Sylhet Today 24 PRINT

জাতীয়তাবাদী আহমদ ছফা, স্ববিরোধি আহমদ ছফা!

সুষুপ্ত পাঠক |  ০২ আগস্ট, ২০১৭

আহমদ ছফা আর চাষী নজরুল ইসলাম, এই দুইজন গুনি মানুষ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পুস্তক ব্যবসা এবং সিনেমা ব্যবসার আজকের মৃতপ্রায় অবস্থার জন্য দায়ী বললে ভুল হবে না মনে হয়। আহমদ ছফা একুশে বইমেলায় বিদেশী (কোলকাতার) বই নিষিদ্ধের আন্দোলন করে সফল হয়েছিলেন। এতে করে বাংলাদেশ পেয়েছে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনের মত বেস্টসেলার লেখক। কিন্তু কোলকাতার সঙ্গে প্রবল প্রতিযোগিতা থাকলে আরও ডজনখানের বেস্টসেলার লেখক বাংলাদেশ পেতো।

ছফা যেহেতু বই ব্যবসার স্বার্থেই পশ্চিমবঙ্গে বই নিষিদ্ধের জন্য আন্দোলন করেছিলেন, সেখানে সিরিয়াস সাহিত্য বা মানসম্পন্ন সাহিত্যের ব্যাপার নেই। বই ব্যবসার জন্য প্রয়োজন বেস্টসেলার লেখক। কোলকাতার বই নিষিদ্ধ করে একুশে বইমেলা পেয়েছে মাত্র একজন বেস্টসেলার লেখক। তেমনিভাবে চাষী নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার পর ভারতীয় সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না গিয়ে নিষিদ্ধ করেছিলেন সরকারকে দিয়ে। সিনেমা শিল্প বিকশিত হবে না ভারতীয় সিনেমার আগ্রাসনে- এটাই ছিল চাষীর যুক্তি।
ফলাফল, আজকে শিল্পী সংকটে ভুগছে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প। যে রাজ্জাক উর্দু সিনেমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ‘নায়ক রাজ’ হতে পেরেছিলেন, তার উত্তরসূরিরা আজ এফডিসিই বন্ধ করে দিয়েছে। সিনেমা হল বন্ধ হতে হতে এক সময় আর থাকবে কিনা সন্দেহ। একই কথা পুস্তক ব্যবসার ক্ষেত্রে। ভাল একটা বইয়ের দোকান বাংলাদেশে পাওয়া খুবই দুর্লভ। সৃজনশীল প্রকাশনা চলছে ফেব্রুয়ারি মৌসুমকে কেন্দ্র করে। নতুন লেখকদের পকেটের পয়সায় হাতিয়ে এই সময়টা প্রকাশকরা নিজেদের মৌসুমি ব্যবসাটা করেন। দ্বিতীয়ত সরকারের কোন সচিব, নেতা, শিল্পপতির বই ছেপে সেটা সরকারের কাছে বেচার মাধ্যমে প্রকাশক মুনাফা তুলে নেন। গুচ্ছের সেই বই সরকারী কোন গুদামে বসে বসে উইয়ের খাদ্যে পরিণত হয়। এই হচ্ছে আমাদের পুস্তক ব্যবসা।

হুমায়ূন আহমদে যখন সিনেমা বানানো শুরু করলেন, তখন একবার বলেছিলেন, এদেশে সিনেমার মান নেই। ব্যবসা নেই কারণ কোন প্রতিযোগিতা নেই। ভারতীয় সিনেমা এখানে আমদানি হলে এদেশের পরিচালক কলাকুশলিরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই নিজেদের পরিবর্তন করতে চেষ্টা করবে। হুমায়ূন মিথ্যে বলেননি। তার প্রমাণ কোলকাতার সিনেমা। হিন্দি সিনেমার সঙ্গে টিকে থাকতে তাকে লড়তে হয়। এই লড়াই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। তাতে কোলকাতার সিনেমা মাঝখানে যে পথ হারিয়েছিল সেখান থেকে ফিরে এখন একটা বলিষ্ঠ জায়গায় আসতে পেরেছে। এমন সব পরিচালক কোলকাতায় আসছেন যাদের সিনেমা আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখে বিস্মিত মুগ্ধ হই।

অপরদিকে বাংলাদেশে রোজই কোন না কোন ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল বন্ধের খবর পেতে হয় আমাদের। চাষী নজরুল ইসলাম এদেশের সিনেমাকে বাঁচাতে সৎ উদ্দেশ্য থেকেই ভেবেছিলেন, ভারতীয় উত্তম-সৌমিত্রে সিনেমা এখানে মুক্তি পেলে রাজ্জাক-আলমগীরদের সিনেমা কেউ দেখতে চাইবে না। চিন্তাটা ভুল ছিল। চাষী নজরুলের রাজনৈতিক বিশ্বাস সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। তাই বলতে পারছি না তিনি সিনেমা শিল্পের মঙ্গল চিন্তার সঙ্গে কতখানি ভারত বিদ্বেষী যুক্ত করেছিলেন। এক্ষেত্রে অবশ্য আহমদ ছফা সম্পর্কে একটু আলাপ করার সুযোগ আছে। আলাপটা করতে ভয় পাচ্ছি কারণ ছফা সম্পর্কে প্রগতিশীল বন্ধুদের স্পর্শকাতরতা ব্যাপক। শুরুতেই তাই বলে রাখি, আহমদ ছফার সামগ্রিক সাহিত্য, মননশীলতা, তার চিন্তার জগত নিয়ে আমি আলোচনা করছি না। ছফার একটি সাক্ষাৎকার, তার জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে আলাপ, বাংলাদেশের মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমার আলোচনায় সীমিত রাখব।

ছফা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের পরাধীন মনে করতেন। তিনি কোলকাতার এক পত্রিকাকে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, ‘আপনারা (পশ্চিম বাংলা ও ভারতের বাঙালিরা) জাতি হিশেবে স্বাধীন নন। আপনাদের ভাষাও সেখানে স্বাধীন নয়, আপনারা দিল্লি এবং হিন্দি সমান। সবক্ষেত্রে দিল্লি এবং হিন্দির নির্দেশ মেনেই আপনাদের চলতে হয়। পরাধীন জাতি হিশেবে স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা আপনাদের নেই। মানসিকভাবেও এই দাসত্বকে আপনারা (ভারতের বাঙালিরা) মেনে নিচ্ছেন। কারণ ‘ভারতের ঐক্য সংহতি রক্ষা’র দায় এখন আপনাদের কাঁধে। তাই স্বাধীন হবার ইচ্ছেও আর থাকছে না’।

মজা হচ্ছে, ছফা স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ নিয়ে ছিলেন গর্বিত। জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশের অখণ্ডতা, তার মেরুদণ্ড সোজা করে চলার জন্য ভারতকে প্রতিবন্ধক বলে মনে করতেন। কিন্তু ছফা পশ্চিমবঙ্গকে যে প্রেসক্রিপশন দিলেন সেটা যদি তার নিজের দেশের ক্ষুদ্র ভাষা ও জাতিসত্তার মানুষরা নিজেদের ভাষা ও জাতিসত্তার সুষম বিকাশের জন্য স্বাধীনতা চেয়ে বসে তাহলে কি ছফা তার জাতীয়তাবাদী ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের কোন অংশ কর্তন করতে চাইবেন? এই পৃথিবী কয়েক হাজার ভাষা ও জাতি পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাক সেটাই কি মানব সভ্যতার সমাধান? নাকি একটি মাল্টি কালচারাল সোসাইটি, কসমোপলিট্রন সমাজই মানব সভ্যতার মুক্তি? ছফা এইখানে দারুণভাবে পিছিয়ে।

আহমদ ছফা বই ব্যবসার কথা বলেছেন। এদেশে পশ্চিমবঙ্গের কারণে বই ব্যবসা কোনদিন বাজার করতে পারেনি ইত্যাদি। কিন্তু তিনি যখন বিপুল বিক্রিত হুমায়ূন আহমেদকে আক্রমণ করেন বাজারি লেখক হিসেবে, হুমায়ূনের ‘শ্যামল ছায়া’ পড়ার পর ছফা বলেছিলেন, ‘নন্দিত নরকে’ লেখার পর হুমায়ূনের আর কিছু লেখার দরকার ছিল না। এখানেও দেখা যাচ্ছে জনপ্রিয় সাহিত্যের বেচাবিক্রির মধ্যেও ছফা নিজেকে টেনে এনেছেন। কোলকাতার জনপ্রিয় লেখকদের বাজার ধরেছিলেন হুমায়ূন, মিলন। ছফার তো তাতে খুশি হবারাই কথা। কিন্তু এখানেও দেখা যাচ্ছে তার রাগ গোস্বা।

প্রশ্নটা তাই আসেই- ছফার এই ভারত বিরোধী অবস্থা কি যুক্তিবাদী মননশীল জায়গা থেকে না কোনও ধর্মীয় অনুভূতি থেকে? এই প্রশ্নের উত্তরে ছফা যা বলেছিলেন তা আমার কাছে ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। তিনি বলেছিলেন, ‘কিন্তু আমার মনে হয় না পশ্চিম বাংলার মানুষ আমাকে ভুল বুঝবেন। আমি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং যুক্তিসঙ্গত একটা জিনিসকে তুলে ধরছি। আপনি যদি এখানকার (বাংলাদেশের) হিন্দুদের সাথে কথা বলেন, দেখবেন তারা শামসুর রাহমান বা অন্যান্যদের থেকে আমাকে বন্ধু হিশেবে বেশি পছন্দ করবেন, যদি মাঝখানে ভারতের প্রসঙ্গটা না আসে। আমাদের দেশে যদি একজনও হিন্দু না থাকে তবে সাম্প্রদায়িক মোল্লাদের নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না।

শেষ লাইনটাতে ছফার স্ববিরোধিতা উপস্থিত। কেন তিনি তার ভাষাতে ‘সাম্প্রদায়িক মোল্লাদের’ নিয়ে বাঁচতে পারবেন না? একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোন মৌলবাদী সমস্যা নেই। তসলিমা নাসরিনই নাকি ‘লজ্জা’ উপন্যাস লিখে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রমাণিত করতে চেয়েছে। ছফাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বা মৌলবাদী বাধা কি এখানে আছে? ছফার উত্তর ছিল, না, সেরকম আমি কিছু মনে করি না। ছফার এই উপলব্ধি কি অজ্ঞতা নাকি আনন্দ পুরস্কার পেতে তসলিমা যথেষ্ট যোগ্য নন- এই ছিল তার ক্ষোভ?

বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতনকে এই সাক্ষাৎকারে ছফা লঘু করে তুলেছেন ‘মাত্র তিন জন মারা গিয়েছে’ বলে। শত শত হিন্দু পরিবারের ভয়ে দেশত্যাগের বিষয়টি ছফা জানতেন না তা তো নয়। তিনি বলছেন মৌলবাদী কোন সমস্যা এদেশে নেই। একই জায়গায় নিজের সম্পর্কে তিনি বলছেন গ্রামের বাড়িতে তিনি থাকতে পারছেন না কারণ তিনি ইসলাম পালন করেন না, মানেনও না। ভারতের মানুষ অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক এটাই ছিল ছফার বক্তব্য। দেশভাগের জন্য হিন্দুরাই দায়ী কিংবা বাংলাদেশের শিক্ষা অঙ্গনে অশান্তির জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী র’ দায়ী- এরকম অভিযোগ ছফাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, কারণ ১৯৯১ সালের বিএনপি জামায়াত সমর্থনে সরকার গঠন করার পর পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার শক্তিশালী অবস্থানের কথা তখনকার সংবাদপত্রেই ছাপা হতো। কিন্তু ছফা র’ ফোবিয়া থেকে বেরই হতে পারলেন না কেন?

ছফা দাবী করলেন তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয়কালে ভারতের নাগরিকত্ব নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যে ভারত দিল্লির শাসনে নিপীড়িত, যে ছফা ভারতের তেলেগু, আসাম, পাঞ্জাবি, কাশ্মির, বাংলাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হতে পরামর্শ দেন- তিনিই ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে চাওয়াটা কি বিরাট স্ববিরোধিতা নয়? বাংলাদেশের পাহাড়ে শান্তিবাহিনী সম্পর্কে ছফার কি অবস্থান ছিলো জানা নেই। আজকের পাহাড়ে সেটেলার বাঙালিদের হাতে পাহাড়িদের দমন পীড়ন নিয়ে ছফা কি উল্টো গান গাইতেন? অহমিয়া, উড়িয়া, পাঞ্জাবি, কাশ্মিরি মুসলমানদের স্বাধীন হতে বলা ছফা কি চাকমা মারমাদের স্বাধীন হতে পরামর্শ দিতেন? বাবরি মসজিদের ঘটনায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনকে কার্যত তিনি অস্বীকার করে ফেলাটা এক্ষেত্রে আমাদের দ্বিধাতেই রাখছে।

আহমদ ছফা একটা প্রতিভার নাম। সত্যিকারের পণ্ডিত বুদ্ধিজীবী। আদর্শবান নির্লোভী। অকপটে সত্য বলাটাকে তিনি ট্রেডমার্কে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ছফা, আমার কাছে মনে হয়েছে, উপমহাদেশের দেশভাগজনিত রাজনীতি, ধর্মীয় পরিচয়ে কোথাও তার মনোজগতে স্ববিরোধিতা খেলা করত। এই খেলা তার প্রতিভাকে অপচয় করিয়েছে। তাকে কখনো কখনো অন্ধ জাতীয়তাবাদী করে তুলেছিল।

  • সুষুপ্ত পাঠক: ব্লগার।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.