Sylhet Today 24 PRINT

শ্রীকান্ত দাস : এক দ্রোহী সংসপ্তক

চুরানব্বইতম জন্মদিনের শ্রদ্ধা

ধ্রুব গৌতম |  ০৫ জুলাই, ২০১৭

যা করে আল্লায়
থাকি আমরা শাল্লায়

শাল্লা বর্তমান সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার উপজেলার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল। এর আদি নাম ঘুঙ্গিয়ার গাও। যেখানে উন্নয়নের লেশমাত্র পাওয়া যায়নি আশির দশক পর্যন্ত। নাগরিক অধিকার বিবর্জিত সেসময়ের এক কূপমন্ডুক অঞ্চল। বর্ষায় নৌকা আর হেমন্তে পায়ে হাঁটা ছিলো একমাত্র অবলম্বন। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ছিলোসে সময়ে অলিক কল্পনা। খরা বান আর শৈত্য প্রবাহে বিপর্যস্ত অনিশ্চিত তাদের জীবনধারা। সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেন ভাটি অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি, বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কিংবদন্তী পুরুষ কমরেড শ্রীকান্ত দাস।

শ্রীকান্তদা’র সাথে আমার পরিচয় ও আত্মিক গভীরতা উদীচী ও সিপিবি’র মাধ্যমে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নানান সমস্যা হলে তিনি আমার কাছে আসতেন, পরামর্শ নিতেন, আত্মসন্তোষ্টি নিয়ে ফিরে যেতেন। একদিন সকালে তাঁকে আমার অফিসের বারান্দায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অবস্থায় পায়চারী করতে দেখি। ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?  জবাবে জানালেন তাঁর মেয়ের দিকের এক নাতি উশৃংখল হয়ে গেছে, জেলা প্রশাসকের কাছে এসেছেন নাতিকে আইনের হাতে সমর্পন করতে।

অবাক ও ব্যাথিত হলাম। তিনি ঘর থেকে অপারগ হয়ে বেড়িয়েছেন। তাঁর মেয়েকে নাতিটা প্রতিনিয়ত উশৃংখলতায় অতিষ্ট করে তুলেছে। দিনে দিনে তা মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় তিনি আর সহ্য করতে পারেননি। একজন আদর্শ সচেতন সুনাগরিকের বাস্তবতার কাছে পরাজিত হওয়ায় যন্ত্রণা অনুভব করেছিলাম সেদিন।

সে রাতে আমি নিজে তাঁর মেয়ের কেওয়াপাড়া বাসায় যাই নাতিকে বুঝাতে। কাজ হয়নি। দীর্ঘ বছর পর কমরেডের প্রবাসী সন্তান সুশান্ত দাস দেশে ফিরলে একসাথে মধ্যাহ্নভোজে নাতিটাকে দেখি। চাল চলনে কথায় বার্তায় পোষাক পরিচ্ছদে কোথাও শ্রীকান্তদার কোন বৈশিষ্ট্যটুকুও নেই। সে বর্তমানে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের একনিষ্ঠ কর্মী।

শ্রীকান্ত দাস ১৯২৩/২৪ সালের ৫ জুলাই সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলায় আনন্দপুরের আঙ্গারুয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা যোগেন্দ্র কুমার দাস একজন কৃষক, মাতা জ্ঞানদায়িনী দাস কৃষাণী।

তিনি জগন্নাথপুরের সোনাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বর্গীয় সুরেশ চন্দ্র রায়ের কাছে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি হবিনন্দী এম-ই স্কুল, দিরাই থানার লৌলারচর মধ্যবঙ্গ স্কুল, নবীগঞ্জ হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন।

শ্রীকান্ত দাস নিজে গান লিখতেন, সুর করতেন এবং গাইতেন মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য। উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে শাল্লা থেকে দলীয় কোন অংশগ্রহণকারী না থাকলেও শ্রীকান্তদার একক পরিবেশনা বাদ যেত না। একা একজন ফেস্টুন বহন করে ঢাকার বুকে জানান দিতে শাল্লা উদীচীর উপস্থিতি। ছাত্র ইউনিয়নের, উদীচীর কিংবা পার্টির সম্মেলনে নিজের মেয়েকে নিয়ে আসতেন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য। একসময় পথ নাটকেও তিনি অভিনয় করেছেন। “মুই ভূখাহো” নাটকটিতে নরকঙ্কাল কিশোরের অভিনয় করে ২৪ ঘন্টা কারাবরণ করেন।

একবার পহেলা বৈশাখে সিলেট জেলা উদীচী শ্রীকান্তদাকে নিয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলো। ১৯৯৯ সালে সিলেট জেলা উদীচী ভারতের শিলচর এ দিশারী শিল্পীগোষ্ঠীর আমন্ত্রণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার সময় কমরেড শ্রীকান্ত দাস হেমাঙ্গ বিশ্বাস এর “বাঁচবো বাঁচবোরে আমরা” গানটির কথা ও সুর উদীচীর শিল্পীদের তুলে দিয়েছিলেন।

শ্রীকান্তদা একজন প্রকৃত গণসঙ্গীতশিল্পী । তাঁর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি “কাউয়ায় ধান খাইলোরে, খেদাইবার মানুষ নাই, খাইবার বেলা আছে মানুষ, কামর বেলা নাই”। শহীদ এডভোকেট কানন পালের ও ষোড়শী চক্রবর্তী মাসীমার বাসায় গানের আসরে সবাইকে নিয়ে তিনি গাইতেন, কাস্তেটারে দিও জোরে শান কিষাণ ভাইরে, লাঙ্গল চালাই আমরা কোদাল চালাই ইত্যাদি।

২০০৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সোপানের প্রভাতফেরীতে শ্রীকান্ত দাস অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ মারা যাওয়ায় দূর্গত মানষের সাহায্যের জন্য কানন পালের গানে সুর দেন শ্রীকান্ত দাস। গানের কথা হলো, ভিক্ষা দাও গো নগরবাসী, দাও গো ভিক্ষা দাও।

তিনি কিশোর বয়সে তাঁর বাবার কাছ থেকে সমাজতান্ত্রিক দর্শনের দীক্ষা নেন। বরেণ্য রাজনীতিবিদ কমরেড বরুণ রায়ের বাবা করুণা সিন্ধু রায়ের কাছে ১৯৪৩ সালে রাজনীতিতে তালিম নিয়ে তিনি সক্রিয় হয়ে উঠেন। তখন বৃটিশবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে থাকায় পড়াশোনার মধ্য দিয়ে এক মাস্টার মশাইয়ের সাথে মিছিলে যোগ দিয়ে বন্দে মাতরম শ্লোগান দিতেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। শ্রীকান্তদা এতো তগমাধারী নেতা ছিলেন না।  

শ্রীকান্তদার রাজনীতিতে আসা সম্ভবত উত্তাল চল্লিশে। কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ ১৯৪২ সালে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের প্রেক্ষাপটে তিনি ১৯৭২ সালে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। পার্টির কোন লড়াই সংগ্রামের ডাক তিনি উপেক্ষা করেননি। বৃদ্ধ বয়সে স্বৈরশাসক এরশাদশাহীর বিরুদ্ধে আন্দোলন, তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষার পদযাত্রা, লংমার্চ ইত্যাদিতে স্বপ্রণোদিতভাবে অংশ গ্রহণ করতেন। আশির দশকের আগে-পরে পার্টির মুখপত্র “একতা” তিনি শাল্লায় এমন কি সিলেটে এসেও সংশ্লিষ্টদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বৃহত্তর সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহসহ সারা দেশের বাম রাজনৈতিক অঙ্গনে এমনকি জাতীয়ভাবে তিনি সুপরিচিত ও সম্মানিত ছিলেন।

১৩৫০ বাংলার ফাল্গুনমাসে ১৯৪২ সালে সুরমা উপত্যকায় ৮ম কৃষক সম্মেলনে কমরেড শ্রীকান্ত দাস পার্টির বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে চিহ্নিত ও যুক্ত হন এবং প্রথম গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার বাল্লা গ্রামে জগন্নাথপুরে একমাসব্যাপী গণসঙ্গীত, পথসভা, হাট-সভা, গ্রামীণ বৈঠক ইত্যাদি তিনি যোগ দেন। ১৯৪৪/৪৫ সালে নেত্রকোনায় “অল ইন্ডিয়া কৃষক সম্মেলন” এ যোগ দেন।

জীবিকার তাগিদে জীবনে নানা পেশা বেছে নিতে হয় শ্রীকান্ত দাসকে। কলকাতায় দর্জি শিক্ষা গ্রহণ করে দর্জির কাজ করেন। পরে আজমিরীগঞ্জে ট্রেইলারে ও দোকান কর্মচারীর কাজ করেন। এরপর কুমিল্লার ব্রাকে চাকরী করেন এবং নিজের বাড়ীতে বসে ট্রেইলারের কাজ করেও জীবিকা নির্বাহ করেন।

১৪০৯ বাংলা পয়লা বৈশাখ ও ২০০২ সালের ১৪ এপ্রিল সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “সোপান” ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শ্রীকান্ত দাসেরকে সংবর্ধনা প্রদান করে। শ্রীকান্ত দাসের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, সিলেট জেলা শাখা ২০১০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি “দ্রোহী সংসপ্তক” নামে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করে।

২০০৯ সালের ১৮ নভেম্বর বার্ধক্যজনিত ব্যধিতে চিকিৎসাধীন থেকে মৃত্যুবরণ করেন শ্রীকান্ত দাস। ২০ নভেম্বর তাঁর মৃতদেহ ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

কমরেড শ্রীকান্ত দাস কোন উচ্চ পদাধিকারী নেতা ছিলেন না। কিংবা কোনো তাত্ত্বিক পন্ডিতও ছিলেন না। শ্রীকান্ত দাস বাউল ছিলেন কিন্তু ক্ষেপে গিয়ে লঙ্কাকান্ড ঘটাননি। শোষণ ও দারিদ্র লাঞ্চিত এই সমাজের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক “দ্রোহী সংসপ্তক”।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.