Sylhet Today 24 PRINT

কওমি মাদ্রাসার দাওয়ারে-ই-হাদিসের স্নাতকোত্তর স্বীকৃতি ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ

আল আমিন হোসেন মৃধা |  ১৬ এপ্রিল, ২০১৭

এদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুই প্রকার- জাগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জাগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর মানুষের কল্যাণের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়। আর ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরকালের (অর্থাৎ মৃত্যুর পর) কল্যানের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়।

বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুই প্রকার- আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ও কওমী মাদরাসা শিক্ষা। আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে খরচ ও নিয়ন্ত্রণে চলে। অপরদিকে, কওমী মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়ন্ত্রণহীন ধর্ম ভীরু সাধারণ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায়, হক্কানী ওলামায়েকেরাম দ্বারা, দারুল উলুম দেওবন্দ (ভারত)-এর শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণ ও অনুকরণ করে।

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে। বাংলাদেশে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কওমি মাদ্রাসার অবস্থান দ্বিতীয়, সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরেই অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী আছে এখানে। প্রায় ৩০ হাজার কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানে ২০ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। যা সরকারি নিয়ন্ত্রণহীন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক, যা কওমি শিক্ষা বোর্ড নামেও পরিচিত) দ্বারা পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার প্রধান বা মৌলিক উদ্দেশ্য- কোরআন-হাদীসের প্রচার-প্রসার ও দ্বীন ইসলামকে বিশুদ্ধরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা এবং দ্বীনের শাশ্বত শিক্ষাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া। ইসলামী শিক্ষার সুরক্ষার সাথে সাথে নিত্যনতুন সৃষ্ট ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, ফেতনা ইত্যাদি সম্পর্কে মুসলিম জাতিকে সতর্ক করা, তাদের হিংস্র থাবা হতে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করা।

সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার মতোই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার কয়েকটি স্তর রয়েছে- তাহফিল উলবা হিফজুল কোরআন (কুরআন মুখস্থ) শেষে এবতেদায়ী (প্রাথমিক), মুতাওয়াছসিতাহ (নিম্ন মাধ্যমিক), সানারিয়া আম্মাহ (মাধ্যমিক), ফাজিল (স্নাতক) ও তকবিল বা দাওয়ারে-ই-হাদিস (স্নাতকোত্তর)। এই দাওয়ারে-ই-হাদিসকে সরকার স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে স্নাতকোত্তর সমমানের। সাধারণ শিক্ষার সাথে তুলনা করলে নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও স্নাতক পরীক্ষা ছাড়াই একেবারে স্নাতকোত্তর পাশ।

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা:
ইংরেজি ও গণিত সামান্য পড়ানো হলেও এ শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। প্রাথমিক শিক্ষায় অর্থাৎ এবতাদায়ী শিক্ষায় (২য় থেকে ৫ম) বাংলা, ভূগোল, ইতিহাস পড়ানো হলেও সমগ্র পাঠক্রমে মুসলমানিত্বের ছাপ দেওয়া হয়েছে। এ বইগুলো পড়ে বোঝা যাবে না, বাংলাদেশে মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী বাস করে। এই বই কেবল মুসলমানদের মাহাত্ম্য কীর্তন করা হয়েছে। বাংলা বইগুলোতে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব বই পড়ে কেউ বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ধারণা পাবে না। শেখ মুজিবুর রহমান, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদের অবদানের কথা শিক্ষার্থীরা জানবে না।

বাংলায় প্রথম সারির কিছু লেখকদের কবিতা-প্রবন্ধ থাকলেও কোনো শ্রেণীতেই স্থান পায়নি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার রচনা, স্থান পায়নি নারী অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কিত কোনো নিবন্ধ। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সংশ্লিষ্টরা নারী অধিকারের প্রতি অসংবেদনশীল।

পঞ্চম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম অধ্যায় পড়লে মনে হবে, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ভূমিকাই মুখ্য। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ মুসলিম লীগের ভূমিকা প্রধান করা হয়েছে (যা ইতিহাস বিকৃতির নামান্তর)। সবচেয়ে আপত্তিকর ওই অধ্যায়ের শেষ দুটি লাইন, ‘১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা এবং সেই পথ ধরেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় প্রকৃতপক্ষে সংগ্রামরত হক্কানি উলামায়ে কিরামেরই অবদান।’

জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গিতেও আপত্তি কওমীরঃ
জাতীয় সঙ্গীতে হিন্দুয়ানী তকমা লাগানো এদের বহু পুরনো। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তাক্ত লাল সবুজের পতাকাতেও এদের আপত্তি। সাধারণ ও মাদ্রাসা বোর্ডের পাঠ্যপুস্তকের শুরুতে জাতীয় পতাকার ছবি ও জাতীয় সঙ্গীত থাকলেও কওমীতে নেই। এমনকি অনুসরণের বালাইও নেই। বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বা বেফাক বলছে, "সাধারণ শিক্ষার ধারায় এখনও ব্রিটিশদের ছাপ রয়ে গেছে, অন্তত তা থেকে তারা ব্যতিক্রম।" জাতীয় সঙ্গীত ও পতাকা তাদের কাছে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ছাপ মনে হয়।

স্বাধীনতার ঘোষক শেখ মুজিবকে মানতেও তারা নারাজ, তাদের কাছে জিয়াই এদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। কওমি মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যা শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশবাসী দিশেহারা হয়ে পড়ে। এমনি এক সময়ে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার ঘোষণা শুনে বাংলার জনগণ অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ঐ প্রবন্ধে জিয়াকে স্বাধীনতার ‘ঘোষক’ বলা হলেও শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক বা বঙ্গবন্ধু হিসাবেও উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন, সে বিষয়েও কোনো তথ্য নেই। বেফাক বলছে, জেনেশুনেই তাদের পাঠ্যপুস্তকে ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘোষক মানতে তাদের আপত্তি রয়েছে।

একটি পত্রিকার সাথে আলাপকালে বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জব্বার (হেফাজত ইসলামের আন্দোলনের সাথে সক্রিয়) ‘স্বাধীনতার ঘোষক তো শেখ মুজিব না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তিনি তো পাকিস্তানের জেলখানায় ছিলেন। ঘোষণা তো জিয়াই দিয়েছেন। উনি (বঙ্গবন্ধু) তো জেলখানায়, কোথায় ঘোষণা দিয়েছেন?"

অথচ, ২০০৯ সালের ২১ জুন হাইকোর্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে রায় দেযন। ওই রায়ে ইতিহাস বিকৃতির জন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা রয়েছে।

মাওলানা জব্বার আরো বলেন, "সরকার আইন করে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক বলাটা ভুয়া আইন, জোচ্চুরি। এটা হয় না। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক- আমিও এটার পক্ষে। জেনেশুনেই তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়েছে।”

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড শুধু মাত্র দাওয়ারে-ই-হাদিসের পরীক্ষা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে নেবে (সরকারি কোন প্রতিনিধি থাকবে না) আর তাদের মিলবে স্নাতকোত্তর সার্টিফিকেট। যে কওমি মাদ্রাসা থেকে পাস করে বাংলাদেশের মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন হিসাবে বেশিরভাগই চাকরি নিতেন, আজ তারা সার্টিফিকেট পেয়ে সুযোগ পাবেন সরকারি মন্ত্রণালয়ে, শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা অধিদপ্তরসহ সব ক্ষেত্রেই। ফলাফল কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

সরকার যখন এই কওমিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল, তখন হেফাজতে ইসলাম ও বেফাক বিরোধীতা করে বলেছিল, "সরকারী ব্যবস্থাপনায় যখন জাতির আশা-আকাঙ্খার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে না, তখন জাতি কিছু দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেয়। আমাদের দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো যে সকল প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে কোনো রকম সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই যুগ যুগ ধরে টিকে রয়েছে, এর রহস্য এটাই। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের মাধ্যমে এই দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করছেন।" আল্লাহ এই দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের রক্ষা করার মহান দায়িত্ব নিলেও এ প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট প্রদানের মহৎ দায়িত্ব নিলো সরকার।

দেশের সংবিধানের ১৭(ক) ধারায় বলা আছে, ‘রাষ্ট্র সকল শিশুর জন্য একটি একক মানসম্পন্ন, গণমুখী, সার্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত চালু করার লক্ষে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’ তাহলে কওমি মাদ্রাসা কি এই আইনের বাইরে?

সরকার এক দিকে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কথা মতো শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন করেছে আর সুপ্রিমকোর্ট এর সামনে থেকে ন্যায়বিচারের ভাস্কর্য অপসারণ করতে চাইছে, অন্যদিকে তাদের নিয়ন্ত্রণহীন এই প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ স্নাতকোত্তর সমমান সনদ দিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে শুধু মাত্র তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্তটি ছিল হিন্দুদের জন্য টোল এবং মুসলিমদের জন্য মাদ্রাসা। শুধুমাত্র ব্রিটিশ উদীয়মান সূর্যকে আরো শক্তিশালী করার জন্য।

যে হেফাজত দেশের জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে শেখ মুজিবকে মহান স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে অস্বীকৃতি জানায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে, ভাস্কর্যকে ইসলামে হারাম আখ্যায়িত করে নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করে, ক্ষমতার মসনদে নিজেদের পাকাপোক্ত করার জন্য সেই হেফাজতে ইসলামকেই আজ মাথায় ওঠালেন! নিজের পিতাকে এভাবে আর কত বিক্রি করবেন?

ভোটারবিহীন ভোটের রাজনীতিতে যেভাবে জিতেছিলেন, মৌলবাদীদের সাথে নিয়ে হয়তো আবারও আপনারা সেভাবেই জিতে ক্ষমতায় থাকবেন। কিন্তু হেরে যাবে জাতির স্থপতিরা, হেরে যাবে মুক্তিযোদ্ধারা, হেরে যাবে পুরো জাতি, হেরে যাবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা লাল সবুজের রক্তাক্ত পতাকা।

 

  • আল আমিন হোসেন মৃধা: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা কলেজ।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.