Sylhet Today 24 PRINT

ব্লগার হত্যাতেই শেষ নয়, শুরু মাত্র

আব্দুল করিম কিম |  ২০ মে, ২০১৫





অনন্ত বিজয় নামের ত্রিশ বছর বয়সী ছেলেটি চাপাতি হাতে, ত্রিশূল হাতে কখনো কোন ধর্মবিশ্বাসীর দিক ছুটে যায়নি। সে নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডেও জড়িত ছিল না। ছেলেটির একটি মাত্র দোষ, সে লিখতো । সে যা বিশ্বাস করতো, তাই সে লিখতো ।

সে হয়তো বিশ্বাস করতো- এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের কোন স্রস্টা নেই । সে তাঁর মত করেই সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে লেখালেখি করেছে । প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে তাঁর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ সামাজিক যোগাযোগ সাইটে বা ব্লগে সে প্রকাশও করেছে । তাঁর এসব লেখালেখির খবর পাড়া-প্রতিবেশী, এমনকি পরিবারের অনেকেরই অজানা।

ছেলেটির প্রতিবেশীদের থেকে জেনেছি, সমাজের অনিষ্ট হয় তেমন কাজে কেউ দেখেনি তাঁকে, বরঞ্চ নির্বিবাদ প্রতিবেশী হিসাবে সবার সে প্রিয়পাত্র ছিল । ব্যংকের ছাপোষা চাকুরী করা অনন্তকে বাসা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩০ কিঃমিঃ দূরের কর্মক্ষেত্রে যেতে হতো । বাসায় ফিরে বাবার ডায়বেটিক পরিমাপ করা, মায়ের সাথে টুকটাক গল্প করা । অবশেষে লেখালেখি নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো ।

অনন্ত বিজয় দাস সিলেটের ব্লু বার্ড স্কুল থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাশ করেছে। তাঁর একাধিক সহপাঠির সাথে কথা বলেছি। স্কুল জীবন থেকেই সে অন্তর্মুখী, চিন্তাশীল । ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যেস । সবসময় সে যুক্তি দিয়ে, যাচাই-বাছাই করে বোঝার চেষ্টা করতো । অহেতুক আড্ডাবাজী সে এড়িয়ে চলতো।
 
২০১১ সালে ব্লু বার্ড স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে উদযাপিত হয় । আমি আয়োজক কমিটির 'সদস্য সচিব'-এর দায়িত্ব পালন করেছিলাম । সে সুবাদে বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের অনুজদের সাথে মেশার সুযোগ হয় । খোঁজ নিয়ে দেখলাম, অনন্ত বিজয় সুবর্ণ জয়ন্তীতে নিবন্ধিত হয়নি । তাঁর বাসা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরের এই আয়োজন তাঁকে আকর্ষণ করেনি । অর্থাৎ সে তাঁর লেখালেখির জগতেই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিল ।

অনন্তের একমাত্র বড় ভাই রত্নেশর আমার ছোটভাই নাসিম রহমানের সহপাঠী । অনন্তের বড় ভগ্নিপতি সমর বিজয় সী সিলেটের নাগরিক আন্দোলনের একজন সংগঠক । আমাদের অত্যন্ত কছের মানুষ।

২০১৩ সালে সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের সংগ্রামী সময়ে অনন্ত বিজয় দাস নিয়মিতভাবে প্রতিবাদী কর্মসূচীতে অংশ নিতো । প্রচণ্ড ভিড় নিয়ন্ত্রনে সে একাধিকবার সেচ্ছাসেবকের দায়িত্বপালন করেছে । আমার সাথে তাঁর কখনো আলাপচারিতা হয়নি । তাঁর লেখা সম্পর্কেও আমার ধারণা ছিল না । অনেকেরই ধারণা নেই । কিন্তু ধর্মের তথাকথিত হেফাজতকারীরা তাঁকে চিহ্নিত করে রেখেছিল। তারা অনন্তের মত ৮৪ জন মুক্তচিন্তার লেখকের তালিকা প্রকাশ করে হত্যার অগ্রিম ঘোষণা দিয়ে রাখে। তালিকার তিনজনসহ মোট ৮ ব্লগারকে ইতিমধ্যে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে । আসিফ মহিউদ্দিন, রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, আশিকুর রহমান সর্বশেষ অনন্ত বিজয় দাশ-এর উপর একই কায়দায় হামলা হয়েছে। আসিফ মহিউদ্দিন সৌভাগ্যবশত বেঁচে আছে ।

এইভাবে একেরপর এক ব্লগার হত্যা কেন ?
ব্লগার ও অনলাইন লেখক ওয়াশিকুর রহমানকে (২৭) হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়া মাদ্রাসাছাত্র জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম-এর স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় 'ওয়াশিকুর' কোথায় কি লিখেছেন, তা-ওরা জানে না । তাঁদের শুধু বলা হয়েছে, ধর্মের অবমাননা হয়েছে । এরপর ছবি দেখানো হয়েছে, বাসা চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাতে দেওয়া হয়েছে চাপাতি। আর তা দিয়ে কুপিয়ে খুন করতে বলা হয়েছে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে । এই হচ্ছে অবস্থা ।

জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম কাদের নির্দেশনায় এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় ?
ঘটনাস্থল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ধরে ফেলেও নির্দেশদাতাদের সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ । আদতে পারবেও না । আকণ্ঠ দুর্নীতি ও নির্লজ্জ দলবাজী পুলিশকে নপুংশকে পরিনত করেছে । ব্লগার হত্যা বা বর্ষবরণে নারী নিপীড়ন মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা নয় । তাই ব্লগার হত্যার তদন্তে আগ্রগতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই ।

যারা আগামী দিনে নির্বিচারে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করবে বলে নিজেদের প্রস্তুত করছে; তারা অনন্তের মতো মুক্তমনা ব্লগারদের প্রাথমিক টার্গেট নির্ধারণ করেছে । 'ব্লগার' নামের মুক্তচিন্তা প্রকাশ করা মানুষগুলোকে হত্যা করা আপাতত সবচেয়ে সহজ। এরা নিরীহ । এদেরকে নির্দ্বিধায় হামলা করা সম্ভব । এরা পথ চলতে ডানে-বামে-সামনে-পিছনে কিছুই দেখে না । সব সময় হাতে থাকা মোবাইলের দিকে দৃষ্টি, নোটিফিকেশন নিয়েই ব্যাস্ত । এদের লেখায় 'বিশ্বাসের পান থেকে অবিশ্বাসের চুন খসার' প্রচুর আলামত আছে ।

২০১৩ সাল থেকে এই আলামতকে পুঁজি করে সারা দেশে ব্লগার বিরোধী ব্যাপক প্রচার-প্রচারনা শুরু হয় । সামগ্রিক ভাবে ব্লগারদেরকে চিহ্নিত করা হয় ধর্ম অবমাননাকারী নাস্তিক হিসাবে । এখন নাস্তিকতার অভিযোগে শতাধিক ব্লগারকে হত্যার টার্গেট করা হয়েছে । এই টার্গেট অবধি পৌঁছানো এবং হত্যার মিশন সম্পন্ন করার পদ্ধতি প্রায় এক । ব্লগারদের ক্রমাগত হুমকি প্রদান, আকস্মিকভাবে একাধিক ব্যাক্তির হামলা, চাপাতি দিয়ে মাথায় আঘাত, মৃত্যু নিশ্চিত করে নির্বিগ্নে পালানো এবং সবশেষে হত্যার দায় স্বীকার ।

শুধু মাত্র ব্লগার হত্যার জন্য কী এই ঘাতকদের প্রস্তুত করা হচ্ছে ? না,সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনা আছে? দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্লগারদের ব্লগও ০০.০১% মানুষ পড়ে না । সুতরাং ব্লগের লেখালেখিতে সাধারন মানুষের কোন প্রতিক্রিয়া থাকার কথা নয় । কিন্তু পাহাড়ে পাহাড়ে গোপনে যারা 'জঙ্গি ট্রেনিং' দিয়ে যাচ্ছে, যারা বাংলাদেশকে ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর খেলাফতে নিয়ে যেতে চায় তারা এই ব্লগারদের হত্যা সেই ট্রেনিং-এর অংশে পরিনত করেছে । তাই নাস্তিকতার অভিযোগে ব্লগার হত্যা ট্রেনিংপ্রাপ্তদের প্রাথমিক মিশন । ব্লগার হত্যা সবচেয়ে সহজ। 'ব্লগার' পরিচয়ে মুক্তমনা লেখকদের হত্যা করলে সরকারও তেমন প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করে না, দায়সারা একটা তদন্ত চলতে থাকে । আর ব্লগারদের লেখালেখি ঘাঁটতে গিয়ে সরকারেরও আগ্রহ কমে যায় । কারন এরা ব্লগে নিজস্ব চিন্তাভাবনা প্রকাশের পাশাপাশি সমসাময়িক বিষয় নিয়েও নিজের বক্তব্য প্রকাশ করে । যাতে কেবল ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধ্য বক্তব্য থাকে না, সরকার ও সরকার দলীয়দের বিভিন্ন অপকর্মের তীব্র প্রতিক্রিয়া থাকে । আনন্ত বিজয় দাশ-এর ক্ষেত্রেও তাই । মৃত্যুরপূর্বে অনন্তের ফেইসবুকে দেয়া সর্বশেষ পোস্টে সরকার দলীয় সাংসদ মাহমুদ-উস সামাদ কয়েস বিষয়ে তীব্র সমালচনা ছিল ।

অনন্ত বিজয় দাশের হত্যা নিয়ে সিলেটসহ দেশের সর্বত্র প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করলেও, সরকারী দল স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে নিরব । এই নিরবতায় সরকারী দল আওয়ামীলীগ-এর সাথে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয়পার্টি, রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এককাতারে সামিল । তাই ব্লগার বা মুক্তমনা লেখকরা গুপ্তঘাতকদের জন্য নির্ঝঞ্জাট শিকার ।

নাস্তিকতার অভিযোগে ব্লগার শিকার করেই এ মিশন শেষ হবে না । এটা মাত্র শুরু । আলকায়দা বা আইএস-এর অনুসারীরা সংগঠিত হচ্ছে । ছোট ছোট এইসব মিশনের মাধ্যমে এরা নিজেদের প্রস্তুত করছে । ধিরে ধিরে মাঝারি মিশন শুরু হবে । এরপর শুরু হবে বড় মিশন । মিশরের মত, ইরাকের মত, সিরিয়ার মত তখন ভিন্ন ধর্মের আস্তিক হত্যা হবে । হিন্দু আস্তিক, বৌদ্ধ আস্তিক, খ্রিস্টান আস্তিক, আদিবাসী আস্তিককে হত্যা করা হবে । তাতেও শেষ হবে না এই হত্যার মিশন । তখন মুসলিম আস্তিকরা হত্যার শিকার হবে । আলকায়েদা বা আইএস-এর সঙ্গে যুক্ত থাকলে রক্ষা পাওয়া যাবে । অন্যথায় নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হতে হবে । বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় ধারাবাহিক ব্লগার হত্যা সেই আশংকাই তৈরি করছে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.