Sylhet Today 24 PRINT

আপনা মাংসে হরিণা বৈরী

জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন ঢাকা

আব্দুল করিম কিম |  ১৩ অক্টোবর, ২০১৮

কিছুদিন থেকে ভাবছি, ঢাকার মানুষ কি আবার সিলেটে ফিরছে?
ঢাকায় স্থায়ীভাবে নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে ফেরাটা কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও হয়তো অনেকে ফিরে। কেউ অবসর জীবনে গ্রামের বাড়ীতে শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করতে ফিরে আসে। কেউ ফিরে, ঢাকার নাগরিক জীবনে পরাজিত হয়ে। কেউ আবার ঢাকায় সফল হতে হতে সেই সফলতাকে উপভোগ করতে সিলেট ফিরে আসে; প্রথাগত রাজনীতির টিকেট নিয়ে মন্ত্রী/এমপি নির্বাচিত হয়। এভাবে ফিরে আসা মানুষের বাইরে আর কী কেউ সিলেট ফিরছে ? মনে হয় ফিরছে।

আমার মনে এ ভাবনার উদয় হয়েছে, ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত জালালাবাদ এসোসিয়েশন-এর কার্যকরি পরিষদের নির্বাচনী ডামাডোল দেখে। ফেইসবুকের কল্যাণে দেখেছি নির্বাচনী প্রচার অভিযানে ঢাকা থেকে একদল প্রার্থী হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা হয়ে সিলেট বিভাগের স্থানে স্থানে মতবিনিময় সভা করছেন। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন । বিষয়টি আমার কাছে বেশ কৌতূহলের উদ্রেক করলো।

ঢাকাস্থ জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনের প্রার্থীরা সিলেট কেন ঘুরছেন? তাঁদের ভোটার এখানে কিভাবে এলেন?

যারা জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশনের মত প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের সদস্য হতে পারেন, তাঁরা ঢাকা ছেড়ে কি কারণে এখন সিলেটবাসী? তবে কি 'ফিরে চল মাটির টানে' রাজধানীর মোহ ত্যাগ করে সংগঠন করার মত যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষেরা সিলেট ফিরছে?
খোঁজখবর শুরু করলাম। জানতে পারলাম, ঢাকা থেকে কেউ ফেরেননি, এই ভোটারেরা সিলেটেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন কিন্তু উনারা ঢাকাস্থ জালালাবাদ এসোসিয়েশন-এর জীবন সদস্য বা সাধারণ সদস্য। কৌতূহল আরও বেড়ে গেলো।

এরমধ্যে গতকাল একটি অনুষ্ঠানে দেখা হ'ল সিলেট বারের প্রাক্তন সভাপতি ও সিলেট স্টেশন ক্লাবের বর্তমান সভাপতি ই ইউ শহিদুল ইসলাম শাহিন ভাইয়ের সাথে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম, তিনি ঢাকাস্থ জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশনের একজন জীবন সদস্য। জানতে চাইলাম, আপনি কি ঢাকায় থাকা অবস্থায় সদস্য হয়েছেন? জানালেন, সিলেটে থেকেই হয়েছেন। উনার একজন পরিচিত জন জোর করেই উনাকে আজীবন সদস্য করেছেন। আজীবন সদস্য ফি বাবদ ৫,০০০ টাকা চেকে প্রদানের কথাও জানালেন।

শাহিন ভাই, সিলেটের সামাজিক নাগরিক আন্দোলন সংগ্রামের মানুষ । তিনি সিলেট নগরীর লামাবাজার এলাকার ভাতালিয়া আবাসিক এলাকার পারিবারিক বাসভবনে থাকেন। তিনি ঢাকার অধিবাসী নন কিন্তু তাঁকে ঢাকাস্থ জালালাবাদ এসোসিয়েশন-এর জীবন সদস্য করা হয়েছে। কৌতূহল আরও বেরে গেল । খোঁজ লাগালাম, জালালাবাদ এসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্রের। গঠনতন্ত্র হাতে এলো।

গঠনতন্ত্রের উদ্দেশ্য অংশ ৩ এর (ক)-তে স্পষ্ট ভাবে লেখা রয়েছে, জালালাবাদ এলাকা (সিলেট বিভাগের)'র বাহিরে বসবাসরত জালালাবাদবাসীর মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, দেশাত্মবোধ ও সহ-অবস্থানের ভাব গড়িয়া তোলা । আবার এর সদস্য হওয়ার যোগ্যতা বিষয়ে ধারা ৫ এর (ক) তে বলা হয়েছে, জালালাবাদ এলাকা অর্থাৎ বর্তমান সিলেট বিভাগের সকল জেলার সিলেটী ভাষাভাষী যে সমস্ত অধিবাসী জেলার বাইরে বসবাস করছেন এবং যাহারা পৈত্রিক সূত্রে এই এলাকার বাসিন্দা হওয়ার দাবিদার তাহাদের মধ্যে যাহাদের বয়স আঠারো বৎসরের কম নহে তাহারা এই এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হইতে পারিবে।

জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশনের এই গঠনতন্ত্র পড়ে কারা সদস্য হতে পারবে সে সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পেলাম। সেই ধারণা আমার কৌতূহল নিবৃত করলেও জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা ছিল তা প্রশ্নবিদ্ধ হ'ল। আমার মনে হয়, এই বিষয়টি সবার কাছে খোলাসা হলে জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। জনমনে তৈরি হবে নানান জিজ্ঞাসা।

জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকা'র সাথে সিলেট বিভাগের জ্ঞানে-মননে-মেধায় দেশ বরেণ্য ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যাদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র-সমাজ পরিচালিত হয়, তেমন মানুষদের সম্পৃক্ততা সত্বেও 'জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন' গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে কী ভাবে সদস্য সংগ্রহ করে? নির্বাচনী ডামাডোল দেখেই বোঝা যায়, একটি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী যত্রতত্র সদস্যপদ বিতরণ করেছে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেয়ার জন্য। এরা ঘুরেফিরে জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশনের পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত থাকে। খবর নিয়ে জানলাম, এমন অনেকে আছেন, যাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম জালালাবাদ ভবনে। এখানে বসে ব্যবসা করেন, রাজনীতি করেন, তদবির বাণিজ্য করেন অনেকে। এরা এমন একটি বলয় তৈরি করে রেখেছেন যে, এ্যাসোসিয়েশনের যে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ঘুরেফিরে তাদেরকেই প্রাধান্য দিতে হয়। এরা নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাই জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে, আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সদস্যদের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে। যা বছরের পর বছর চাপা দিয়ে নেভানো হচ্ছে।

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের সিলেট বিভাগ তথা জালালাবাদ এলাকার মানুষের অগ্রসরমান বরেণ্য ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় ১৯৪৮ সালে জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ঢাকাবাসী সিলেটী মানুষের মধ্যে যোগাযোগ সৃষ্টি, ঐক্য গড়ে তোলা, পারস্পারিক সখ্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শেকড় থেকে দূরে থাকা পরবর্তী প্রজন্মকে সিলেটী ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে এই প্রতিষ্ঠানের অবদান অনস্বীকার্য । সিলেটে বিভাগে বিভিন্ন সময়ে হওয়া দৈব্য-দুর্বিপাকে জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন তাৎক্ষণিকভাবে ত্রাণ সাহায্য নিয়ে ছুটে এসেছে। অসচ্ছল মেধাবীদের আর্থিক সাহায্যের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে জালালাবাদ এডুকেশনাল ট্রাস্ট। রাজধানীর প্রাণ কেন্দ্র ২২ কাওরান বাজারের রয়েছে এসোসিয়েশনের নিজস্ব ১২ তলা ভবন। যার নাম জালালাবাদ ভবন। ভবনের ৪র্থ তলায় রয়েছে অফিস, অডিটোরিয়াম ও লাইব্রেরি। একটি আঞ্চলিক সংগঠনের রাজধানীর অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্রে ১২ তলা ভবনের মালিকানা চাট্টিখানি বিষয় নয়। এই ১২ তলা ভবন থেকে প্রতিমাসে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা ভাড়া আদায় হয়। এ ছাড়াও জালালাবাদ এডুকেশনাল ট্রাস্টে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড়মাপের আর্থিক অনুদান জমা হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে আয়ের অঢেল প্রবাহ থাকলেও অঢেল অনর্থক ব্যয় নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।
সিলেটবাসীর গৌরব করার মত এই অনবদ্য আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কোনভাবেই যেন আপনা মাংসে হরিণা বৈরী, না হয়। এখনো সময় আছে, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভোটার তালিকা সংশোধন করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপণার চর্চা পরিহার করে সামাজিক দায়িত্ববোধ, ঐক্য, ভাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ও দেশাত্মবোধ সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা শাণিত হোক।

  • আব্দুল করিম কিম: পরিবেশকর্মী ও নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.