Sylhet Today 24 PRINT

‘সেফুদা’ ও আমাদের সস্তা আবেগ

রিপন দে |  ১৯ আগস্ট, ২০১৮

সেফাতউল্লাহ ওরফে সেফুদা। ছবি: সংগ্রহ

“মদ খা, মানুষ হবি” অনলাইনে বর্তমানের সব চেয়ে বেশী প্রচারিত এবং জনপ্রিয় উক্তি। আর এই উক্তির জনক বিকৃত মস্তিস্কের এক অষ্ট্রিয়া প্রবাসী বাঙালি সেফাতউল্লাহ, তবে তিনি ‘সেফুদা’ হিসেবেই পরিচিত। তার বাড়ি চাঁদপুরে হলেও ২৮ বছর যাবত তিনি দেশের বাইরে আছেন। দেশে তার স্ত্রী এবং এক ছেলে থাকলেও তাদের সাথে নেই তার কোন যোগাযোগ। বিচ্ছিন্ন জীবন কাটানো সেফুদার মূলত ফেইসবুক লাইভের মাধ্যমে উত্থান ঘটেছে বিতর্কিত কথাবার্তা আর গালাগালির মাধ্যমে।

‘সেফুদা’ নিজেকে একজন মুক্তমনা, কবি, সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, হলিউড-বলিউডের অভিনেতা ও জাতিসংঘের প্রতিনিধি বলে পরিচয় দেন। নিজেকে নিয়ে গর্ব করেই বলেন আমি প্রেমসম্রাট, আমি প্রেমের নবী, আমি বিশ্ববিখ্যাত সেলেব্রিটি, সাংবাদিক, দার্শনিক, হলিউড অভিনেতা। আজন্ম অহংকারের সহিত বলেন- ‘ কী, হিংসে হয়? আমার মতো হতে চাও?’ নিজের এত পরিচয় দিলেও তার কাজের সীমানা গালাগালির মাঝেই শেষ। কয়েকটা ভিডিও দেখে বুঝতে পারলাম অর্ধেক মিনিটও তিনি কথা বলতে পারেন না তার ভাষায় ‘শব্দবোমা’ মারেন আর তা হচ্ছে ‘ম’ ও ‘চ’ বর্গীয় কুৎসিত শব্দ। বিকৃত মস্তিষ্কের এই ‘সেফুদা’-কে নিয়ে বিব্রত তার পরিবার, উনার স্ত্রী একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, “২৮ বছর আগে দেশ ছাড়েন সেফাত উল্লাহ। তারপর থেকেই পরিবার থেকে তিনি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। পরিবারের দাবি, বর্তমানে তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত। আর তার এমন কর্মকাণ্ডে পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন বিব্রত। আত্মীয়-স্বজনের কাছে আমাদের মুখ নাই।"

বিকৃত মস্তিকের এই লোক আগ্রহের কারণেই এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তাই কুৎসিত এই প্রচারণার দায় আপনার আমার সকলের। কী আছে তার মধ্যে যার জন্য আমরা এতো ইন্টারেস্টেড? তার জনপ্রিয়তা নেটদুনিয়ার সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। একেকটি ভিডিও এডিট করে করে হাজারো ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড হচ্ছে; অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে প্রতিটা চ্যানেলে আবার ৩০-৪০ হাজার সাস্ক্রাইবার। ভিউ হচ্ছে ৪/৫ লক্ষ করে। অথচ আমাদের নামকরা টিভি চ্যানেলে অনেকগুলোর ইউটিউব চ্যানেলের সাস্ক্রাইবার মাত্র কয়েক হাজার। কিন্তু আমাদের সমাজে জনপ্রিয়তা পাওয়া এত সহজ কোনো? শুধু গালাগালি আর প্রকাশ্যে মদ খেয়েই যদি এত জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় সেটা অবশ্যই বড় ভাবনার বিষয়।

সেফুদা যাদের কাছে জনপ্রিয় তাদের বেশিরভাগ তরুণ। আমাদের তরুণদের রুচি এত নিচে নামার কারণ কী? প্রকাশ্য মদ খেয়ে ভিনদেশে বসে দেশের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দসহ প্রতিটা মানুষকে যে গালাগালি করছে, দেশের মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলছে গরিব, ছোটলোক কখনো আবার মদ বানানোর উপায় শেখাচ্ছেন। বিকৃত মস্তিকের এই সেফুদা আমাদের কাছে জনপ্রিয়? ব্যাপারটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য যেমন ভাবনার বিষয় তেমনি আমদের ব্যর্থতারও পরিচয় দেয়।

সেফুদা তার এই কর্মকাণ্ডকে দেশের দুনীতি, স্বজনপ্রীতি এবং রাজনৈতিক ধান্দাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে দেখছেন এবং তার যুক্তিতে অনেকেই আবার একমত হচ্ছেন। মানতে বাধা নেই আমাদের দেশে প্রতি ইঞ্চিতে-ইঞ্চিতে দুর্নীতি অনিয়ম, অপরাধ তা সত্য কিন্তু এর থেকে বের হতে হলে আরেকটা অশালীন উপায়কে টেনে ধরতে হবে তা সুস্থ চিন্তায় কখনোই সম্ভব নয়। মদ খেয়ে কেউ ভাল মানুষ হবে সে যুক্তি পাগলেও বিশ্বাস করবেনা। তবে মদ খেলে যে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা মোটা দাগে এই সমাজ একমত। প্রকাশ্যে মদ খাবার জন্য উৎসাহ দেওয়া আর সেই উৎসাহদাতাকে নিয়ে তরুণদের মাঝে ক্রেজ সৃষ্টি হওয়া ব্যাপারটা আত্মঘাতী।

সেফুদার কর্মকাণ্ড স্রেফ নোংরামি ছাড়া আর কিছুই নয়। একটা নোংরামি আরেকটা নোংরামির জন্ম দিতে পারে এর বাইরে আর কিছুই হতে পারেনা। সেফুদার নোংরামির কুপ্রভাবে যদি এত জনপ্রিয়তা পেতে পারে নিশ্চিত এমন সেফুদা আরও আসবে অনলাইনে। জনপ্রিয় বা পরিচিত হবার নেশা আফিমের চেয়েও মারাত্মক যা আমরা এই নেট দুনিয়াতেই দেখেছি। কিছু দিন পূর্বে অনলাইনে কে কতটা খোলামেলা ভিডিও ছাড়তে পারে তার প্রতিযোগিতা হয়েছে উঠতি কয়েকজন মডেলের মধ্যে যা তাদের সাময়িক জনপ্রিয়তা দিলেও এখন তা শুধুই শুধু নোংরামির ইতিহাস ছাড়া আর কিছু নয় এবং এই নোংরামি থেকে মানসিক অশান্তিতে পড়ে চট্টগ্রামের এক মেয়ে আত্মহত্যাও করেছে।

সেফুদার নোংরামির কুপ্রভাব ও দৃশ্যমান হবে কিছুদিনের ভিতরেই যা শুধু ব্যক্তি এবং সমাজ জীবনে অশান্তিও সৃষ্টি করবে মাত্র।

একটা প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক আমরা কেন বার বার এমন নোংরা মানসিকতার মানুষদের খুঁজি? আমাদের তরুণদের মধ্যে কেন এমন চরিত্র জনপ্রিয় হয়? নেটদুনিয়ায় সবচেয়ে বেশী হিট সে ভিডিও যে ভিডিওতে যত বেশী নোংরামি। আমাদের তরুণদের মননে এই পরিবর্তন আসলো কেন? আমাদের তরুণদের জন্যই আমরা ৫২, ৭১ এর মত কঠিন যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু ডাকে এই তরুণরাই জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল তাদের আইডল ছিলেন একসময় খালেদ মোশারফের মত দেশপ্রেমিক। এই তরুণদের জন্যই রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। এই তরুণদের মাঝেই আমরা পেয়েছিলাম জামিল, রুমি, সালাম, রফিক, বরকতদের মত লাখো সূর্যসন্তান। কিন্তু সেই তরুণ সমাজের সামনে স্বাধীনতার এত বছরেও আমরা একজন আইডল দাঁড় করাতে পারিনি। স্মার্টফোন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি।

এ দায় কার? নিশ্চয়ই তাদের যারা স্বাধীনতার পর থেকেই দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে। এত বছরেও তরুণ প্রজন্ম পায়নি একজন আইডল তবে সময়ে সময়ে অনেক এসেছেন কিন্তু নিজেদেরও স্বার্থের বাইরে কেউ যেতে পারেনি। বিগত জোট সরকারের আমলে তারেক জিয়া আসলেন তরুণদের নেতৃত্ব দিতে, কিন্তু আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে গিয়ে হারালেন নিজের অবস্থান। আওয়ামী লীগ আনলো সজীব ওয়াজেদ জয়কে, তিনিও পারেন নি সামান্য পরিমাণ। এই দেশে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় যে তরুণ জমায়েত তা এসেছিল তরুণদের হাত ধরেই গণজাগরণমঞ্চ; সেখান থেকেও তারা প্রতারিত হয়েছে।

সমাজের মেরুদণ্ড এই তরুণ সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনা করার দায়িত্ব যাদের তারাই বারবার তরুণদের ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে, আর এতেই দিনে দিনে বিতৃষ্ণা জন্মেছে আমাদের তরুণদের মধ্যে।

এই তরুণদের সঠিক মননশীল করে তুলতে প্রয়োজন সঠিক বিনোদন ব্যবস্থা যার কিছুই আমাদের নেই। স্মার্টফোনের ৫ ইঞ্চি পর্দায় জীবন থেমে আছে। স্বাভাবিক বিনোদনের মাধ্যম সিনেমা এ দেশ থেকে বিলুপ্তি পথে। আড্ডা দেবেন, খেলবেন; তার জন্য নেই ব্যবস্থা। মাঠ-ঘাট সব দখল করে উঠছে একের পর এক ইমারত। যত বড় বড় ইমারত উঠছে আমাদের রুচি তত নিচের দিকে যাচ্ছে, সাথে আরও আছে পুলিশি বাধা। এইত কিছুদিন আগে মৌলভীবাজারের এক রেস্টুরেন্ট থেকে ১৬ তরুণ-তরুণীকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ তাদের অপরাধ তারা আড্ডা দিচ্ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা সুস্থ বিনোদনের অভাব, প্রতিহিংসার রাজনীতি দুর্নীতি যার সব ঘটছে আমাদের তরুণ প্রজন্মের সামনে। অসুস্থ এই সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করছে অসংখ্য অসুস্থ চিন্তার। দেশ ও সমাজরে নেতৃত্বদের এখনি ভাবা উচিৎ আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে।

সেই সাথে তরুণ প্রজন্মের দায় আছে নৈতিক ও অনৈতিক বিষয়ের পার্থক্য বুঝে চলার। এই ধরনের বিকৃত আচরণকে ভাইরাল করা, এবং এ নিয়ে ক্রেজ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে সমাজের পাশাপাশি পরিবারকেও ভূমিকা রাখতে হবে। ভাল-মন্দের তফাৎ বোঝার সেই বোধটুকু জন্মানোর দায় আমার-আপনার-সকলেরই।

  • রিপন দে: গণমাধ্যম কর্মী।
  • [প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.