Sylhet Today 24 PRINT

নারীমুক্তিতে নজরুল : পরিপ্রেক্ষিত সিলেট

অপূর্ব শর্মা |  ২৫ মে, ২০১৭

সিলেটের মুসলিম সমাজ তখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন। পর্দা প্রথার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে নারীদের অধিকার। পর্দা প্রথার প্রভাব এতটাই প্রবল ছিলো যে, গাড়ি বা রিকশাযোগে কোথাও যেতে হলেও নারীদের বহনকারী পরিবহনের চতুর্দিক থাকতো কাপড় দিয়ে মোড়ানো। প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে যোগদান করার কোনো রেওয়াজ ছিলনা মুসলিম মহিলাদের। ঘরোয়া কোনো সভা সমাবেশে যোগদান করতে হলেও বোরকা পরে, চিকের আড়ালে থেকে তাদেরকে প্রত্যক্ষ করতে হতো অনুষ্ঠান। কিন্তু দীর্ঘদিনের এই গোড়ামির কবল থেকে বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন না অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আলোতে আসার অভিযাত্রীরা। অধীর আগ্রহ নিয়েই হয়তো অপেক্ষা করছিলেন তারা। মুসলিম নারীদের বুকে যখন কুসংস্কার পরিহারের জন্য আর্তনাদ, তখনই প্রথাবিরুদ্ধ নজরুল বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে ধূমকেতুরূপে আর্বিভূত হন। ধর্মান্ধ মাওলানারা নজরুলের বিরুদ্ধে নানা ফতোয়া দেন, প্রকাশ্যে নজরুলের সঙ্গিতের বিরোধীতা করেন। তথাপিও নজরুল আপনার পথে অগ্রসরমান। বিরুদ্ধতা অতিক্রম করে দিকে দিকে চলে নজরুলের জয়গান। সেই জয়যাত্রার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে সুরমা উপত্যকায়। গড়ে উঠে সিলেটে নজরুল প্রেমিদের বিশাল বলয়। প্রগতিশীল সাহিত্যপ্রেমিরা নজরুলকে সিলেটে নিয়ে আসার ব্যাপারে ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তাদের আকুলতায় সিলেটে আসেন বিদ্রোহী কবি। কবির সিলেট পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে মুসলিম নারী সমাজ যেন খুঁজে পায় মুক্তির পথ।

কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমবার সিলেটে আসেন ১৯২৬সালে। এসময় মাসব্যাপী সিলেটে অবস্থান করেন কবি। সেবার কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদান ছাড়া আর কোনো আনুষ্ঠানিকতার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারেন নি। কারণ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কবি প্রায় একমাস অবস্থান করেন শহরের নয়াসড়কস্থ রায়বাহাদুর রমণীমোহন দাশের বাড়িতে। কিছুটা সুস্থ হলে কবি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। তাঁর দ্বিতীয় সফর নানা কারণে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কবির এই সফর সিলেটে আলোড়ন তুলে। আসাম প্রাদেশিক মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের সম্মেলনে যোগ দিতে এলেও কবি সিলেটে প্রায় একমাস অবস্থান করেন। সিলেটের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর আথিতেয়তা গ্রহণ ছাড়াও একাধিক সভা এবং সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সম্মিলনী অনুষ্ঠানে বিদ্রোহী কবির যোগদান সূচিত করে এক নতুন অধ্যায়ের। চার দেয়ালের বৃত্তে বন্দি থাকা মুসলিম নারীরা এই সম্মেলন থেকেই পায় মুক্তির সন্ধান। নজরুলের পরোক্ষ ইন্ধন ও কটাক্ষের কারণে ঘটে ইতিহাসিক কিছু ঘটনা। প্রথাভাঙার উদ্যোগ নিয়ে দুজন মহীয়সী স্থাপন করেন নব ইতিহাস। যে পথের পথিক হয়ে মুসলিম নারী সমাজ ঘুচিয়েছে রক্ষণশীলতার অপবাদ। প্রফেসর নৃপেন্দ্রলাল দাশ তার ‘সিলেটে নজরুল’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে অল্পবিস্তর আলোকপাত করেছেন। বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন এক বাধার বিন্ধ্যাচল অতিক্রম করে, সিলেটের অচলায়তনিক পর্দা ভেঙে, আব্দুর রশীদ চৌধুরীর স্ত্রী বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ও আব্দুর রহীম চৌধুরীর স্ত্রী সভায় নজরুলের ভাষণ ও গান শুনতে যান। বেগম রহিমতো চিকের আড়ালে না বসে একেবারে হিন্দু মহিলাদের সারিতে গিয়ে বসেন। তার পিতা সরাফত আলী সভা শেষে সগর্বে বলেন, ‘প্রথম সারিতে এতক্ষণ বসে রয়েছে সে কার মেয়ে, আমারই থার্ড ডটার। আজকে সিলেটের ইতিহাসে এক নতুন চ্যাপ্টার দেখা দিল।’

সত্যি এক নতুন বিপ্লব এটা। সিলেটের নারী সমাজে জাগরণ এনে দিল। ‘জাগো নারী বহ্নিশিখা’ বলে নজরুল ডাক দিলেন। প্রাচীন সিংহদ্বারের আগল ভেঙে গেল। বইয়ের ৩৮ নং পৃষ্ঠায় লেখক এ প্রসঙ্গের যবনিকাপাত করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘নজরুলের সিলেট পরিক্রমার সুফল হলো।' এখানে প্রচলিত অবরোধ প্রথাকে তিনি শিথিল করে দিয়েছিলেন, অভিজাত ঘরের মহিলারা নেমে এসেছিলেন জনতার সামনে। যার ফলশ্রুতিতে দেখি বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী পরবর্তীকালে দেশনেত্রী হয়ে দেশ ও জাতীর সেবা করে বিখ্যাত হয়েছিলেন।’

সংগ্রামী নারীর জীবনালেখ্য গ্রন্থে জোবায়দা রহিম চৌধুরীর সেদিনকার ভূমিকা বিস্তৃত পরিসরে উঠে এসেছে। গবেষক তাজুল মোহাম্মদের ভাষায়, ‘১৯২৮ সালের কথা। সিলেটে অনুষ্ঠিত হবে মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সম্মিলনী। অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলার তিন ক্ষণজন্মা পুরুষ, ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের তিন দিকপাল। তাঁরা হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বহু ভাষাবিদ, পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। সম্মিলনীর স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে শহরের রতনমণি লোকনাথ টাউন হল। এর জন্য চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। ছাত্রনেতারা খাটছেন দিনরাত। সভা সফল করতে তারা গ্রহণ করছেন নানা পরিকল্পনা। নির্দিষ্ট দায়িত্ব নিয়ে কাজে নেমে পড়েছেন প্রত্যেকে। যোগাযোগ করছেন তারা শহরময়। ছাড়িয়ে গেছেন কেউ কেউ শহরের সীমা। অন্যান্য মহকুমা এবং থানায়ও চলছে প্রস্তুতি। সম্মিলনী সফল করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন চলছে। আয়োজকরা এক সময় ভাবলেন, নারীদের সমাবেশ ঘটানোর কথা। এ বিষয়েও তাঁরা গ্রহণ করলেন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতি ঘটানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। নির্ধারণ করা হলো মহিলা আসন। এর চারদিকে চিকের বেড়া দিয়ে তৈরি করা হয় পর্দা ব্যবস্থা। বোরখা পরিহিতা হয়ে মহিলারা বসবেন চিক দিয়ে ঘেরা অংশে। বিভিন্ন স্তরের মহিলারা হলেন আমন্ত্রিত। এর মধ্যে ছিলেন জোবায়দা চৌধুরীও।

সম্মিলনীতে নারী সমাবেশ ঘটানোর পরিকল্পনার বিরোধী ছিলেন জোবায়দা চৌধুরীর স্বামী দেওয়ান আবদুর রহিম চৌধুরী। তবুও সাদরে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন জোবায়দা চৌধুরী। নির্দিষ্ট দিনে হাজির হলেন বরাবরের মতো বোরখা পরে। আসনও গ্রহণ করেন মহিলাদের নির্ধারিত স্থানে, পর্দার ভেতরে। মঞ্চে এলেন বাংলা ভাষা, কবিতা ও রাজনীতির তিন দিকপালসহ অন্য নেতৃবৃন্দ। এমনকি জোবায়দা চৌধুরীর পিতা খান বাহাদুর সরাফত আলী চৌধুরীও আসন গ্রহণ করেছেন মঞ্চে। অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পন্ন। মাইক্রোফোনের সামনে দণ্ডায়মান ঘোষকের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো অনুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা। এরপর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দরাজ কণ্ঠে পরিবেশিত হয় উদ্বোধনী সঙ্গীত। ঠিক তখনই ঘটে এক অভাবিত ঘটনা। মুহূর্তে হলভর্তি লোকজনের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো নারী-পুরুষ আসনের মধ্যবর্তী স্থানে। চিকের বেড়া আর নেই সেখানে। উদ্বোধনী সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গেই এক টানে জোবায়দা চৌধুরী খুলে দিয়েছেন নারী আর পুরুষের মধ্যকার পর্দা। তখনকার বাস্তবতায় এটি কোনো সামান্য ঘটনা নয়। মুসলিম সমাজের কাছে তা ছিল অকল্পনীয়। বিস্ময়ের ঘোরমুক্ত হওয়ার আগেই ঘটে আরো আশ্চর্যজনক ঘটনা। জোবায়দা চৌধুরী ততক্ষণে খুলে ফেলেছেন তাঁর বোরখা। পুরোপুরি পর্দামুক্ত মহিলা হিসেবে নির্বিকার বসে আছেন তিনি। না, নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউ কেউ। একজন মাত্র মহিলা এরকম একটা ঝুঁকি নিতে পারেন, তা অবিশ্বাস্যই বটে! সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতেই পারে। বিশেষ করে চিকের আড়াল সরিয়ে দেয়ার পর আবার নিজেকে বোরখামুক্ত করে আরও শতগুণ বেশি ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি। পশ্চাৎপদতা, অন্ধ গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে অনেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও এমন বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ। পশ্চাৎপদতার বুকে এহেন আঘাত কল্পনায়ও আসেনি কারো। ফলে পুরো বিষয়টাকে কারো কাছে মনে হচ্ছিল স্বপ্ন, কেউ ভাবছিলেন দুঃস্বপ্ন। আর জেল সুপার ম্যাককয়ের মতে, ‘তোমরা একদিনে পঞ্চাশ বছরের পথ অতিক্রম করিয়াছ। মহিলারা পর্দাপ্রথা ভাঙিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িয়াছেন।’

সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ও জোবায়দা চৌধুরীর মিলিত প্রচেষ্টায়ই সেদিন এমন কীর্তি গড়া সম্ভব হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে ধারাবাহিকভাবে ঘুচে যেতে শুরু করে এই অঞ্চলের মুসলিম নারীদের বঞ্চনার ইতিহাস। নারীরাও অংশ নিতে শুরু করে আন্দোলনে সংগ্রামে। মূল স্রোতধারার সাথে সম্পৃক্ত হয় তাদের মেধা ও মননশীলতা। নজরুলের বিদ্রোহী সত্ত্বাই নারীদ্বয়ের মনোমাঝে থাকা বিদ্রোহকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল সেদিন। নজরুলের এই আহ্বানেই যেনো সাড়া দিয়েছিলেন এই দুই মহিয়সি; ‘মাথার ঘোমটা ছিড়ে ফেলো নারী/ ভেঙে ফেলো শিকল/দূর করে দাও দাসির চিহ্ন/ ওই যতো আবরণ’।

তবে নজরুলের সভায় প্রর্দা প্রথাকে এই দুই মহিয়সি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেও মৌলবাদীরা ঠিকই এর বিরুদ্ধচারণ করে। তারা প্রকাশ্যে সভা আহ্বান করেছিল এর বিরুদ্ধে। পরদিন টাউন হলে প্রতিক্রিয়াশীলদের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন কৌড়িয়া মাওলানা সাহেব। প্রত্যেক বক্তাই এই ঘটনার নিন্দা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্য সফল হয়নি সভাপতির বিকৃত বক্তব্যের কারণে। পর্দা রক্ষার জন্য তিনি সবাইকে গল্প শুনিয়েছিলেন, 'ভাইসব, আমার দুই বিবি ছিলেন। নতুন বাড়ি তৈরি করে তার সামনে এক বড় তালাব কাটাই। বর্ষাকাল, তালাবের চারপাশেই অসংখ্য চোরাকাঁটা গজায়। এক রাত্রে দুজনকেই নিয়ে গেলাম তালাবের পাড়ে। দুজনকেই চারপাশে ঘুরে আসতে বলে আমি ঘাটে রইলাম। দুজন ফিরে এলেন। একজনের শাড়িতে অসংখ্য চোরাকাটা রয়েছে। অন্য জনের শাড়িতে একটিও চোরাকাঁটা নেই। একজন শাড়ি বাঁচাবার জন্যে শাড়িখানা হাঁটুর উপরে তুলে চলেছেন। তখনই তাঁকে ধরলাম, তুমি বেহায়া, বেশরমিন্দা, তোমায় নিয়ে ঘর করা যাবে না। পরের দিন তাঁর বাপ-ভাইকে ডেকে এনে মোহরানার টাকা আদায় করে তালাক দিয়ে বিদায় দিলাম। এভাবেই সারা শরীয়তের বিধান পালন করতে হয়।’ সভাপতির ভাষণ শেষ হলে জনতার মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়। একজন উচ্চকণ্ঠে বলেন, বড় অন্যায় হয়েছে। তারপর প্রচণ্ড বাক-বিতণ্ডায় সভা পণ্ড হয়ে যায়।
ঘটনাটি নজরুল ইসলামের কানে গেলে রসিকতা করে তিনি বলেন, ‘তোমরা বড় অন্যায় করেছ, এদের বাধা না দিলে দেখতে মাওলানা তাঁর স্ত্রীকে অন্য অজুহাতে তালাক দিয়ে শেষে বউ খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে মরছেন।’

 

  • অপূর্ব শর্মা: লেখক।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.