Sylhet Today 24 PRINT

যেহীন আহমদ: নিরবে হারিয়ে যাওয়া এক আলোকবর্তিকা

ডা. এম এ আহাদ |  ০৪ নভেম্বর, ২০১৮

আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, গুণগ্রাহীদের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে হযরত শাহজালাল (র) এর মাজার সংলগ্ন গোরস্থানে বাবা মায়ের পাশে সমাহিত হলেন প্রিয় বন্ধু যেহীন আহমেদ।

ছোটখাটো চেহারার মিতবাক, সুপন্ডিত এ মানুষটি যখন কোন বিষয়ে কথা বলত, চুম্বকের মত আকৃষ্ট করতেন মানুষকে। আমি নিজেও ছিলাম তাদেরই একজন। তার স্বপ্ন ছিল মানুষের কল্যাণ ও দারিদ্র্য বিমোচন। সিলেটের সবচেয়ে বড় এনজিও FIVDB প্রতিষ্ঠা করে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্হান সৃষ্টি করেছেন। এছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, এবং শিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে অনেক প্রকল্প গড়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে FIVDB এর Functional Literacy দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। ব্র্যাক এর সহযোগিতায় সিলেটের খাদিমনগরে দৃষ্টিনন্দন কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছেন, যেখানে midwifery পড়ানো হয়।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে গর্ভবতী-প্রসূতি নারীদের গর্ভকালীন সকল সুযোগ সুবিধা সহজলভ্য না হওয়ায় অনেক অসুবিধা ও বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তাদের। তার স্বপ্ন ছিল এই সমস্যার তৃণমূলে যেয়ে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দেয়া। লক্ষ্য ছিল, নিরাপদ সন্তান প্রসব সুনিশ্চিতকরণ। তার এই কমপ্লেক্সটি বাংলাদেশের জন্য একটি রোল মডেল। ইতোমধ্যে দুটি ব্যাচ বেরিয়েছে, আরো দুটি বর্তমানে প্রশিক্ষণরত। শুরুর দিকে আমাকে নিয়ে গিয়ে, অসুস্থ দেহে ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছিলেন প্রকল্পটির কোথায় কী হচ্ছে, ভবিষ্যতে কী হবে। তার দুচোখে দেখেছিলাম ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ এর স্বপ্ন, সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি গভীর মমতা। কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার সিএনজি গরীব চালকদের সহজ কিস্তিতে দিয়েছে FIVBD।

যেহীনের সাথে আমার বন্ধুত্ব প্রায় ১৪ বছর আগের। সহপাঠী ড. শেখর শোভন পাল চৌধুরী ও প্রয়াত বন্ধু মাসরুর চৌধুরীর সঙ্গে এসেছিলেন আমার বাসায়। সাথে ছিলেন শেখর আর মাসরুরের স্ত্রীরাও। আমার স্ত্রী আর শেখরের স্ত্রী, উনারাও ছিলেন সহপাঠী। বিরতিহীন আড্ডায় দুদিন যে কী করে কেটেছিল, কেউই টের পাইনি - না আমরা, না মহিলারা। সেই আড্ডার রেশটুকু এখনো স্মৃতির মণিকোঠায় সমোজ্জ্বল। এরপর থেকে আর ছেদ পড়েনি আমার আর জেহীনের বন্ধুত্বে। আত্মার সাথে যার সম্পর্ক, তাকে যদি আত্মীয় বলা হয়, তবে জেহীন ছিল আমার পরমাত্মীয়।

নিজের বাসা আর ঢাকার অফিস ছাড়া অন্য কোথাও খুব একটা রাত্রিযাপন করতেন না। সময় সুযোগ হলেই বৃহস্পতিবার বিকেলে অফিস থেকে ফিরে সরাসরি আমার বাসায় চলে আসতেন। শনিবার বিকেল পর্যন্ত নানা প্রসঙ্গে আড্ডায় কীভাবে যেন সময় কেটে যেত, আমরা টের পেতাম না। সেই আড্ডায় আমার অন্য বন্ধুরাও যোগ দিতেন। যেহীনের কথা শুনতে সকলেই উন্মুখ থাকতেন।

রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, রুমী, হাফিজ, সাদী, গালিব, ইকবাল, নেরুদা, হেমিংওয়ে এর ভক্ত ছিলেন জেহীন। কথোপকথনে প্রায়ই উনাদের প্রসঙ্গ উঠে আসত। প্যাশন ছিল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, রবিন্দ্রনাথের গান ও গজলে। প্রায়শই রবিন্দ্রনাথ বা গজলের দুটি চরণ আউড়ে বলতেন, মননে ও চিন্তার কোন স্তরে পৌঁছুলে এসব কথা কলমের কালিতে লিখা যায়!

বিগত অনেক বছর ধরে এমন কোন দিন খুব কম ছিল, যেদিন যেহীনের সাথে ফোনে কথা বলা হয়নি। এমনও  দিন গিয়েছে, ফোনে পাঁচ বারও কথা হয়েছে। নানা বিষয়ে হঠাৎ করে কোনো প্রসঙ্গ মনে আসলে যেহীনের সাথে আলাপ হত, আর সেই আলাপচারিতায় বৈষয়িক কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। হয়তো কোন কবিতা বা গজলের পঙ্ক্তি, অথবা কোনো চরণ মনে আসলেই আমাদের ফোন-আলাপ হত। যেহীনের আরও অনেক ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন, সকলেই তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তবে তাদের সময় ছিল সীমিত।  কর্মক্ষেত্রে যেহীন ছিলেন স্বাধীন, আর আমার ছিল অখন্ড অবসর। তাই যেকোনো সময়ই ছিল আমাদের আলাপের সময়।

এ জ্ঞানপিপাসু মানুষটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন, জীবনের পথে মিশেছেন বহু গুণী মানুষের সাথে। কিন্তু নিজের বিষয়ে প্রকাশ করায় তার অনীহা ছিল। একদিন আমার ঘরে দুই বন্ধু আড্ডায় নিমজ্জিত। আমি বিছানায় হেলান দিয়ে, তিনি বসা আমার পাশের আরাম চেয়ারে। অনেক বছর আগে যখন শান্তিনিকেতন যান, গেস্ট হাউসে উঠেছিলেন। রিসেপশনে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে যখন লিখছিলেন, তখন ঠিকানায় সিলেট দেখে রিসেপশনিস্ট বললেন, "সিলেট এর একজন বিখ্যাত মানুষ আছেন এখানে, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।" পরিচয় হলো  রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কারে ভূষিত প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক, রবীন্দ্র গবেষক অমিতাভ চৌধুরীর সাথে। অমিতাভ বাবু  বললেন, "বসো, তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাব।" নিয়ে গেলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এর বাড়িতে।

ভেতর থেকে কনিকা বললেন, "বসেন, চা খান, আসছি।" কনিকা সাজগোজ ছাড়া বের হতেন না, যথেষ্ট সময় নিয়ে আসলেন। অমিতাভ বাবু বললেন, "শুধু চা তে হবে না, গান শোনাতে হবে। আমার সাথে সিলেটের এই ছেলেটিকে নিয়ে এসেছি।" তারপর কয়েকটি গান গাইলেন কনিকা।

যেহীন আমাকে বললেন, "ভাবতে পারো আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এর বাড়িতে, কনিকা খালি গলায় গান গাইছেন আর আমি সামনে বসে শুনছি! ওখান থেকে তার পরে নিয়ে গেলেন আরেক বিখ্যাত সিলেটির বাড়িতে। মানুষটি প্রখ্যাত কবি অশোক বিজয় রাহা। কিছুক্ষণ গল্প করার পর, অশোক বিজয় রাহা বললেন, "তুমি সিলটী ফুয়া, আর আমি আছি ইখানো, তুমি গেস্ট হাউসো থাকবায়, ইটা ঐতো ফারে না। তুমি ব্যাগ লৈয়া আইও, আমার বাড়িত থাকবায়। অবশ্য তুমার বৌদিয়ে বালা রানতা ফারৈন না। ডাইল-ভাত যিতাই অয়, দুই ভাইয়ে খাইমু।" অগত্যা ব্যাগ নিয়ে আসতে হল উনার বাড়িতে।

পরদিন নিয়ে গেলেন শান্তিদেব ঘোষের বাড়িতে। বসলাম মাটিতে, চাদর বিছানো চাটাই এর উপর। অনেক গল্প হল, নাস্তা আসলো- মুড়ি, বাতাসা, আর সাথে গরম দুধ। - বলল জেহীন। আমি বলেছিলাম, "যেহীন, এই পরিবেশ তো পাঁচ তারকা হোটেলের স্যুইট আর স্যাভয় গ্রিল আস্বাদনের চাইতেও বেশী লোভনীয়।" দেখলাম, যেহীন চেয়ার থেকে উঠার চেষ্টা করছে, আধশোয়া আমি উঠে তাকে দাঁড়াতে সহযোগিতা করে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? হাত দুটো আমার কাঁধের ওপর রেখে বললেন, "তুমি আর আমি তো মানুষের ভালোবাসার কাঙাল।"

কোনদিন যেহীন এর ব্যবহারে অসৌজন্যতার প্রকাশ দেখিনি, না দেখেছি এত বড় প্রতিষ্ঠান FIVDB নিয়ে গর্ব করতে। বলতেন, "না রে ভাই, এটা তো মুদির দোকানের মত ছোট।"

আমি বলেছিলাম, বন্ধু, এসব অভিজ্ঞতা তুমি লিখে রেখো। বলতেন, লিখব। কিন্তু লিখা আর হয়ে উঠতো না। ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশে তার ছিল প্রচন্ড অনীহা। আমার চাপাচাপিতে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট একটি করেছিলেন, তবে সেখানে ভাবের প্রকাশ ছিল খুবই সামান্য।

নিজে ছিলেন অকৃতদার, আমার মেয়েদের উপর আমার কোন অধিকার ছিল না ওনার কাছে, প্রায়শই মনে করিয়ে দিতেন, মেয়ে তিনটি ওনার, আমার না। আমি একদিন বললাম, "ভাই, আমাকে কেন বারবার মনে করিয়ে দাও? আমি তো স্বত্ব ত্যাগ করে তোমাকে দিয়ে দিয়েছি।" অট্টহাসি দিয়ে বলতেন, "না যদি ভুলে যাও এজন্য মনে করিয়ে দিই।"

ব্যক্তিজীবনে জেহীন ছিলেন অত্যন্ত নির্লোভ। পার্থিব কোন কিছুর প্রতি তেমন কোন আকর্ষণ ছিল না।

উর্দুতে একটি কথা আছে-
'দুনিয়া মে হুঁ, দুনিয়া কা তলবগার নহি হুঁ
বাজার সে গুজারতা হুঁ, খরিদ্দার নহি হুঁ।'

অর্থাৎ- দুনিয়াতে আছি, দুনিয়া আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি।
বাজারের পথে আমার নিত্য আনাগোনা, কোন লেনদেন নেই।

যেহীনের জীবন এই চরণ যুগলেরই বাস্তবিক প্রতিফলন।
শিষ্টাচারের ব্যত্যয় দেখিনি কখনো প্রিয় বন্ধু যেহীন আহমদের জীবনে। কিন্তু, জীবনের শেষ দিন সেটারো ব্যত্যয় ঘটেছে, যা আমাদের সকলের জীবনেই ঘটবে।

'গুস্তাখি করুঙ্গা সিরফ একবার/
লোগ চলেঙ্গে পয়দল, ম্যয় কান্ধেপে সওয়ার।'

( অসৌজন্যতা একবারই হবে জীবনে-
মানুষ যাবে পায়ে হেঁটে, আর আমি তাদের কাঁধে।)

কথা ছিল ঢাকা থেকে এসেই দুদিন আমার এখানে থাকবে, সেটা আর হয়ে উঠলো না। আর কখনো হবেও না। আল্লাহ তোমাকে জান্নাতবাসী করুন, আমীন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.