Sylhet Today 24 PRINT

বাংলা মায়ের ছেলে

উজ্জ্বল দাস |  ২৬ জানুয়ারী, ২০১৯

একজন মুক্তিযোদ্ধা, সংগীত পরিচালক হিসেবে সরকারের কাছে ৫০ হাজার টাকা জমা দিয়ে আড়াই কাঠা জমির জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। ৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে আড়াই কাঠার প্লট বরাদ্দ করে দেন। কিন্তু পরবর্তী সরকার এসে সেই প্লট কেড়ে নেন। এরপর তিনি অনেক অনেক বার অনেক অনেক মন্ত্রী, এমপিদের কাছে যোগাযোগ করেছেন। দপ্তরে দপ্তরে টেবিলে টেবিলে যাতায়াত করেছেন কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি, আজও সেই জমি আর তাঁর হয়ে উঠেনি। সেই ৫০ হাজার আজও রাজউকে গচ্ছিতই আছে। তিক্ত সে অভিজ্ঞতা বুকে লালন ধারণ করে তিনি লিখলেন- ‘আমি জায়গা কিনবো কিনবো করে, পেয়ে গেলাম জায়গাশুদ্ধ বাড়ি’।

অঙ্গে তেতো স্বাদের অনুভূতি নিয়ে তাঁর সহজ সরল স্বীকারোক্তি ছিলো, 'দেশকে যাঁরা প্রকৃত ভালোবেসেছেন তাঁদের মূল্যায়ন কখনোই হয়নি। হয়েছে যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে তাদের।'

এমন জীবন ঘনিষ্ঠ, নির্জলা সত্যপ্রকাশে দ্বিধাহীনদের বড্ড আকাল যাচ্ছে এজগৎ সংসারে। তারপরও কিছু মানুষের এই সত্য অনুভূতি প্রকাশ আমাদেরকে তাঁদের মতো করে পথ চলতে উদ্বুদ্ধ করে। বরেণ্যজন হিসেবেই উনারা প্রতিষ্ঠা পান জাতীর দর্পণে।

আহমদ ইমতিয়াজ বুলবুল (জন্ম ১জানুয়ারি ১৯৫৬ মৃত্যু ২২ জানুয়ারি ২০১৯,) ছিলেন এমনই একজন। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব যিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের শেষ লগ্ন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রসহ দেশের সংগীতাকাশে একজন শতভিষা। একাধারে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অকুতোভয় লড়াকু যোদ্ধা। দেশাত্মবোধের এক কিংবদন্তীতুল্য সংগীতসাধক। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। একেবারে কাঁচা সোনা।

কত আর হবে, সবে এস.এসসি পরীক্ষায় বসার সময় হয়েছে, বয়স ১৫ ছুঁই ছুঁই। যে বয়স মায়ের কোল আঁকড়ে বসে থাকার কথা, যে বয়স মায়ের আঁচলে ঘাপটি মেরে ঠাকুরমার ঝুলির কল্পগাথা শুনার কথা। ভাবতে শরীর হিম হয় আসে, এই ১৫ বছর বয়সে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। পাকিস্তানীদের পৈশাচিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করার দ্রোহে হোন উজ্জীবিত। অন্যায় আর বিদ্রোহে ব্রতি হয়ে তিনি তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের ২ নাম্বার সেক্টরে মেজর মোহাম্মদ হায়দারের অধীনে যুদ্ধ করায় সুযোগ লাভ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫মার্চের 'অপারেশন সার্চলাইটের' পর বুলবুল ও তাঁর বন্ধুরা মিলে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে ছোট একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন যাদের ঘাঁটি ছিল ঢাকার জিঞ্জিরায়। জুলাইয়ে বুলবুল ও তাঁর বন্ধু সরোয়ার মিলে নিউমার্কেটের ১ নাম্বার প্রবেশমুখের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লরিতে গ্রেনেড হামলা করেন। আগস্ট মাসে ভারতের আগরতলায় কিছুদিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ঢাকায় ফিরে ‘ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন’ নামে একটি গেরিলা দল গঠন করেন। অল্পদিনের ব্যবধানে দৃঢ়চেতা মনোবল আর বিপ্লবের বহ্নিশিখা ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হোন। রণাঙ্গনে পেয়ে যান ব্যাপক পরিচিতি। অক্টোবরে পুনরায় ভারত যাওয়ার সময় বুলবুলসহ চারজন কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি তন্তর চেকপোস্টে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হন। আটক হওয়ার পর প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে ও পরে ওখানকার শান্তি বাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে নির্যাতনের শিকার হন। পরবর্তীতে বয়সে ছোট হওয়ায় তিনি মুক্তি পান কিন্তু ঢাকায় তার নিজ বাসা থেকে পুনরায় আটক হন ও মানিক মিয়া এভিনিউ'র এমপি হোস্টেলে নির্যাতনের শিকার হন। সেখান থেকে তাকে রমনা থানায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী রমনা থানা থেকে আহতাবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে তাকে পিজি হাসপাতালে বর্তমান শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ধীরে ধীরে অসুস্থতা কাটিয়ে কিশোর যোদ্ধা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে থাকেন।

রক্তে যার সুরের মাতম, সে কী আর তাল লয় সুর ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে? শৈশবে গান ছিলো তাঁর ধ্যান জ্ঞান। ভাবনায় ছিলো সংগীতের মাধ্যমে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ঝাণ্ডা তুলে ধরবেন। সে ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারও বছর আটেক আগে জন্মের মাত্র ছয় সাতেক বছর পরেই তিনি তৎকালীন ঢাকার হোটেল শেরাটনে গিটার বাজাতে শুরু করেন। এভাবে গিটার বাজিয়েই তার রুটি রুজির ব্যবস্থা করা শুরু করেন, সদ্য হামাগুড়ি দিয়ে আসা সেই ছেলেটিই তখন যাদুকরি হাতে সম্মোহন করতেন শ্রোতা দর্শক মন। সংগীতের বিরল প্রতিভা হিসেবে সবাই তাঁকে বুকে টেনে নিতো আত্মার আত্মীয় ভেবে। সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা মূলত: তখন থেকেই তাঁর শিরা-উপশিরায় ঝর্ণাধারার মতো প্রবহমান হতে থাকে। সুপ্ত বাসনাটাকে , সাময়িক বন্ধ রাখেন, দেশমাতাকে শক্রমুক্ত করার জন্য। দেশস্বাধীন হবার পর আবারো নবউদ্যমে সংগীতের প্রতি আসক্তিটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।

মনস্থির করেন, গ্রেনেড হাতে যেভাবে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি দেশকে নিয়ে গান লিখে, সুর দিয়ে দ্রোহের আগুনটা সবসময়ের জন্য জ্বালিয়ে রাখবেন। শুরু হয় ভিন্ন সংগ্রামে।

  • লেখক: প্রভাষক, মদনমোহন কলেজ, সিলেট।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.