Sylhet Today 24 PRINT

হাসিনা: পুরাণের ফিনিক্স পাখির গল্প

আলমগীর শাহরিয়ার |  ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

“হাসিনা: এ ডটার’স টেল” ফিল্মটি মুক্তির প্রথমদিন স্টার সিনেপ্লেক্সে দেখতে দেখতে আমার গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখির গল্পের কথা মনে পড়েছে। প্রায় সকলেই জানেন প্রাচীন গ্রিক পুরাণে আছে, ফিনিক্স হল এক পবিত্র আগুন পাখি । এই আগুন পাখিটির জীবনচক্র আবর্তিত হয় হাজার বছর ধরে। কথিত আছে একবার বিপদসংকুল এই পাখিটি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দগ্ধীভূত এই পাখি তার ছাই ভস্ম থেকেই জন্ম নেয় আবার। লাভ করে নতুন জীবন। শুরু হয় তার অবিনাশী যাত্রা। এ ডটার টেল’স দেখতে দেখতে দর্শকদের সেই পুরাণের পাখির কথাই বারবার মনে পড়বে। জীবন যেন রূপকথার গল্পের মত। কখনো কখনো রূপকথার গল্পেরও অধিক।

‘এ ডটার’স টেল’-এর শুরুতেই দেখা যায় একজন সাদামাটা বাঙালি নারী রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। তিনি শেখ হাসিনা। স্মৃতিচারণ করছেন তাঁর মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের। যার ডাকনাম রেণু। বঙ্গবন্ধু যাকে অপরিসীম ভালোবাসতেন। ফিল্মটিতে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু তাকে কি প্রগাঢ় মমতায় লেখা এক চিঠিতে ‘প্রাণের রেণু’ বলে সম্বোধন করছেন। যিনি ছায়ার মতন সারাজীবন, এমনকি মৃত্যু অবধি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়লেও আমরা দেখি একজন গ্রাম্য বাঙালি রমণী কি অসীম সাহস, ত্যাগ, তিতিক্ষায়, ঝড়-ঝাপটায় দক্ষ মাঝির ন্যায় ঘর নামক সংসার নৌকার হাল ধরে আছেন। তাঁর অবদান স্মরণ করলে নজরুলের ‘তরুণের সাধনা’ প্রবন্ধের কথাগুলোই মনে পড়বে। “ ইহারা থাকেন শক্তির পেছনে রুধির-ধারার মত গোপন, ফুলের মাঝে মাটির মমতা-রসের মত অলক্ষ্যে।”

বাঙলার প্রত্যন্ত এক নিবিড় গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা। মাটির মমতা রসের মতই সারাজীবন অলক্ষ্যে ছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী হয়ে। উচ্চশিক্ষিত না হয়েও ভেতরে ধারণ করতেন সম্পূর্ণ আধুনিক মন মানসিকতা। একটা ঘটনায় আমরা তাঁর পরিচয় পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রী সুলতানা খুকী। যার ক্রীড়া নৈপুণ্য কিংবদন্তীর মত ছিল। তাকে শেখ কামাল পছন্দ করতেন। কিন্তু একটি মেয়ে খেলাধুলা করে সেটা সহজভাবে নেবার মত রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত সমাজ তখনো তৈরি হয়নি। সম্বন্ধ পাকাপাকি হলে শেখ হাসিনা তখন ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে বলছেন, মা, মেয়েটিকে কিন্তু বিয়ের পরও খেলতে দিতে হবে। তাতে তিনি আপত্তি করেননি।

শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালে প্রথম ঢাকায় আসেন। টুঙ্গিপাড়া থেকে তিন খোলের নৌকায় সেবার নদীপথে আসতে তাদের ৪ দিনের মত সময় লেগেছিল। পাকাপাকিভাবে তারা ঢাকায় আসেন ১৯৫৪ সালে। ৫৮ সালে আইয়ুব জমানায় মার্শাল ল জারি হলে কিভাবে মাত্র তিন দিনের নোটিশে তাদের বাড়ি ছেড়ে পথে বসতে হয় সে করুণ গল্পও দর্শককে নাড়া দেবে। পুরো পাকিস্তান জমানায় জেল জুলুম আর নির্যাতনে কাটানো বঙ্গবন্ধু মুজিব তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে একটু স্বস্তির জীবন চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বদেশে ঘাতকের বুলেট তাকে এভাবে সপরিবারে রক্তাপ্লুত করবে তিনি কস্মিনকালেও কল্পনা করেননি। কারণ তিনি অন্ধের মত তাঁর দেশের মানুষকে বিশ্বাস করতেন, ভালোবাসতেন। শেখ রেহানা বলছেন, এটা ছিল আমাদের কাছে ‘অচিন্তনীয়’। ভাগ্যের কি নির্মম খেলা। শেখ হাসিনার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মসূত্রে দু’বোন তখন বেলজিয়ামে। সকালে হঠাৎ টেলিফোন বাজতে থাকলে সুরটা বড় কর্কশ লেগেছিল শেখ হাসিনার কাছে। টেলিফোনের সেই কর্কশ সুর আজো ভুলতে পারেননি। বিভীষিকার মত আজো তাড়িয়ে বেড়ায়। আগের রাতেও সেখানকার রাষ্ট্রদূত সানাউল্লাহ তাদের ক্যান্ডেল নাইট ডিনার দিয়েছেন। বেলজিয়ামে নিযুক্ত সেই রাষ্ট্রদূত বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে প্রায় সাথে সাথে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেন। নিজের গাড়িটি পর্যন্ত নষ্ট বলে একটু এগিয়ে দেননি। এখানে আমাদের একজন চরম সুবিধাবাদী আমলার চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। আবার বেলজিয়াম সীমান্তের ওপারে মানবিক একজন আমলারও দেখা পাই। তিনি সিলেটের হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। সস্ত্রীক যিনি সেই দুঃসময়ে ঔদার্য আর হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছিলেন সেদিন। পরিবারের কেউ আর বেঁচে নেই ততক্ষণে দুই বোনই জেনে গেছেন।

এক বোন আরেক বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন আর ভাবছেন একজন জানেন আরেকজন নিশ্চয়ই এখনও এ নির্মম, নিষ্ঠুর খবর জানেন না। অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা মার্শাল টিটো তাদের খোঁজ নিয়েছেন। ভারতের ইন্দিরা গান্ধী তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ভারতে আশ্রয় দিয়েছেন। সেখানেও তাদের কি দুঃখের দিন। মাত্র দুই কামরার একটি বাসায় বলতে গেলে তাদের বন্দী জীবন। রেহানা বলছেন, মিঃ... তালুকদার, মিসেস...তালুকদার ছদ্মনামের আড়ালে নিজেদের নামটি পর্যন্ত বদলে ফেলতে হয়েছে।  

এরমধ্যে একদিন আজমির শরীফে যান। সেখানেও তাঁরা নাম পরিচয় লুকিয়েই যান। কিন্তু অবাক করে দিয়ে মাজারের খাদেম ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু যে মাজার শরীফ গিয়েছিলেন তা দেখালেন। ১৯৮১ সালের ৯ এপ্রিল। একই তারিখ। কি কাকতালীয় ঘটনা!

তাঁর অবর্তমানে দলীয় প্রধান নির্বাচিত হন। দেশে ফিরে শেখ হাসিনা এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে গেছেন দল ও মানুষের কাছে। নোয়াখালীর বন্যাদুর্গত চরক্লার্কে গেলে পরে এক নারী বুকে টেনে একটা ডাব খেতে দিয়ে বলেছিলেন, তোমার বাবাও আমাদের জন্য জীবনভর করেছেন তুমিও করছো মা। তোমাকে আমরা ভুলব না। এই স্বীকৃতিকেই জীবনের প্রাপ্তি বলে জেনেছেন। তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে বাদ পড়েনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথে শহীদ নূর হোসেনের কথাও। ১০ নভেম্বর, ১৯৮৭ সালের গণবিক্ষোভের দিন কাছে ডেকে বলেছিলেন, তুমি শার্ট পরো। তোমাকে তো বাঁচতে দেবে না। নূর হোসেন বলেছিল, আপা একটু দোয়া করে দেন। গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়ে দেব। সেই নূর হোসেনের লাশও দেখেছেন একটু পর।
ডটারস টেল
স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বিশ্বস্ত সহচর, অকৃত্রিম সুহৃদ তাজউদ্দীন আহমদ কিছুটা অভিমানে দূরে সরে গেলে বঙ্গবন্ধু ব্যথিত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা পিতাকে কিছুটা সান্ত্বনার সুরে সেদিন বলেছিলেন, মোশতাক কাকা তো আছেন। বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, তুই মোশতাককে চিনিস? ও যেকোনো সময় আমার বুকে ছুরি চালিয়ে দেবে। খুনিরা যে অবাধে তাদের বাড়িতে আসতেন। তাও বলেছেন।

সবুজ গ্রাম টুঙ্গিপাড়ার খালে-বিলে হিজল গাছে গজানো অসংখ্য শেকড় ধরে জলে ঝাপাঝাপির স্মৃতি আমাদের হাওর এলাকার খালপাড় ভরতি হিজল করচের কথাই মনে করিয়ে দেয়। টুঙ্গিপাড়ার আলসেখানার সেই মেয়েটি কিভাবে এক পৃথিবী শোক কাটিয়ে একদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে শত্রুর সকল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে আলোর পথে নিয়ে আসলেন ‘এ ডটার’স টেল’ যেন সে কথাগুলোই বারবার মনে করিয়ে দেয়। এভাবেই একজন প্রত্যয়দীপ্ত সংগ্রামী সাহসী নারীর জীবন রাষ্ট্রের সমান হয়ে উঠে। ফিল্মটি পরিচালনা করেছেন নির্মাতা রেজাউর রহমান খান পিপলু। গুণী শিল্পী দেবজ্যোতি মিশ্রের সংগীত পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান- “আমার সাধ না মিটিলো আশা না পুরিলো সকলই ফুরায়ে যায় মা” বারবার আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। স্বপ্নের সোনার বাংলার জন্য সারাজীবন যে সংগ্রাম করলেন তাঁর জীবদ্দশায় তা অপূর্ণ থেকে যাবে---সেই খেদই যেন এই গানে ফিরে ফিরে আসে। সব হারানো শোকে শাড়ির আঁচলের কোণে যখন শেখ হাসিনা অশ্রু মুছেন এজিদের পাষাণ হৃদয়ও কেঁদে উঠবার কথা। তাই এটা শুধু একজন ব্যক্তি শেখ হাসিনার জীবনের গল্প নয়; এ যেন শত ঘাত প্রতিঘাত, ঝড় ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ, কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে, হাল না ছেড়ে, শেষ না দেখে---অসম সাহসী যুদ্ধে লড়ে ঘুরে দাঁড়ানো আশাবাদী এক বাংলাদেশের গল্প। জীবন কখনো কাল্পনিক গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্রেরও অধিক।

‘এ ডটার’স টেল’ দেখতে দেখতে মনে পড়ে শেখ হাসিনার জীবন সত্যি পুরাণের সেই ফিনিক্স পাখির মতন।

আলমগীর শাহরিয়ার: কবি, প্রাবন্ধিক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.