Sylhet Today 24 PRINT

রোহিঙ্গা সংকট: ভুলে যাওয়া প্রতিবন্ধী মানুষ

দেবাশিস সরকার |  ২৫ অক্টোবর, ২০১৭

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত পাঁচ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার সরকারের সাম্প্রতিক ইতিহাস সৃষ্টিকারী, নজিরবিহীন অমানবিক নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। স্বজন হারানো মানুষগুলো একদিকে যেমন তাদের ভিটেমাটি ছেড়েছে অন্যদিকে বিভীষিকাময় ভবিষ্যৎহীন সময়ের দিকে বেঁচে থেকেও জীবনকে উৎসর্গ করছে। সময়ের স্রোতে ছোট ছোট নৌকা দিয়ে ভেসে আসা মানুষগুলো অনেকেই মাঝপথে জীবন হারিয়েছে। আবার অনেকেই সামান্য খাবারের আশায় দিনরাত অপেক্ষা করছে তৃতীয় বিশ্বের এক গরিব দেশের গরিব অঞ্চলে।

বাংলাদেশ সরকার, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক সাহায্য সংস্থা যদিও সাময়িক ভাবে প্রাথমিক কিছু সমস্যা যেমন খাবার, বিশুদ্ধ পানি, টয়লেট এর ব্যবস্থা করতে অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু চাহিদার তুলনায় এগুলো সামান্য বলেই ধরে নেয়া যায়।
এত অপ্রতুলতার মাঝে আমরা যদি প্রতিবন্ধীদের কথা বিবেচনা করি তাহলে আমাদের ব্যাখ্যা দেয়ার মতো কি আছে? আমরা কি তাদের কথা মনে রাখতে পেরেছি? প্রশ্ন আসতে পারে যেখানে স্বাভাবিক ভাবে সবার সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে সেখানে আলাদা করে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে ভাবার কথা আসছে কেন?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী একটি দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরণের প্রতিবন্ধী। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম না হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই আমরা রোহিঙ্গা জনসংখ্যার একটা অংশ যে প্রতিবন্ধী সেটা সহজেই বুঝতে পারি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে যেমন সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। বিশেষ করে মহিলা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পুরুষ প্রতিবন্ধীদের চেয়ে দ্বিগুণ বৈষম্যের শিকার  হয়। এমনিতেই তারা সমাজে অবহেলিত মানুষ। যখন যুদ্ধ কিংবা যে কোনো দুর্যোগ আসে তখন তাদের অসহায়ত্ব বর্ণনার অতীত।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা যখন ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, মানুষ খুন করছে  তখন কি তারা প্রতিবন্ধীদের কথা মনে করে দিচ্ছে? তাদের মধ্যে কি ওইধরনের মানবিকতা কাজ করছে? অন্যান্য মানুষ যখন জীবন বাঁচিয়ে রাখার আশায় দিকবিদিক ছুটাছুটি করছে সেক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষগুলো কি তা পারছে? হয়তো তারা ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারাচ্ছে। কোনো গভীর জঙ্গলে অথবা পাহাড়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে পরিবারকে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার কথা বলছে। অথবা পরিবারের সদস্যদের সাথে অনেক কষ্ট করে বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এমন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে এই ধরণের ঘটনা ঘটা কি খুব অস্বাভাবিক?

একটি ব্যক্তিগত ঘটনা বলি: আমার বাবা তার কর্মজীবন থেকে অবসর নেয়ার কিছুদিন পর থেকে বেশ কয়েকবছর শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন। উনি হাঁটতে পারতেন না। আজ যদি আমি এবং আমাদের পরিবার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা হতাম তাহলে কী হতো আমাদের জীবনে? ভয়ে আমার গা শিউরে উঠে। তাহলে আমার বাবার মতো যারা ওখানে ছিলেন বা আজও আছেন তাদের কি অবস্থা এখন? আমরা আসলে শুধু অনুমান করতে পারি। আমাদের কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই কতজন প্রতিবন্ধী নির্যাতিত এলাকায় আছেন বা থাকতেন, বাংলাদেশে কতজন আসতে পেরেছেন। কিভাবে তাদের জীবন চলছে। তাদের জীবনের গল্প হয়তো কোনোদিন জানা হবে না।

আমি এবিসি নিউজ এ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে একটা লেখা পড়ছিলাম। সেখানে এক দম্পতির কথা বলা আছে যাদের ছয়জন সন্তানের মধ্যে দুইজন সন্তান প্রতিবন্ধী। হাঁটতে পারে না। টয়লেট এ যাওয়ার অসুবিধার জন্য তারা ইচ্ছা করে কম ভাত খান। কারণ টয়লেট এ যেতে হলে বনের মধ্যে যেতে হয়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য এটি একটি সমস্যা সেক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কি ধরণের চ্যালেঞ্জ তা সহজেই অনুমেয়। যারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী তাদের অবস্থা চিন্তা করলে আঁতকে উঠতে হয়।যেখানে অপর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী সেখানে প্রতিবন্ধী মানুষগুলো অন্যান্য মানুষের মতো যুদ্ধ করে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না, বিশুদ্ধ পানি পায় না, থাকার মতো নিজস্ব ব্যবস্থা করা সুদূর পরাহত। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবে রোগ বালাই আস্তে আস্তে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। প্রতিবন্ধী মানুষ যখন স্থান পরিবর্তনের শিকার হয় তখন তারা আরও খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউকে থেকে প্রকাশিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার খবরে দেখা যায় মিয়ানমার আর্মি একটি বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তি এবং প্রতিবন্ধীসহ পরিবারের সবাইকে ঘরের ভিতরে রেখে বাইরে থেকে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। গত কয়েক মাসে এধরণের ঘটনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি।

ইউনিসেফ এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী রিফুজি হিসেবে আসা মানুষগুলোর মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ হচ্ছে শিশু। যাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশুই বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধী। ইতিমধ্যে অনেকের চোখে, পায়ে গুলি লেগেছে , অনেকেই তাদের শরীরের অঙ্গ হারিয়েছে। যদি সঠিক তথ্য নেয়া যায় তাহলে দেখা যাবে লক্ষ লক্ষ লোকের মাঝে একটা বড় অংশ প্রতিবন্ধী মানুষ। সাময়িকভাবে হয়তো এতটা বুঝা যাবে না কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর ব্যাপকতা বেড়ে যাবে।

প্রতিবন্ধীদের সমস্যার ধরণগুলো বৈচিত্র্যের দিক থেকে একটু আলাদা হওয়াতে তাদের সমস্যার সমাধানের দিকেও উদ্ভাবনীর সাথে আলাদা নজর দিতে হবে। ইউনিসেফ, ডব্লিউএইচও, ইউএনএইচসিআর, হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল, ডক্টরস উইদাউট  বর্ডারস এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে গুরুত্বের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এধরণের বর্বরোচিত নির্যাতন, ধর্ষণ, চোখের সামনে খুন এর মতো ঘটনাগুলো মানুষকে ট্রমাতে নিয়ে গেছে। তারা  জানে না কবে স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে।

যেহেতু অনেক সরকারি-বেসরকারি সংস্থা একসাথে কাজ করছে সেহেতু সমন্বিত সহযোগিতা ও তথ্য আদান প্রদান এর মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, তাদের সাথে যেসব সংস্থার বিশেষভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা আছে তাদের পরামর্শে চাহিদা অনুযায়ী ন্যূনতম সাহায্য প্রদান করা, পরিবার এর কাউকে বিশেষভাবে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যাতে করে এই ধরণের পরিস্থিতিতে পারিবারিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা যায়। সর্বোপরি নিয়মিত যোগাযোগ এর মাধ্যমে ফলোআপ করা।

বেঁচে থাকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী মানুষের অনেক কষ্টের মধ্যে যেতে হয়। যদিও এই পরিস্থিতিতে কাজটা অনেকটা কঠিন কিন্তু করতে না পারলে আমরা হয়তো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগবো কিন্তু সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যারা এখনো সীমাহীন  বৈষম্যের শিকার তাদেরকে বেঁচে থাকার আশাটুকুও দিতে পারবো না।     

  • দেবাশিস সরকার: উন্নয়নকর্মী ও গবেষক; ইমেইল: [email protected]

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.