Sylhet Today 24 PRINT

হায় ‘শিরিশ’, তোর কথা জানে ক’জনে!

মোহন রবিদাস |  ০৮ মার্চ, ২০১৮

৮ মার্চ,আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের সম্মানে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় চা-বাগানের নারীদের কাছে আজকের এই দিনটি বিশেষ কোন গুরুত্ব বহন করে না। প্রতিদিনের মতো আজকেও তারা কাজ করছেন। চা-শ্রমিক নারীরা জানেনও না আজকে কী দিবস। অথচ বাংলাদেশের চা-শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন এই নারী চা-শ্রমিকরাই।

এ দেশের অন্যান্য শ্রমজীবী নারীদের তুলনায় চা-বাগানের নারী চা-শ্রমিকদের জীবনধারা ও কাজের ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। চৌকিদারের ডাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাংসারিক সব কাজকাম করে সকাল ৮টার মধ্যে কাজে বেরিয়ে পড়তে হয়। স্থানভেদে -৫ মাইল পায়ে হেঁটে তারপর কর্মস্থলে পৌঁছাতে হয়। সাধারণত চা পাতা তোলা ও চা গাছ ছাঁটাই করা দুটি কাজই নারী চা- শ্রমিকরা করে থাকেন, যা খুবই কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে বর্ষাকালে তাদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। কেননা অনেক উঁচু উঁচু টিলা (ছোট পাহাড়) বেঁয়ে তাদেরকে চা পাতা সংগ্রহ। এছাড়া যেহেতু চা গাছকে ঘিরে গভীর জঙ্গল বা আগাছা থাকে তাই সেখানে বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ, বিচ্ছু, গজর (শুঁয়োপোকা), হাড়ি বরল (এক ধরনের বিষাক্ত মাছি যা চা গাছের ডালে মাটির হাড়ি বানিয়ে বাস করে), বিষাক্ত পিঁপড়া ইত্যাদির অবাধ বিচরণ। তারা এগুলোর কামড় খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাই এগুলোকে বিষাক্ত বলে মনে করে না।

যাহোক, মাত্র ৮৫ টাকার বিনিময়ে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা অবধি তাদেরকে কাজ করতে হয়। এর মধ্যে তারা দুপুর দুইটার সময় আধা ঘণ্টা সময় পায় দুপুরের খাবারের জন্য। তখন বাড়ি থেকে আনা রুটি এবং তার সাথে মরিচ, পিঁয়াজ, আলু ও কচি চা পাতা মিশিয়ে বিশেষ এক ধরণের চাটনি তৈরি করে দুপুরের খাবার সেরে ফেলে। কেউবা চাল ভাজা ও লাল চা দিয়েই সাঙ্গ করেন দুপুরের খাবার। তারপর আবার শুরু কাজ করেন, যা চলতে থাকে বিকাল ৫ টা অবধি। তারপর আবার বাড়ির কাজ করতে হয় এবং পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠা... এভাবেই শত কষ্টের মধ্যে কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন।

এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে এই মহীয়সী নারীরা এক বিরাট ভূমিকা পালন করছেন, কিন্তু এদের ভাগ্যের উন্নতির জন্য সরকারপক্ষ থেকে কোন ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।

নিচের কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনা করলে নারী চা-শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবো:
অনেক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে নারী চা-শ্রমিকদের কাজ কাজ করতে হয়। বৃষ্টির দিনে তাদের ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। কর্মক্ষেত্রে পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির অভাবে নারী চা-শ্রমিকরা অনেক কঠিন রোগের শিকার হন। যে কারণে ৫০ বছরের একজন নারীকে ৮০ বছরেরও বেশি বয়সের মনে হয়।

পারিবারিক জীবনে নানান দিক থেকে উপেক্ষিত হয় নারী চা শ্রমিকরা। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। পারিবারিকভাবে তাদের কাজকে মূল্যায়ন করা হয় না।

সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীদের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। সামাজিক বৈঠক, সভা-সমাবেশ ইত্যাদিতে তাদেরকে স্থান দেয়া হয় না।

রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও নারী চা-শ্রমিকের ভাগ্য-উন্নয়নে কেউ এগিয়ে আসছে না। এমনকি নারী সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানেও আমাদের নারীরা কোন সেবা পাচ্ছেন না।

আন্তর্জাতিক অঙ্গন
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উপেক্ষিত হচ্ছেন আমাদের নারী চা-শ্রমিকরা। সারা বিশ্বব্যাপী নারী সমাজের উন্নয়নে যেসকল আইন-নীতি, উন্নয়ন-পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয় তাতে আমাদের নারী চা-শ্রমিকরা স্থান পান না।

স্বাস্থ্য
চা-বাগানগুলোতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার মানের অবস্থা খুবই নাজুক কারণ। এখানে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলে রসিকতা। আমাদের নারীদের জটিল কিছু অসুখ আছে যার চিকিৎসা পাওয়া তো দূরের কথা এই অসুখ-বিসুখের কথা তাঁরা প্রকাশ করতেও সংকোচবোধ করেন। অভিজ্ঞ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী না থাকায় চা-বাগানগুলোতে মাতৃ হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। অথচ বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর জন্য কয়েকবার আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছে।

১৯৬২ সালের টি প্লান্টেশন লেবার অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৭৭ সালের প্লান্টেশন রুলস-এ চা বাগানগুলোতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা মালিকের দায়িত্ব থাকলেও তা করা হচ্ছে না। যক্ষ্মা, টাইফয়েড, রক্তশূন্যতা, ডায়রিয়া ইত্যাদি চা-শ্রমিকদের নিত্য দিনের সঙ্গী।

রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নারী চা-শ্রমিকদের জন্ম হয় শুধু চা-বাগানে কাজ করার জন্যই। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অংশগ্রহণকে অবাঞ্ছিত মনে করা হয়। যেকারণে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম জোরদার হচ্ছে না।
নারী চা-শ্রমিকরা অসহায়ের মধ্যে অসহায় প্রান্তিকের মধ্যে আরও বেশি প্রান্তিক। সমাজ জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁরা প্রান্তিক অবস্থানে আছে।

প্রান্তিকতা কিংবা ইন্টারসেকশনালিটি: নারী চা-শ্রমিকরা অসহায়ের মধ্যে অসহায় প্রান্তিকের মধ্যে আরও বেশি প্রান্তিক। সমাজ জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁরা প্রান্তিক অবস্থানে আছে।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন-নীতি ও চা-শ্রমিক নারী
সংবিধান
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭, ২৮(১), ২৮(৪) ধারাসহ নারী সংশ্লিষ্ট যেসকল ধারা রয়েছে তার কোন বাস্তব প্রয়োগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যেকারণে তাঁরা আরও বেশি উপেক্ষিত হচ্ছেন।

জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি- ২০১১
বাংলাদেশের নারীসমাজের উন্নয়নের জন্য জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি- ২০১১। এই নীতিতে দেশের সকল সেক্টরের নারীদের কথা বলা বলা হলেও চা-শ্রমিক নারীদের নিয়ে একটি বাক্যও লেখা হয়। অথচ এই নারীরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

সিডও সনদ
নারীদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ করার জন্য ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বরে গৃহীত হয়। সিডও সনদ (ইংরেজিতে Convention of the Elimination of All Forms of Discrimination Aganist Women - CEDAW)। সিডও সনদে যেসকল ধারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো নারী চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও তা মোটেও আমলে নেয়া হচ্ছে না।

করণীয়
১) নারী দিবসে চা-বাগানে ছুটি ঘোষণা করে এই দিনটি বিশেষভাবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে;
২) চা-শ্রমিক নারীদের উন্নয়নে কাজ করার জন্য উপজেলা ও জেলা মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর সর্বোপরি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে;
৩) “জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১০” সহ নারী সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন-নীতিতে চা-বাগানের নারীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে;
৫) নারীদের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে;
৬) নারী চা-শ্রমিকদেরকে বিলবোর্ড-বিজ্ঞাপনে উপস্থাপন করা বন্ধ করতে হবে;
৭) দেশীয় মেকে-প্রদর্শনীতে নারী চা-শ্রমিককে ভুলভাবে উপস্থাপন করা বন্ধ করতে হবে;
৮) চা শ্রমিক নারীদের প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে;
৯) চা বাগানের বাইরে নারী চা শ্রমিককে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বন্ধ করতে হবে;
১০) নারী চা শ্রমিকদের কাজের যথার্থ স্বীকৃতিসহ উপযুক্ত মজুরী দিতে হবে;

  • মোহন রবিদাস: বিএসএস (সম্মান), এমএসএস(লোক-প্রশাসন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; চা-শ্রমিক সন্তান। ইমেইল: [email protected]

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.