Sylhet Today 24 PRINT

‘উদ্ভট উটের পিছে চলেছে স্বদেশ’

ইন্দ্রজিৎ ঘোষ |  ১৯ আগস্ট, ২০১৭

‘উদ্ভট উটের পিছে চলেছে স্বদেশ’ শামসুর রাহমান যখন এই শিরোনামে কবিতাটি লিখেছিলেন তখন আমাদের দেশের অবস্থা কেমন ছিল তা আমার জানা নেই। তবে তিনি বোধহয় অনুমান করেছিলেন একসময় আমাদের দেশটা সত্যি সত্যি কোনও উদ্ভট উটের উপরেই চলবে।

এদেশের কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। যে ঘটনাগুলো সারা দেশব্যাপী আলোড়িত হলেও এর বিচার হয়নি। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে ব্যর্থ। শুধু কি সরকারকে দোষ দিলেই হবে। জনগণ কোন দিকে যাচ্ছে? জনগণ শিক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু মানবিকতা মানসিকতার কি কোন পরিবর্তন হয়েছে?

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলে ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার হয় কিন্তু এসব ঘটনাগুলোতে সরকারের কোন উদ্যোগ নেই। আন্তরিকতার অভাব রয়েছে সরকারের এসব ঘটনায়। তবে দুএকটি ঘটনা যেগুলোতে সরকারের লোকজন সরাসরি জড়িত নয় কিংবা তাদের ভোট বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে সেক্ষেত্রে কয়েকটি ঘটনার বিচার হয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন এসব ঘটনা টেনে কি লাভ? সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সরকার ইচ্ছে করেই এসব ঘটায় না। ঠিকই আছে আমিও বলি সরকার এসব ঘটনা ইচ্ছা করে ঘটায় না। ঘটে যাওয়ার পর এগুলোর বিচার করার দায়িত্ব সরকারের। অনেকেই ইউরোপিয়ান দেশগুলোর উদাহরণ টেনে বলেন- ‘ওখানেও তো হত্যাকাণ্ড, বর্ণবাদী হামলা, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হয়, হয় ধর্ষণ; কিন্তু এসব ঘটনা যেভাবে ত্বরিতগতিতে বিচার হয় এই কথাগুলো আর তারা বলেন না। ইচ্ছা করেও এগুলো এড়িয়ে যান। এবার যে ঘটনাগুলোতে সারাদেশ আন্দোলিত হয়েছিল সেগুলো একটু উল্লেখ করে নিই।

পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের কথা। ঘাতকরা আজও শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তার হয়নি। কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরের একটি জঙ্গল থেকে কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আব্দুল কাদেরের কথা মনে আছে? তাকে ছিনতাইকারী বানিয়ে পিটিয়ে ক্রাচে হাঁটতে বাধ্য করেছিল পুলিশ। যদিও এই ঘটনাতে বিচার হয়েছে। এক পুলিশ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সে হাজতেও আছে।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব এলাকার রহিমা বেগমকে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যা করেছিল র‌্যাব। মনে আছে এই মহিলাকে বানানো হয়েছিল মাদক সম্রাজ্ঞী।

হাইকোর্ট থেকে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় জামিন পাওয়ার পরেও ষ্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র তৌফিক আহমেদ হাসানকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হয়ে আসার সময় আত্মীয় স্বজনের সামনে কারা ফটক থেকে সাদা পোষাকে র‌্যাব ধরে নিয়ে গুম করে দেয়ার অভিযোগ ওঠেছিল। কিন্তু এরও বিচার পায়নি তার পরিবার। তার কোন সন্ধানও পায়নি পরিবার।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলীর গুম নিয়ে কম আন্দোলন হয়নি। মানুষও মারা গেছে আন্দোলনে। সরকারি স্থাপনায় আগুনও দিয়েছিল উত্তেজিত জনতা। ইলিয়াস আলীকে নিয়ে দেশে রাজনীতি করতেই ব্যস্ত ছিল তার দল। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে সরকারও নীরব থেকে গেছে।

র‌্যাবের গুলিতে পঙ্গু হয়ে যাওয়া ঝালকাঠির কলেজ ছাত্র লিমনের কোন বিচার কি করতে পেরেছে রাষ্ট্র? র‌্যাবের গুলিতে আহত লিমনের ঘটনার মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে ছিনতাইকারী বানিয়ে প্রহারের ঘটনা আমাদের অনুভূতিকে তীব্র মাত্রায় স্পর্শ করে। যেকোনো সংবেদনশীল মানুষ এ ঘটনাগুলোতে কথিত আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক নির্যাতনের ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন। এভাবে অতি সম্প্রতি পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনে পুলিশের ছোঁড়া টিয়ারশেলে সিদ্দিকুর নামে এক ছাত্রের চোখ অন্ধ হওয়ার পথে। আহা পুলিশী রাষ্ট্রে সরকারের পুলিশের বিরুদ্ধে সিদ্দিকুর কি কোন বিচার পাওয়ার আশা করতে পারবে?

পাঠকের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কথা। নিজ বাসায় নৃশংসভাবে নিহত হন। দুজন কত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলেন। কত হম্বিতম্বি করলেন। কিন্তু কিছুই হলনা। অভিযোগ ওঠেছিল সরকার সমর্থক একটি টিভি চ্যানেলের মালিক এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত নয়। বরং দীর্ঘ তালিকায় তা সমৃদ্ধ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মনস্তত্ব নিয়েও আলোচনা সমালোচনা কম হয়নি।

কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কুরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ এনে বৌদ্ধ বসতিতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনার বিচার না হওয়ায় একই রকম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ভুয়া অভিযোগ এনে সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর উপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। ভেঙে ফেলা হয় তাদের বাড়িঘর, মন্দির। আগুনে ধ্বংস হয়ে যায় মুহূর্তেই। সংখ্যাগুরুর সকলেই চেয়ে চেয়ে দেখলেন। কেউ ফেরাতেও আসলেন না। একটা সময় প্রতিবেশিরা প্রতিবেশিদের দুঃসময়ে এগিয়ে আসতেন।

ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ১৫ টি মন্দিরে ভাঙচুর এবং অন্তত দেড়শ বাড়িঘরে হামলা লুটপাট চালানো হয়। কিন্তু কই প্রতিবেশীরাও এক্ষেত্রে নীরব ভূমিকাই পালন করলেন। ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার ভুয়া অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের সাংসদ সেলিম ওসমান স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ভক্তকে নির্যাতন করেন। শুধু তাই নয় ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে এই শিক্ষককে পরবর্তীতে হাতকড়া পড়িয়ে টেনে হিঁচড়ে জেল হাজতে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়। প্রভাবশালী নেতা ওসমান পরিবারের কারণে শ্যামল কান্তি ভক্তরা বারবার নির্যাতিত হলেও এসবের বিচার হয়না। নারায়ণগঞ্জে পুত্র ত্বকী হত্যাকাণ্ডেরও বিচার পায়নি তার পরিবার।

রাঙামাটির লংগদুতে নৃ-গোষ্ঠীদের বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশন। রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করে সংগঠন দুটি।

সিলেট এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের মেধাবী ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসের উপর ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী বদরুল বর্বর হামলা চালায়। কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না।

সামান্য চুরির অভিযোগে আমরা শিশু রাজনকে পিটিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে উল্লাস করি তার ভিডিওচিত্র ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা তা প্রচার করে বিমলানন্দ উপভোগ করি।

বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও চিত্র আমরা সরাসরি দেখেছিলাম টিভিতে। কিন্তু সরকারের চিকিৎসক-পুলিশরা বিশ্বজিতের মৃতদেহে কোন আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পান না। সরাসরি ৬ জনকে আঘাত করতে দেখলেও ২ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তারা আবার পলাতক। ফেসবুকে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে অনবরত ছবি আপলোড করলেও সরকারের পুলিশবাহিনী তাদের খুঁজে পায়না। বগুড়ার যুবলীগ নেতা তুফান সরকারের বড় ভাই ২২ মামলার আসামী পুলিশের বড়কর্তা-মন্ত্রীদের সাথে প্রতিনিয়ত ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানিয়ে ছবি তুললেও বিগত ৮ বছর ধরে পুলিশের খাতায় সে পলাতক।

শুধু কি তাই? সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের কোন সংশোধনীকে বাতিল করলে সরকারের বয়োবৃদ্ধ মন্ত্রী বলেন- ‘ওদেরকে আমরা চাকরি দেই। ওরা জনগণের প্রতিনিধিদের উপর খোদাগিরি করে। আমরা আবার তা পাশ করে নেব। অনবরত করতেই থাকবো।’ কি উদ্ধত কথাবার্তা!

এবার শুরু হয়েছে ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে রাজনীতি। এসব ঘটনাদৃষ্টে উপলব্ধি একটাই এদেশে বড় বড় পেশাজীবী মানুষের অভাব নেই, অভাব নেই রাজনীতিবিদদের। এমনকি বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু তাদের মধ্যে সবকিছু থাকলেও তাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলীর খুবই অভাব। এই অভাবটুকু কিভাবে পূরণ হতে পারে এ নিয়েই সকলকে ভাবতে হবে। বিশেষ করে নূতন প্রজন্মকে গড়ে তোলার আগে তাদেরকে এই গুণাবলীর অধিকারী যেন হয় সে বিষয়েই অভিভাবককে মনোযোগি হতে হবে। না হলে তারাও বর্তমানের দায়িত্বশীলদের মতো তারাও মানবিকগুণ ছাড়াই বড় হবে।

সন্তানদেরকে ‘পড়াশুনা করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’ এভাবে অর্থের মোহে লেলিয়ে না দিয়ে তাকে প্রকৃত মানুষ করার দায়িত্বটুকু পালন করতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে সে চিকিৎসক, স্থপতি, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা ঠিকই হবে। কিন্তু মানুষ হবেনা। তাই আগে সবাইকে মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ হওয়ার দিকে সবাইকে মনোযোগি হতে হবে। না হলে কেবল আপসোসই করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকেও।

  • ইন্দ্রজিৎ ঘোষ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় গ্রহণ করে না।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.