Sylhet Today 24 PRINT

টিপু মজুমদার : কিছু স্মৃতি কিছু কথা

অপূর্ব শর্মা |  ২৯ আগস্ট, ২০১৭

যেদিন তুমি এসছিলে ভবে/কেঁদেছিলে তুমি একা-হেসেছিলো সবে/এমন জীবন তুমি করিবে গঠন/মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন। এই কবিতার লাইনগুলো সব মানুষের জীবনে সামগ্রিক ভাবে বাস্তবতা পায় না। প্রথম দুটি লাইনের যথার্থতা বহুলাংশে প্রযোজ্য হলেও শেষের তিনটি লাইন অগণিত মানুষের জীবনে থেকে যায় অধরা।

গুটিকয়েক মানুষই আপন কর্মগুণে হাসিমুখে বিদায় নেয়। আর তাদেরই একজন হচ্ছেন আমাদের ‘টিপুদা’ অর্থাৎ ক্রীড়া সাংবাদিক টিপু মজুমদার। তিনি ছিলেন সিলেটের ক্রীড়া সাংবাদিকতার এক উজ্জল নক্ষত্র, পথিকৃৎ। তাঁর মৃত্যু আমাদেরকে কাঁদিয়েছে। কিন্তু তিনি বিদায় নিয়েছেন হাসিমুখে, কাউকে কিছু না বলে। আজ টিপুদা’র মৃত্যুর পনেরো বছর পূর্ণ হলো। দেখতে দেখতেই কেমন করে যেন কেটে গেছে সপ্তাহ, মাস এরপর বছর।

সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। অফিসে প্রবেশ করার মূহুর্তে দেখা হয় টিপুদা’ সাথে। কোথায় যাচ্ছেন-জিজ্ঞেস করতেই টিপুদা বললেন, লোহারপাড়া যাচ্ছি। অন্যদিনের মতো এদিন আর কোনো কথাই হয়নি তাঁর সাথে। নিজের টেবিলে বসে দ্রুত হাতের কাজ শেষ করে বাসায় গিয়ে যখনই খাবার হাতে নিয়েছি-ঠিক সেই মুহুর্তে মোবাইলটি বেজে উঠলো। তাপসদা’র (যুগভেরীর তৎকালীন বার্তা সম্পাদক) ইনস্টল করা নাম্বারটি ভেসে উঠতেই চমকে ওঠলাম। নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ। হয়তবা কোথাও কোনো অঘটন ঘটেছে। এই ভাবনা চিন্তার মধ্যেই রিসিভ করলাম ফোনটি। অপর প্রান্ত থেকে কাঁপা কণ্ঠে তাপসদা বললেন, টিপু হার্ট অ্যাটাক করেছে। অবস্থা খুবই খারাপ। হয়তো বেঁচে নেই। তুই এখনই হাসপাতালে যা। সবাইকে খবর দে। ফোনটি রাখতেই সেলিম ভাই (যুগভেরীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) ফোন করলেন। বললেন টিপু নেই। আমরা তার বাসায় যাচ্ছি-তুমি এখানে চলে আসো। মুকিত ভাই ও আমি একই বাসায় ছিলাম। পাশে বসেই ভাত খাচ্ছিলাম। আর মুকিত ভাই খাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি আর একটি গ্রাসও মুখে নিতে পারিনি। হাতের ভাতগুলো ঝড়ে পড়ে প্লেটের মধ্যে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। মুকিত ভাইয়ের ভাত খাওয়া হয়নি। বাসা থেকে বেরিয়ে একটি রিকশা নিয়ে দু’জনে রওয়ানা হলাম টিপুদা’র বাসার উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে মুকিত ভাই ও আমি পরিচিতজনদের কাছে মোবাইল ফোনে মৃত্যু সংবাদ পৌছে দিতে দিতেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম টিপুদা’র বাসার উদ্দেশ্যে। তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না টিপুদা চিরদিনের মতো বিদায় নিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মুকিত ভাই ও আমার চোখে তখন অনর্গল অশ্রু ঝরছে। তাদের কালীঘাটস্থ বাসার সামনে ভীড় দেখে আর বুঝতে বাকি রইলো না টিপুদা নেই। তাদের ড্রয়িংরুমের মেঝেতে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন। আমরা যখন তার ঢেকে রাখা মুখটি দেখছিলাম ঠিক তখন কামরান ভাই সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনিও তার কান্না লুকিয়ে রাখতে পারেননি। সবার চোখেই পানি। পরিবারে বাঁধ ভাঙা কান্নার রোল। হৃদয়টা কেমন যেনো করছিলো। এর আগে এমন কখনো হয়নি। অনেকক্ষণ পর বাসায় ফিলে গেলাম। রাতে দুটি চোখ একবারও মিলিত হয়নি। পরিদিন চিতার আগুনে যখন টিপুদা হারিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বার বার মনে হচ্ছিল অতীতের কথা।

টিপুদা’র সাথে পরিচয়, যখন আমি বার্তাবাহকে কাজ করতাম শ্রীমঙ্গল থেকে-সেই সময় থেকেই। তিনিও বার্তাবাহকে কাজ করতেন। এই পরিচয়, টেলিফোনের তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু সরাসরি পরিচয় হয় ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের কয়েক দিন আগে যুগভেরী অফিসে। আমি তখন যুগভেরীতে নতুন জয়েন্ট করেছি মাত্র। প্রথম দিনেই তিনি আমাকে আপন করে নিলেন। বার্তাবাহক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনিও চলে এলেন যুগভেরীতে। এক সাথেই শুরু হলো পথচলা। সম্পর্কের ঘনিষ্টতায় তিনি আমাকে তুই বলে সম্বোধন করতে শুরু করলেন। সম্পর্ক এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছালো যে তিনি যেনো ভাই বন্ধু সবই হয়ে গেলেন। তবে আমরা যুগভেরীতে কাজ করতাম মোট কথা একটি পরিবারের সদস্যদের মতো ছিল আমাদের পরস্পরের সম্পর্ক। প্রতিদিনই হইহুল্লোড় জম্পেশ আড্ডা, মান অভিমান সবমিলেই প্রাণবন্ত একেকটি দিন আমরা অতিবাহিত করে যাচ্ছিলাম। অফিসে প্রতিদিনই ঝগড়া হতো। কিন্তু তা ছিলো ক্ষণিকের। ইচ্ছে করেই ঝগড়ার সৃষ্টি করা হতো। উদ্দেশ্যে ছিলো সহজ সরল টিপুদাকে রাগানো। আর এই কাজটি একতরফা ভাবে করতেন মুকিত ভাই(বর্তমানে শ্যামল সিলেটের নির্বাহী সম্পাদক) তার সাথে সুর মেলাতেন বাবলু ভাই, ওয়েছ খসরু, মাঝে মধ্যে নিরঞ্জন দা। ঝগড়ার অন্যজন হলাম আমি।

মুকিত ভাই আমাকে জড়িয়ে টিপুদাকে এমন সব কথাবার্তা বলতেন- টিপুদা তা শুনে রেগে আগুন হয়ে যেতেন। বলতেন, ওকে আমি দেখে নেব...আরও কত কি। ঝগড়া শেষে আমি তাকে বুঝাতাম ইচ্ছে করেই মুকিত ভাই এই ঝগড়ার সৃষ্টি করেছেন। তখন তিনি বুঝতে পারতেন। কিন্তু পরদিন আবারও ঝগড়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে কেন যে তিনি রেগে যেতেন তা বুঝতে পারতাম না। তবে কিছুক্ষণ পরই সব ঠিক হয়ে যেত। এই ঝগড়ার নালিশ সেলিম ভাইয়ের কাছেও পৌছেছে। কিন্তু সেলিম ভাই ভাল করেই জানতেন তার খেলার সাথীকে। তারপরও আমার প্রতি তার ভালবাসার এতটুকু কমতি ছিলো না। সময় সুযোগ হলেই আমাকে বাসায় নিয়ে যেতেন। পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের সাথে। কিন্তু অফিসের সবাই ভাবতো আমার সাথে টিপুদা’র সম্পর্ক ভাল নেই। তবে আকস্মিক একটি ঘটনা মৃত্যুর পর টিপুদা’র সাথে আার ভালবাসার বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করেছে। তার মৃত্যুর দু’দিন পর দিনের বেলা আমি যুগভেরী কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। কেন জানি মৃত্যু সংবাদ সম্বলিত একটি যুগভেরীর কপি আমি টিপুদা’র বোন রূপা চক্রবর্তীর ঢাকার ঠিকানায় হাতে লিখে পিয়ন কে দিয়ে পোস্ট করিয়েছিলাম। এর দু’দিন পর ঢাকা থেকে একটি চিঠি আসে। ঐ চিঠিতে রূপাদি(ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আধুনিক বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা ও বিশিষ্ট আবৃত্তিকার) লিখেছেন আমার লেখার সাথে নাকি টিপুদা’র লেখার হুবহু মিল তিনি খোঁজে পেয়েছেন। তিনি আমাকে টিপুদা’র আসনে সমাসীন করেন। আবদ্ধ করেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে। টিপুদাকে তিনি যতটা ভালবাসতেন এখন ঠিক ততটাই আমাকে বাসেন। সে কারণেই হয়তো অনেক দিন অনেক চেষ্টা করেও টিপুদা’র সম্পর্কে কিছু লিখতে পারিনি। কেন জানি কাগজ কলম নিয়ে বসলেই সবকছিু উলটপালট হয়ে যেতো। অনেক কষ্টের বিনিময়ে এই লেখাটি দাড় করিয়েছি। এই লেখা আবেগতাড়িত হৃদয়ের ভাষাই চিত্রিত হয়েছে- টিপুদা’র প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।

টিপুদা সিলেটের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ছিলেন। তার সহজ সরল আচরণ ও হাসিমাখা মুখ সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করতো। খুব সহজেই তিনি আপন করে নিতে পারতেন ৮ বছরের শিশু থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধকেও। সবার সাথে ছিলো তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সিলেটে এমন খুব কমই অফিস আদালত আছে যেখানে টিপুদা যাননি বা সেই অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে টিপুদা’র পরিচয় ছিলো না। টিপুদা ছিলেন একজন নির্লোভ মানুষ। তেমন কোনো কিছুতেই লোভ ছিলো না তার। লোভ ছিলো শুধু সিগারেটের প্রতি। একটি সিগারেট যেনো ছিলো তার কাছে মহামূল্যবান কোনো বস্তু। পরিচিতজনদের কাছে তাঁর প্রত্যাশিত জিনিসটার নাম ছিলো এই সিগারেটই। ডাক্তারের বারণ সত্বেও অনর্গল একটার পর একটা গোল্ডলিফ তিনি নিঃশ্বেষ করেছেন। সর্বদা হাসিমাখা মুখ নিয়ে দিনমান চষে বেরিয়েছেন সারা শহর। প্রত্যেক সংবাদকর্মীর সাথেই তার ছিলো সখ্যতা। বইয়ের প্রতি ছিলো গভীর ভালবাসা। মুক্তিযুদ্ধের কোনো বই বেরুলেই সেটি কেনা চাই। অসংখ্য বই তিনি ক্রয় করেছেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি দেশ মাতৃকার জন্য লড়াই করেছিলেন। দেশের শত্রুদের টিপুদা সহ্য করতে পারতেন না। খেলার পাগল এই মানুষটি খেলার খবর সংগ্রহ করতে গিয়েই সেদিন চিরদিনের মতো লুকিয়ে গেছেন লোকালয় থেকে।

মৃত্যু চিরসত্য, কিন্তু নির্মম। এক বিষন্ন বিদায়। কেউ কোনোদিন ঠেকাতে পারেনি তা। আর হয়তো পারবেওনা কোনোদিন। সেই চিরায়ত নিয়মে টিপুদাকেও আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তবে তিনি পশ্চাতে রেখে গেছেন তাঁর পার্থিব জীবনের অজস্র স্মৃতি। যা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াবে। তার শূণ্যতা পূরণ হবার নয়।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.