Sylhet Today 24 PRINT

দোহার: আমার সুজন, আমার স্বজন

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার |  ১৪ মার্চ, ২০১৭

দোহারের কথা বললেই আমার চোখে ভেসে ওঠে এক স্বপ্নচারী মানুষের মুখ! প্রথম জীবনে সেই মানুষটি এতটাই সৌখিন ছিলেন যে তাঁর কেতাদুরস্ত জামা কাপড় তৈরি হয়ে আসত তখনকার বোম্বাই শহরের নামী দামি দোকান থেকে।

পেশায় ফিল্ম ডিভিশনের ফোটোগ্রাফার এই মানুষটির লেন্সে চিত্রিত হতে বিশেষ পছন্দ করতেন নাকি স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীও। মানুষটির অন্য পরিচয় তিনি ছিলেন লোকগানের ভিতরমহলের স্বজন। তবলা ছাড়াও নানা ধরনের যন্ত্রবাদনে তার ছিল অপরিসীম সহজাত দক্ষতা।

পঞ্চাশের স্বর্ণযুগে গুয়াহাটিতে গণনাট্যের সম্মেলনে মহারাষ্ট্রের লোকশিল্পী ওমর শেখের সাথে সঙ্গত করতে গিয়ে যখন দিকপাল তালবাদ্যের শিল্পীরা কুপোকাত, তখন ক্যাম্পের খড়ের ওমে ঘুমিয়ে থাকা বালক বয়সের সেই মানুষটিকে তুলে নিয়ে ঢোল হাতে ওমর শেখের সামনে বসিয়ে দিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। চোখ কচলে ঘুমের আচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া বালকটিকে দেখে বিদ্রুপ করেছিলেন ওমর শেখ। ‘হেমাঙ্গবাবু, এই বাচ্চা ক্যায়া বাজায়গা!’ নিরুপায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস উত্তরে বলেছিলেন, ‘অউর কোয়ি নেহি বাচা। অগর সাকেগা তো ইয়ে বাচ্চাই সাকেগা!’

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জহুরির চোখ সেদিনও সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। হাল ফ্যাশনের আদবকায়দায় আদ্যোপান্ত সাবলীল মানুষটির জীবনে হঠাৎই একদিন বিপ্লব নিয়ে এল এক রিক্সাওয়ালা, নাম তুরফান আলি। রিক্সা চালানো তার পেশা হলেও সে ছিল এক লোকশিল্পী। বিলাসের বাহারি পোশাক ছেড়ে দিলেন তিনি। সাদা কুর্তা আর পাজামা গায়ে রিক্সাওয়ালা তুরফানকে সঙ্গী করে বরাকের মোকামে মোকামে আখড়ায় আখড়ায় মাটির গানের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে থাকলেন। হয়ে উঠলেন বরাকের লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারী। তিনি অনন্তকুমার ভট্টাচার্য।

হাজার হাজার গান সংগ্রহ করেছেন। কত কত লোকশিল্পীকে তুলে ধরেছেন সাধারণ্যে। তাঁদের ব্যক্তিজীবনের সুখদুঃখের সাথে এক হয়ে গেছেন। গড়ে তুলেছিলেন এমন একটি লোকগানের দল লোকবিচিত্রা, যা আকাশবাণীর বিচারে ভারতের প্রথম এ-গ্রেড পাওয়া লোকগানের দল। মানুষটাকে স্বপ্নচারী বলেছি প্রথমে। কারণ সময়ের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে ছিলেন অনন্ত কুমার। তাঁর স্বপ্নকে বুঝতে পারত না তাঁর সমকালের বেশিরভাগ মানুষ। এখন দৈনন্দিন জীবনের নানা ধরনের বাহ্যিক শব্দকে সঙ্গীতে ব্যবহার করার কথা বলছেন অনেকে এবং কিছু কিছু প্রয়োগ তারও শুরু হয়েছে।

তখন নব্বুইয়ের গোড়াতেই আকাশবাণীর মনোরেকর্ডিং-এর সীমাবদ্ধতাকে তুচ্ছ করে হাঁড়ি বাসন থালা কাঠের টুকরো সহ সঙ্গীতে সাধারণভাবে অনাবশ্যক নানা উপকরণকে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে এক অতুলনীয় সঙ্গীতসজ্জা তৈরি করেছিলেন অনন্তকুমার। স্বপ্ন দেখতেন আমাদের আধুনিক সঙ্গীত দক্ষিণের ইলিয়া রাজার মত লোকঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে এগোবে। সময় থেকে এগিয়ে যাঁরা স্বপ্ন দেখেন তাঁদের অনেকেরই জীবন শেষ পর্যন্ত কাটে গভীর হতাশায় ও অপূর্ণতায় চরম দুঃখে।

অনন্তকুমার স্বপ্নসম্ভাবনার অসংখ্য কুঁড়ি ফুটিয়েও অকালে চলে গিয়েছিলেন এই পৃথিবী থেকে। দোহার-এর প্রাণপুরুষ কালিকাপ্রসাদ অনন্তকুমারের ভাইপোই শুধু নয়, সে তাঁর সঙ্গীতাদর্শের উত্তরাধিকারীও। কাকার অপূর্ণ স্বপ্নকে বাস্তব করার ব্রত থেকেই তৈরি করেছিল দোহার।

অনেক পথ পেরিয়ে দোহার আজ শুধু সাবালক নয়, বাংলা গানের অন্যতম প্রধান নাইয়া। যে স্বপ্ন দেখতেন অনন্তকুমার ভট্টাচার্য তারই সার্থক রূপায়ণ আজ দোহারের মধ্যে। লোকসঙ্গীতের যে কোনো ধরনের বিকৃতির বিরুদ্ধে আমৃত্যু সোচ্চার ছিলেন অনন্তকুমার।

যদিও লোকসঙ্গীতের আঞ্চলিকতাকে অস্বীকার না করে সৃজনশীল প্রয়োগের বিরোধী ছিলেন না তিনি। তরুণ কন্ঠের আধুনিক প্রয়োগকে ভালোই বাসতেন। জানতেন, গ্রামীণ লোকশিল্পীর গায়ন আর নাগরিক লোকসঙ্গীতশিল্পীর কখনো গায়ন এক হবে না। কিন্তু বাণিজ্যিক বিকৃতির ঔদ্ধত্য ও মূর্খতা কখনোই মেনে নিতে পারেননি। কোনো প্রতিযোগিতা মঞ্চে হয়ত কেউ ইচ্ছেমত বিকৃত করছে কোনো পরম্পরাগত গানকে, বিচারাসন থেকে ‘হোল্ড!’ বলে বজ্র গর্জনে থামিয়ে দিয়েছেন শিল্পীকে। রাগে ঠকঠক করে কাঁপতেন তখন।

গভীর যন্ত্রণাবোধ থেকে জন্ম নেওয়া এই আপোষহীন মনোভাবকে ক’জনইবা বুঝত! এখন যখনই দেখি সমকালে ঘটে যাওয়া লোকসঙ্গীতের নানা বিকৃতির বিরুদ্ধে দোহারের অনুষ্ঠানে গানের মাঝে সোচ্চার হয়ে উঠছে কালিকা, কানে যেন শুনতে পাই অনন্তকুমার ভট্টাচার্যের ‘হোল্ড!’।

দোহারের কথা বলতে গিয়ে অনন্তকুমার ভট্টাচার্যের কথা এতটা সবিস্তারে বলার কারণ শুধু কালিকা বা অনন্তকুমারের সাথে আমার ব্যক্তি হিসেবে বিশেষ ভাবে সম্পর্কিত থাকা নয়। এটা বলা এই কথা বোঝাতেই যে, দোহার হঠাৎ একদিন আকাশ থেকে পড়ে নি। তারও একটা পূর্ব-ইতিহাস আছে, একটা ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করছে দোহার।

শুধু দোহারই নয়, ব্যক্তি হিসেবে কালিকাও। একটা পরিবার, একটা প্রতিষ্ঠান, অসংখ্য মানুষ, একাধিক সংগঠন আন্দোলন, একটা বিরামহীন স্বপ্ন, সাধনার বহমানতায় জন্ম নিয়েছে দোহার। এখানেই তাঁরা কলকাতা শহরে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বহু গানের দল থেকে আলাদা।

আরেকটা কথা, শুধুমাত্র পূর্বসূরীর চর্চার যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি করে বা পূর্বসরীদের তৈরি করা ভাণ্ডারকেই সম্বলমাত্র করেও উত্তরাধিকার নির্মিত হয় না। উত্তরাধিকার নির্মিত হয় পূর্বসূরীদের চলা পথ বেয়ে নিজের সমসময়ে পথ হেঁটে। কালিকা শুধু তাঁর কাকার ভান্ডারকে ভেঙে গান গাইছে না। নিত্যনতুন লোকগানের খোঁজে নিজেও ঘুরে বেড়িয়েছে অসংখ্য গ্রাম শহর চাবাগিচা কয়লাখনিতে।

শেকড় উৎখাত হয়ে পরবাসী হওয়া লোকসমাজের মানুষের লোকগানে কীভাবে ছায়া ফেলে নতুন সমাজকাঠামো এবং পরিবর্তিত জীবনপ্রবাহ, তারও সন্ধান করেছে সে একজন গবেষক হিসেবে। খালেদ চৌধুরী রণজিৎ সিংহ রণেন রায় চৌধুরী হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা আমৃত্যু প্রান্তবাসী মানুষের গান নিয়ে সাধনা করেছেন এক অর্থে প্রান্তবাসী হয়েই। এটা নিয়ে আমাদের এক সশ্রদ্ধ মুগ্ধতা আছে ঠিকই। কিন্তু এর মাধ্যমে প্রান্তবাসী মানুষের গান নিয়ে মূলধারার সঙ্গীতচর্চায় সে অর্থে কোনো অন্তর্ঘাত ঘটানো যায় না। দোহার এক্ষেত্রে অনন্য।

প্রান্তবাসী মানুষের গানকে সঙ্গী করে, কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের অনাকাঙ্খিত অনুপ্রবেশ ছাড়াই মূলধারার সংস্কৃতির আসরে নিজেদের জোরালো উপস্থিতি ব্যক্ত করেছে তাঁরা। প্রত্যাহ্বান জানিয়েছে সমাজের ওপরতলার সংস্কৃতির উদ্ধত মিনারকে।

আজ মহানগরীর সঙ্গীতের আসরে নাগরিক স্রষ্টাদের পাশে একই সম্মানে গীত হচ্ছে শাহ আবদুল করিম, রাধারমন, দ্বিজদাস, মলয়া, দীন ভবানন্দ থেকে শুরু করে মুকুন্দ তেলির গান। বাণিজ্যিক সঙ্গীতের পরিমণ্ডলে এইসব মহাজনদের গান এবং লোকায়ত বাদ্যযন্ত্রকে একমাত্র নির্ভর করে যে মর্যাদার আসনে নিজেদের অধিষ্ঠিত করেছে দোহার, তা নিঃসন্দেহে শ্লাঘার বিষয়।

সত্যি কথা বলতে কী বাংলা গানের সর্বাত্মক আকালের সময়েও আমরা যে এখনও স্বপ্ন দেখার সাহস পাই, তার অনেকটাই দোহারের জন্যে। সে জন্যেই দোহার আমার কাছে ভালোবাসার, শ্রদ্ধার এবং ভরসার একটি নাম।

লেখক শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার ওপার বাংলার একজন সঙ্গীত শিল্পী। ‘আরম্ভ’ পত্রিকায় দীর্ঘদিন আগে ‘দোহার’ নিয়ে করা একটি বিশেষ সংখ্যায় এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সম্প্রতি সড়ক ‍দুর্ঘটনায় প্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য এর স্মরণে তার কাছেরজন শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের এ লেখাটি পুণঃপ্রকাশ করছে সিলেটটুডে টুয়েন্টিফোর ডটকম.

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.