Sylhet Today 24 PRINT

১৪ ফেব্রুয়ারি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’

মাসুদ পারভেজ |  ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

তোমাদের ভালোবাসা জাগ্রত থাকুক জাফর-দীপালি-কাঞ্চনদের জন্য
যাদের ত্যাগ আর বীরত্বে সোনালি আভার বিচ্ছুরণ ঘটেছিল
নিজেদের উৎসর্গ করে নিয়তিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিল
তোমাদের স্মরণে চির অম্লান থাকুক সে সকল বীর জনতা
যারা স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে এসেছিল
বুলেট, জল-কামান, কাঁদানে গ্যাস যাদের পদযাত্রা রুখে দিতে পারে নি
ভালোবাসা জারি থাকুক তাদের লাগি।
স্মৃতির মানসে পত পত করে উড়ুক তাদের রক্তে ভেজা শার্ট
তাদের আস্তিনের নিচে হওক তোমাদের মাথা গুঁজার ঠায়
তাদের দেখিয়ে যাওয়া পথ হওক তোমাদের পাথেয়।

হে প্রজন্ম,
তোমাদের অবারিত ভালোবাসার একটু রেখো
যারা ৮৩ সনের ১৪ ফেব্রুয়ারি তোমাদের ভালবেসেছিল।  

১৪ ফেব্রুয়ারি তথাকথিত বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, তরুণ সমাজের একটা অংশ ১৪ ফেব্রুয়ারিকে এটি ধরেই পালন করে। কিন্তু আসলেই কি তাই? ১৪ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করার কতটুকু যৌক্তিক? কেনইবা এটার বিরুদ্ধে বলছি? ইতিহাস কি বলে?
 
সময়টা ১৯৮৩ সাল, ১৪ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ছাত্র জমায়েত। মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে, ছাত্র নিপীড়নের বিরুদ্ধে, তথা সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে। কিন্তু সামরিক শাসনের বুটের তলায় পিষ্ট হওয়ার পরেও বিরাট প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন জাফর, জয়নাল, দীপালি সহ সারাদেশে ১০ জনের মত বীর; যাদের লাল রক্তে রাজপথ ভিজে গিয়েছিল, সেই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। গ্রেপ্তার করা হয় ১ হাজার ৩১০ জন সংগ্রামী ছাত্র জনতাকে। তাই ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়ে আসছিল সামরিক শাসক প্রতিরোধ হিসেবে।
 
কি ঘটেছিল ১৪ ফেব্রুয়ারিতে?
সেদিনের মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্রনেতা মোস্তাক হোসেনের মতে- “সুশৃঙ্খলভাবে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট গেট ও কার্জন হল সংলগ্ন এলাকায় এসে এলাকায় এসে ব্যারিকেড দিয়ে বসে পড়েন। হঠাত কোন ধরনের উস্কানি ছাড়াই সরকারের পুলিশবাহিনী এসে  রায়ট কার ঢুকিয়ে গরম পানি ছিটাতে শুরু করে। এরপর ভেতরে ঢুকে বেধড়ক লাঠিচার্জ। সাধারণ ছাত্ররা নিজেরদের রক্ষার্থে পাথর ছুড়লে পুলিশ ছাত্রদের উপরগুলি বর্ষণ করে, এ সময় গুলিবিদ্ধ হয় জয়নাল, গুলি মেরে ক্ষান্ত হয় নি পুলিশ তার শরীরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা  করে”। তাছাড়া শিশু একাডেমীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দীপালি নামের এক শিশুও নিহত হয়। তারা শিশুটির লাশও গুম করে ফেলেছিল। বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তৈরি করা হয়েছিল ভয়াবহ অবস্থা। শাহবাগ, টি এস সি, কলা ভবনসহ পুরা রাস্তা ঘেরাও করে ফেলে, গ্রেপ্তার করা হয় বহু ছাত্রনেতাকে। এসবের প্রতিবাদে উপাচার্য পদত্যাগ করলেও টনক নড়েনি সরকারের। লাশ খুঁজার নামে তল্লাশি করা হয়েছিল সারা ক্যাম্পাসে। প্রায় ২০০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনড় অবস্থার প্রেক্ষিতে ১৫-১৬ তারিখের মধ্যে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সামরিক শাসক এরশাদ। ঢাকায় ঘটা ঘটনার রেশ ধরে চট্টগ্রামেও শুরু হয় আন্দোলন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালালে শহীদ হন কাঞ্চন।

এভাবে সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে গণআন্দোলন। ১৪ ফেব্রুয়ারির সেই গণ-বিস্ফোরণে নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্ররা। শুধু তাই ই নয় এরশাদ দায়িত্ব  নেওয়ার প্রথম দিনেই ছাত্ররা এটার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, সরকারের বিরুদ্ধে   দেওয়াললিখন সহ নানানভাবে আন্দোলন চলেছিল। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে ১৭ তারিখে ছেড়ে দেওয়া হয় ১ হাজার ছাত্রকে, কিন্তু আটকে রেখেছিল ৩১০ জনকে, স্থগিত করে কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষানীতি। বস্তুত এটার বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এবং তা ধীরে ধীরে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপলাভ করেছিল। মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও  শিক্ষার ৫০% ছাত্রদের বহন করতে হত। দারিদ্র্য ছাত্রদের জন্য আঘাতস্বরূপ এ নীতির বিরুদ্ধে ছাত্ররা ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর একমত হয়েছিলেন ছাত্রসংগঠনগুলো। অবশেষে নানা  চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি নেই, আর সেই দিনেই ছাত্র জনতার উপর ঘটে গিয়েছিল কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। সারা দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল হাজার হাজার ছাত্রকে।

কিন্তু সামরিক সরকারের কয়েক বছর যেতে না যেতেই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইনস দিবস হিসেবে পালন করার জন্য আহবান জানায় শফিক রেহমান সম্পাদিত ‘যায়যায়দিন’। অতপর গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া এবং ইতিহাস ভুলে যাওয়া। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে আজ ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ পালিত না হয়ে পালিত হয় ভালোবাসা দিবস। এতে করে শাসকশ্রেণী লাভ তুলে নিচ্ছে দুইভাবে, এক- সমাজের সবচাইতে লড়াকু অংশ যুবসমাজকে মুক্তির লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন, নির্জীব করে ফেলে এবং দিনটাকে বাণিজ্যের মহা উৎসবে পরিণত করে।   

আশার কথা হল আমরা জাগতে শুরু করেছি এখন সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে, সকল অন্যায় এবং সকল অরাজকতার বিরুদ্ধে। এখন চেতনা মানেই ৭১, ৭১ দিয়েই আমরা শত্রু-মিত্র নির্ধারণ করবো। আসুন কথা বলি ন্যায়ের পক্ষে, অবস্থান গ্রহণ করি সত্যের পক্ষে।

গণহত্যার জবাব গণঅভুথান – “সুনাম সুত্রধরের কবিতার সাথে একমত হয়েই বলছি -
যে মানুষটি এখনো নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে চিল কোঠায় বসে আছে-আমি তাকে ঘৃণা করি”।
গলফ খেলার মাঠে শিশির মাড়িয়ে, তাবৎ আমলার সুন্দরী স্ত্রীর, যৌনী  মুখে নিয়মিত বীর্যপাত শেষে গণহত্যার রিমোট কন্ট্রোল ভিজিট -বাহ কি চমৎকার বাংলাদেশ!

একই কবিতার অন্য এক পঙক্তিতে তিনি বলেছেন – “মানুষ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, জাত্রাপুরে- ডেমরায়, লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রতিটি জেলায়। মরছে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে মানুষ লড়াই করছে”।

আসুন "বিশ্ব বেহায়া" নির্লজ্জ হত্যাকাণ্ডের এই দিনটিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ হিসেবে পালন করি, নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দিই বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসের কথা।
মাসুদ পারভেজ : কবি ও প্রাবন্ধিক; ইমেইল: [email protected] 

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.