টিতে

সুজাত মনসুর |  ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৬

দিনটা যে এভাবে শুরু হবে ভাবতে পারিনি, ভাবাও ঠিক নয়। কেননা, সবাই চায় দিনের শুরুটা হোক শুভ্র-সুন্দর-সুখকর হয়ে। কিন্তু যা ভাবা যায় তা কি হয়? হয় না। যেমন হয়নি আজও, হয়নি গত কয়েকদিন আগেও। আজ (৬ ডিসেম্বর) সকালে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে হেঁটে ঘরে ফিরছিলাম আর মাথার মধ্যে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম, আমার নতুন বই, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর শেষাংশের কিছু কাজ কিভাবে শুরু করবো। এছাড়া এটাও চিন্তা করছিলাম, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লেখক এবং সাংবাদিক ফোরাম, ইউকের প্রকাশের তালিকায় `একা একজন যুদ্ধ কিন্তু শত সেক্টরে’`-এর ফাইনাল প্রুফ দেখে আজ/কালকের মধ্যেই প্রকাশকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যে বইটিতে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি, বন্ধু শাকিলের একটা লেখাও রয়েছে। কিন্তু সবকিছু এলোমেলো করে দিল একটি অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ।

কিন্তু সবকিছু এলোমেলো করে দিল একটি অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ। একরকম দুঃসংবাদ পেয়ে স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম মাত্র কিছুদিন আগেও, প্রিয় সানু মিয়ার অকাল প্রয়াণে। একইভাবে স্কুল থেকে ফিরে নিত্যদিনকার অভ্যাসবশত: ফেইসবুক খুলেই বিলেত প্রবাসী প্রিয় জামাল খানের স্ট্যাটাসে জানতে পেরেছিলাম সানু মিয়ার মৃত্যু সংবাদ, যা এখনো মেনে নিতে পারিনি। সেদিনও কম্পিউটার অন করে বসেছিলাম দুদিন আগে পাঠানো সানু মিয়ার একটি সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য। সানু মিয়ার সংবাদ ঠিকই প্রকাশ করেছিলাম, তবে তাঁর পাঠানো সংবাদ নয়, মৃত্যু সংবাদ। আজও একই অবস্থা হলো। বন্ধু শাকিলের লেখার প্রুফ দেখার পরিবর্তে লিখতে হলো, অকাল প্রয়াণের স্ট্যাটাস, এখন করছি স্মৃতিচারণ। কেননা, কোন কোন মৃত্যু মানুষকে লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক বানিয়ে দেয়।

মাহবুবুল হক শাকিলের সাথে আমার পরিচয় নব্বই-এ স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। সিলেট এমসি কলেজে অনার্স পড়া অবস্থায়ই, ঢাকার একটি কলেজ থেকে প্রাইভেটে বিএ পাসকোর্সে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যুক্ত হবার মানসে। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করি। মাত্র বছর তিনেক আগে শৈশব থেকে যে ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম এবং সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালীন (তখন সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ) স্বেচ্ছায় দল ছেড়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলাম একজন প্রাথমিক সদস্য হিসেবে। কারণ, আবেগী আমি খুনি মুশতাকের মন্ত্রীসভার জনৈক সদস্যের সাথে রাজনীতি করবো না সেটাই ছিল আমার প্রতিজ্ঞা, সে অন্য কাহিনী।
শাকিল এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ছিল আর আমার এটাচমেন্ট এফ রহমান হলে থাকলেও আমি থাকতাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের একটি কক্ষে। যে রুমে থাকতেন ডাকসুর সাবেক এজিএস, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে সভাপতি নাসিরুদ্দোজা ও বরিশাল থেকে আগত ছাত্রলীগ নেতা ইসহাক আলী খান পান্না, পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। আমরা দুজনই সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী ছিলাম। মধুতে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো। রাজপথের মিছিলে পাশাপাশি হেঁটেছি অনেকদিন। আমার তেমন লেখালেখির অভ্যাস ছিল না, সময়ও পেতাম না। শাকিলও যে একজন কবি ও গল্পকার তখনও কিন্তু জানতে পারিনি, জানতে পারি বছর দুয়েক আগে আবার যখন দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর পর ফেইসবুকের কল্যাণে তার সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ইতোমধ্যে সে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছে, শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায়ই শাকিলকে তাঁর বিশেষ সহকারি হিসেবে বেছে নেন।

বিচক্ষণ শেখ হাসিনা বুঝতে পেরেছিলেন, রাজনীতিতে যে দূর্বৃত্তায়ন চলছে সেখানে শাকিলের মতো নির্ভেজাল মুজিবাদর্শের একজন সৈনিকের ঠিকে থাকা কঠিন। তাকে রাজনৈতিক মৃত্যু থেকে বাঁচাতে হলে নিজের কাছাকাছি ডেকে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা আর বদান্যতায় খুশি হয়েছি। আরো খুশি হয়েছি শাকিল নিয়মিত গল্প-কবিতা লিখছে বলে। আবেগে আপ্লুত হয়েছি। বিভিন্নজনের কাছে গর্বভরে পরিচয় দিয়েছি শাকিল আমার বন্ধু। এমন একজন সাদামনের, শুদ্ধ মানুষের সাথে বন্ধুত্ব আছে তা পরিচয় দিতে কার না লোভ হয়?

শাকিলের সাথে নব্বইয়ের সেই উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি জাগানিয়া অনেক ঘটনাই আছে। তবে একটি ঘটনা আমার হৃদয়ে খুব বেশি অনুরণিত হয়। ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন। শাকিল আর আমি এফ রহমান হলে ভিপি ক্যান্ডিডেট। শাকিল ছাত্রলীগ আর আমি ছাত্র ইউনিয়ন থেকে। ছাত্রদল থেকে ছিল জনৈক সাঈদ আর জাসদ ছাত্রলীগ থেকে কামাল পাশা চৌধুরী(বর্তমানে গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের আহ্বায়ক সম্ভবত)।

একদিন এফ রহমান হলে গিয়েছি( আগেই উল্লেখ করেছি আমি সংশ্লিষ্ট হলে থাকতাম না) নির্বাচনী প্রচারণা অর্থাৎ ভোট ভিক্ষার জন্য। ঝির ঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। গিয়ে দেখি শাকিল রুমে বসে আছে। খিচুরি রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাকে দেখে বললো, `দোস্ত তুমিও পাশ করতে পারবে না, আমিও পাশ করতে পারব না। সুতরাং কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। এসো আমি খিচুরি রান্না করছি, ইলিশ মাছ দিয়ে দুই বন্ধুতে মিলে খেয়ে গল্প-গুজব করবো। নতুবা চল খাওয়া-দাওয়া করে সুলতান ভাইর রুমে যাই, গিয়ে গল্প করি। সুলতান ভাই তখন ডাকসুর ভিপি ও ছাত্রলীগের সভাপতি। পাশেই সুর্যসেন হলে থাকতেন। আমরা দু`জন সুলতান ভাইর ভক্ত ও শিষ্য। শাকিলের খিচুরির স্বাদ এখনো আমার ঠোটে লেগে আছে। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল সবারই জানা। শাকিলের কথাই ঠিক হল আমরা ফেল করলাম। তারপর গণ-আন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদের পতন। একানব্বই সালে আমি উচ্চতর শিক্ষার জন্য মস্কো চলে যাই। মস্কো থেকে ফিরে বিয়ে করে বিলেত প্রবাসী। অন্য সবার মতো শাকিলের সাথেও যোগাযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

আবার যখন পঁচিশ বছর পর যোগাযোগ স্থাপিত হলো তখন শাকিল একজন বড় মাপের কবি ও গল্পকার, পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি। ইনবক্সে প্রায়ই কথা হতো, ফিরে যেতাম অতীতে। বছর দুয়েক আগে যখন লন্ডন আসে তখন কথা ছিল আমি গিয়ে দেখা করবো। কিন্তু পারিবারিক ঝামেলা আর প্রবাসের ব্যস্ত জীবনের কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে ফোনে কথা হয়েছে কয়েকবার। এবার যখন অক্টোবরে লন্ডনে বাংলাদেশ বইমেলায় অতিথি হয়ে এসেছিল তখনও দেখা হলো না। কথা ছিল সে আমার বাড়িতে বেড়াতে আসবে। আমি লন্ডন থেকে সাড়ে তিনশ মাইল দুরে লেক ডিসট্রিক্টে থাকি। কিন্তু লন্ডনের পরদিনই জার্মানিতে বইমেলা থাকায় আসা হলো না, এবারো দেখা হলো না। এটাই বোধ হয় নিয়তি। প্রিয় মানুষগুলো এভাবেই অকালে চলে যাবে। কিন্তু এভাবে চলে যাওয়া মেনে নেয়া যায় না। তাই যখন আমার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন একজন তরুণ লেখক সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা থেকে সকালে ইনবক্সে খবরটি দেয় বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে কয়েকদিন যাবতই মনে মনে শংকাবোধ করছিলাম তার উল্টা-পাল্টা স্ট্যাটাস পড়ে। মনে হচ্ছিল কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে। বেহিসাবি মানুষের যা হবার কথা। ভালো মানুষরা কি কেবলই বেহিসাবি হবে?

গত বইমেলায় শাকিল আমার আরেকজন প্রিয় কবি ও অনুজ প্রতিম মুজিব ইরমের হাতে নিজের লেখা কিছু অবিস্মরণীয় কথা লিখে `মন খারাপের গাড়ি` কাব্যগ্রন্থটি পাঠিয়েছিল। আমি তা যত্ন করে রেখে দিয়েছি। কিন্তু বন্ধু শাকিল তুমি যে সত্যি সত্যিই মন খারাপের গাড়িতে চড়ে আকাশের ঠিকানায় চলে গেলে।

কী অভিমান ছিল তোমার? কেনই নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিলে? আমাদের কথা নাইবা ভাবলে। কিন্তু তোমার প্রিয় মউপির কথা কি একবারও চিন্তা করলে না? তুমি বিহীন মউপি এখন কি করে বাঁচবে বন্ধু?

আকাশের ঠিকানায় তুমি ভালো থেকো শাকিল। আর রুদ্রদার সেই বিখ্যাত গানটি, `ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো` গেয়ে আমাদেরকে মাঝে মাঝে জানান দিও তুমি কেমন আছো? মউপি বা ভাবীকে সান্ত্বনা দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে তুমি বিহীন মউপির জন্য তোমার হাজার হাজার বন্ধু-ভক্তের থাকবে অসম্ভব রকমের ভালোবাসা আর শুভ কামনা।

তোমার আত্মা শান্তি পাক এই কামনা করি।

তুমি বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে চিরঞ্জীব হয়ে কর্মে আর সৃষ্টিতে।

  • সুজাত মনসুর : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.