Sylhet Today 24 PRINT

ভাস্কর্য অপসারণ ও আওয়ামী-হেফাজত খেলা

আল আমিন হোসেন মৃধা |  ১২ এপ্রিল, ২০১৭

"আমরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু উশৃঙ্খলা চাই না, কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করতেও চাই না। অথচ কোনো কাগজে লেখা হয়েছে মুসলমানকে রক্ষা করার জন্য সংঘবদ্ধ হও। যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমার দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে, এখানে বসে কেউ যদি তার বীজ বপন করতে চায়, তাহলে তা কি আপনারা সহ্য করবেন?" বলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

তিনি আরো বলেছিলেন, "আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না।"

ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আলোকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়েই তৈরি হয়েছিল আজকের এই বাংলাদেশ। যুগে যুগে সামরিক বা গণতান্ত্রিক সরকার যে-ই ক্ষমতায় এসেছে, ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ক্ষমতায় টিকে থাকবার জন্য।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধ্বংস করে সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র বাদ দেয়াসহ মুক্তিযুদ্ধে মৌলবাদি অপশক্তি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবহার করেছিল ধর্মকে।

১৯৮৮ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' পাস করিয়েছিলেন, নিষিদ্ধ করেছিলেন শহীদ বেদীতে ফুল দেয়া আর ব্যবস্থা করিয়েছিলেন শহীদ বেদীতে দোয়া মাহফিলের।

এদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা আনার পেছনে জিয়াউর রহমান চার আনা দায়ী থাকলে বারো আনা দায়ী এরশাদ। যে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, সেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় পাশে বসিয়েছে এরশাদকে। এখন নতুন যোগ হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলামের কথামতো পরিবর্তন করেছে পাঠ্যপুস্তক। পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতের দেওয়া ২৯টি দাবির মধ্যে পূরণ করেছে ২৭টি। বাদ দিয়েছে প্রগতিশীল, মননশীলসহ অন্য ধর্মাবলম্বীর লেখা।

হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করার ফলেই তারা আজ ভাস্কর্য সরানোর দাবি তুলেছে। তাদের প্রশ্ন- গ্রীক দেবীর মূর্তি নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে কিভাবে থাকে? দেবী আর ভাস্কর্যের মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা কি তারা বোঝে? মূর্তিকে পূজা করার উদ্দেশে তৈরি করা হয় আর ভাস্কর্য স্তাপন করা হয় স্মারক হিসেবে। সুপ্রিম কোর্ট এর সামনের ভাস্কর্যটি গ্রীক দেবীর আদলে তৈরি করা একটি ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের বাম হাতে ন্যায় বিচারের প্রতিক হিসেবে দাড়িপাল্লা, অন্যায় করলে সবাইকে সাজা ভোগ করতে হবে সেই প্রতিক হিসেবে তলোয়ার আর বিচার সবার জন্য সমান ও এখানে পক্ষপাত অবলম্বন করার কোন সুযোগ নাই এর প্রতীক হিসেবে চোখে কালো কাপড় বাঁধা। এটা যদি মূর্তিই হতো, তাহলে এতো দিনে এখানে অবশ্যই পূজা শুরু হতো। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এখানে কি ধর্মানুভূতিতে আঘাত আনলো তা বোধগম্য নয়।

গতকাল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন শফি হুজুরের (নারীকে যিনি তেঁতুলের সাথে তুলনা করেছিলেন) নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু নেতাকর্মী। তারা এই ভাস্কর্যটি অপসারণের জোড়ালো দাবি তোলেন।

ভাস্কর্যটি অপসারণের বিষয়ে শেখ হাসিনা তাদেরকে আশ্বস্ত করে বলেন, "আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি। বলা হচ্ছে, এটা নাকি গ্রিক মূর্তি… আমাদের এখানে গ্রিক মূর্তি আসবে কেন? আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা এখানে থাকা উচিৎ না। গ্রিকদের পোশাক ছিল এক রকম। এখানে আবার দেখি শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। এটাও হাস্যকর হয়েছে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “প্রধান বিচারপতির সঙ্গে খুব শিগগিরই বসব। আপনারা ধৈর্য ধরেন, এটা নিয়ে হৈ চৈ করা নয়। আমার উপর আপনারা এটুকু ভরসা রাখবেন।

ভাস্কর্য অপসারণের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে কথা হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোনার পর গণভবনে উপস্থিত আলেমরা হর্ষধ্বনি দেন।

সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্যটি থাকবে কি থাকবে না তা নির্ধারনের অধিকার সরকারের নেই। সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, এখানে অন্য কারো হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নাই। সুপ্রিম কোর্টের আঙ্গিনায় কোন স্থাপনা থাকবে কি থাকবে না সেটা নির্ধারন করবে সুপ্রিম কোর্ট নিজেই। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ মানে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের স্বাধীনভাবে চলার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান। আর প্রধানমন্ত্রী যেখানে অবস্থান করছেন, সেখান থেকে ব্যক্তিগত অভিমত দেবার কোন সুযোগ নেই।

শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, "আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যে কোনো ধরণের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছে, যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা হয়। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনদিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান।"

আজ আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের আদর্শের কথা মুখে হাজারবার বললেও ক্ষমতায় টিকে থাকা, ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার লক্ষে হেফাজতের সব দাবি মেনে নিচ্ছে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতিতে সক্রিয় হবার সুযোগ করে দিচ্ছে। যেদিন হেফাজত ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে শেখ মুজিবের ভাস্কর্যসহ শহীদ মিনার আর জাতীয় স্মৃতিসৌধ ভেঙে ফেলার কথা তুলবে, সেদিন কি করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?

একদিন এই সাম্প্রদায়িক শক্তিই স্লোগান দিয়েছিল- 'তোমার আমার ঠিকানা, মক্কা-মদিনা', 'ইসলামের ঝান্ডা ধরো, পাকিস্তান কায়েম করো', 'তুমি কে আমি কে, পাকিস্তানি পাকিস্তানি'। মুসলমান বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এই বাঙালিরাই স্লোগান দিয়েছিলো- 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো', 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি'। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সে দিনের এই স্লোগানগুলো এত দ্রুতই ভুলে গেলেন?

একদিকে হেফাজতের কথা মতো শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনে আমাদের শিশুদের ছোটবেলা থেকেই তাদের বিভক্তি, বিভাজন শেখাচ্ছেন, অন্যদিকে শেখাচ্ছেন সাম্প্রদায়িকতা। এই দ্বিধাবিভক্ত প্রজন্ম কি করে ঐক্যবদ্ধ হবে?

 

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.