Sylhet Today 24 PRINT

ক্যাডারে আত্তীকরণ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

দিলীপ রায় |  ৩০ জুলাই, ২০১৭

প্রথমেই একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে চাই। ২০১৭ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় গড় ফেল প্রায় ২৮%। প্রাক-নির্বাচনী বা নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি বলে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি এমন শিক্ষার্থীও নেহাত কম নয়। এখন যদি কর্তৃপক্ষ এক ঘোষণায় উক্ত ফেল করা কিংবা পরীক্ষায় অংশ নিতে ব্যর্থ হওয়া শিক্ষার্থীদের পাসের সনদ দিয়ে বুয়েট, মেডিকেল কিংবা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দেয় তবে জাতি বিষয়টিকে কীভাবে নেবে? মেনে নেবে না তো!

এখন আসি মূল প্রসঙ্গে। বিসিএস পরীক্ষায় একেকটা ধাপে অবতীর্ণ হওয়া মানে একেকটা দুর্যোগময় ঝড়ের ইতিহাস অতিক্রম করা। যার উপর দিয়ে এই ঝড় একবার বয়ে গেছে সেই ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ তা অনুমানও করতে পারবে না। এবার পরীক্ষার সিস্টেমের বিষয়ে আসি।

১। বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করে প্রায় ৩ লাখ প্রতিযোগী।
২। প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় অংশ নেয় প্রায় আড়াই লাখ এবং পাস করে প্রায় ১৫ হাজার।
৩। এই ১৫ হাজার লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করে প্রায় ৯ হাজার।
৪। এই ৯ হাজার ভাইভা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করে প্রায় ৫ হাজার।
৫। এই ৫ হাজারের মধ্যে মেডিকেল টেস্টে অংশ নিয়ে পাস করে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার।
৬। এই সাড়ে ৪ হাজারের মধ্য হতে পুলিশ ভেরিফিকেশনে বাদ পড়ে আরও প্রায় ৫০০ জন।

এই ৬ টি ধাপ অতিক্রম করে যে পরীক্ষার্থীটি শেষ পর্যন্ত বিসিএস ক্যাডার নামক সোনার হরিণের দেখা পায়, সে কীভাবে মেনে নেবে বিসিএস পাস ছাড়া গণহারে বিসিএস ক্যাডারের সনদ। এই বিসিএস পাস করা পরীক্ষার্থীদের মধ্য থেকে আবার নন-ক্যাডার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে পদায়নের জন্যও সুপারিশ করা হয়। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে উক্ত দ্বিতীয় শ্রেণির পদটিও হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। (দ্রষ্টব্য : ২৮/০৭/১৭ তারিখের দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদকীয় )

হাউ সেলুকাস! কেউ বিসিএস পাস করেও দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার আর যে কোনো দিন বিসিএস দেওয়ার চিন্তাও করেনি, সে সিস্টেমের দুূর্বল ফাঁকে বিসিএস ক্যাডার!

আমি কলেজ জাতীয়করণের বিপক্ষে নই। এটা বর্তমান সরকারের অতি অবশ্যই একটি মহতী উদ্যোগ। এতে দেশের প্রতিটি উপজেলার সর্বস্তরের জনসাধারণের সন্তানরা স্বল্প খরচে পড়ালেখার সুযোগ পাবে। সম্ভাব্য ২৮৫ টি জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তিতেই আমাদের আপত্তি। কারণ -

১। এতে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় ১৩ হাজার ক্যাডার কর্মকর্তার স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হবে।
২। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি জট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন জুনিয়র কর্মকর্তাগণ।
৩। কর্মস্থলে চেইন অব কমান্ড বিঘ্নিত হবে।
৪। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিবর্গের মামলা, পাল্টা মামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা।
৫। প্রশিক্ষণ নিয়ে গুরুতর সংকট সৃষ্টি হবে।
৬। অদূর ভবিষ্যতে দেশের মেধাবীরা শিক্ষা ক্যাডারে যোগদানের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
৭। বাড়বে আন্ত:ক্যাডার দ্বন্দ্ব ও বৈষম্য।
৮। এমন আশংকাও অনেকের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছে, ভবিষ্যতে এমন প্রশ্ন আসতে পারে যে, এমন জনবহুল ক্যাডারকে আর ক্যাডার সার্ভিসে রাখা সমীচীন নয়।
৯। সবচে বড় যে ক্ষতিটি হবে, সেটি হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে অস্হিতিশীল পরিস্থিতির তৈরি হবে এবং শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মানের মারাত্মক অবনমন হবে। তখন দু'টি পক্ষ মুখোমুখী দাঁড়িয়ে যাবে।

উল্লেখ্য, ১। ১৯৯৮ সালে ১৮টি মহিলা কলেজের শিক্ষকগণ যখন ক্যাডারে আত্তীকৃত হন, তাদের অনেকেই তখন ক্যাডার কর্মকর্তাদের জুনিয়র ছিলেন। পরবর্তীতে তারা কোনো এক যাদুর ছোঁয়ায় দ্রুত প্রমোশন নিয়ে বর্তমানে প্রায় ২৫০ টি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। আর ক্যাডারের অনেকেই যারা তাদের (আত্তীকৃত) সিনিয়র ছিলেন, এখনও তারা সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

২। সরকারি জগন্নাথ কলেজ যখন বিশ্ববিদ্যালয় হয়, তখন কলেজটিতে কর্মরত বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাগণ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আত্তীকৃত হতে পারেন নি।

৩। সম্প্রতি পুলিশ বিভাগে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কিছু সংখ্যক এএসপি কর্মকর্তা ক্যাডারে আত্তীকৃত হবার জন্য মহামান্য আদালতে রীট করেছিলেন। আদালত তা খারিজ করে দেয়।

তাই, বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের অধিকার সুরক্ষাকল্পে নিম্নোক্ত দাবীনামা -

১। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে ক্যাডার কর্মকর্তাদের অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে।

২। নব্য জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তকরণ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সকল ধরণের পার্শ্ব প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

৩। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী নব্য জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকদের বদলী ও পদোন্নতি কেবল উক্ত কলেজগুলোতেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

৪। নব্য জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকদের জন্য অবিলম্বে স্বতন্ত্র চাকুরী বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে। পরবর্তীতে সকল জাতীয়করণের ক্ষেত্রে এ বিধিমালা প্রযোজ্য হবে।

৫। নতুন স্বতন্ত্র বিধিমালা মহান জাতীয় সংসদ কর্তৃক আইনে পরিনত করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমরা অস্বীকার করছি না যে, বেসরকারি কলেজে যোগ্য শিক্ষকের সংকট রয়েছে বরং তারা, তাদের অবস্থান থেকে যোগ্যতা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাক এবং যাবতীয় সুবিধাদি ক্যাডার কর্মকর্তাদের থেকে বেশি করে নিক। কারণ, তারাতো এদেশেরই সন্তান। আমাদের কারো না কারো আপনজন এবং বিপরীতক্রমে আমরাও।

অতএব, সকলের বৃহত্তর স্বার্থে -
"NO BCS NO CADRE. "

লেখক : এমসি কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষক

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.